বিশ্বজিৎ সরকার, রায়গঞ্জ: ছেলে আগেই না ফেরার দেশে। স্ত্রী’ও চলে গিয়েছেন ৪০ দিন হল। শুকনো মুখে জানলার লোহার শিকগুলো ধরে এখন মায়ের প্রতীক্ষায় একা সুব্রতবাবু। পাঁচ বছর আগে ছেলে হারিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করেছিলেন। সেই বাঁধন হঠাৎই আলগা হয়ে যায় ৪০ দিন আগে।
এখন রায়গঞ্জ (Raiganj) শহরের মিলনপাড়ার তস্য গলিরাস্তার ধারে নিজের বাসভবনে এই প্রথমবার শরতের আগমনীর আবহে তিনি একদম একা। অনন্ত শূন্যতায় খাঁখাঁ করছে দোতলা বাড়ি। বাড়ির প্রবেশ মুখের বারান্দায় প্রয়াত পুত্র সোমশুভ্রের স্মরণে সহপাঠী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহে গড়ে ওঠা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। আলমারিতে ঠঁাসা রকমারি বিষয়ের বই। সব তালাবন্দি। একতলার রিডিং রুম থেকে ডাইনিং রুমের আনাচে কানাচে ছড়ানো অসংখ্য স্মৃতির ভিড় যেন মস্ত পাথরের মতো ধেয়ে আসছে পেশায় প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের বিষাদমাখা হৃদয়ে। সাজানো গোছানো বেডরুমের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে টাঙানো কাচের ফ্রেমবন্দি সদ্য বিয়োগ হওয়া পত্নী মধুমিতাদেবীর স্মিত হাস্যমুখ। ঠিক পাশেই রংতুলিতে মূর্ত সোমশুভ্রের অনাবিল হাসি ঝরানো ছবি।
কলকাতার (Kolkata) আশুতোষ কলেজে স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন সোমশুভ্র। হঠাৎ কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯-এর অক্টোবরে আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর। পুত্রহারার শোক ভাগ করে দীর্ঘ বছর ক্যানসারে আক্রান্ত শিক্ষিকা স্ত্রীর পাশে সূর্যের আলোর মতো সঙ্গী ছিলেন শিক্ষক স্বামী। শারীরিক কষ্টকে কার্যত জয় করেই জীবন যুদ্ধের স্রোতে পরস্পরের সান্নিধ্যে অপরাজিত ছিলেন অধিকারী দম্পতি। কিন্তু সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে আলো ছড়ানো দীপটাও উৎসবের প্রাক মুহূর্তে দপ করে নিভে গেল ২৩ অগাস্ট ভোর পৌনে তিনটে নাগাদ। দশপ্রহরণধারিণীর আগমনের মুহূর্তে সুব্রতবাবুর আকাশ যেন লন্ডভন্ড । মাত্র ৫১ বছর বয়সে ছেলে আর জায়ার শোকে বিভোর শিক্ষক আজ বড় একা।
একসময় শারদোৎসবের (Durga Puja) আগে মৃন্ময়ী দেবী চিন্ময়ী রূপ পেতেন তাঁর হাতে। ছেলেবেলা থেকেই দেবীর মূর্তি গড়া তাঁর শখ। আর ক’দিন পরেই দেবী হৈমবতীকে ঘিরে আনন্দে আমোদে আহ্লাদিত হবেন মর্ত্যবাসী। চোখ ধাঁধানো আলোয় মানুষের উপচে পড়া পুজোমণ্ডপ থেকে অনেক যোজন দূরে নির্জন ঘরে নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকবেন ‘সর্বহারা’ এই শিক্ষক। সবাই যখন দেবী দশভুজা দর্শনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ছেলে আর স্ত্রীর সঙ্গে এতদিনের একাত্ম বন্ধনের স্মৃতিচারণায় মগ্ন থাকবেন তিনি।