সায়নদীপ ভট্টাচার্য, বক্সিরহাট : এমনটাও সম্ভব? রাজদীপের কীর্তি দেখে সবাই এখন সমানে এই প্রশ্নটাই করছেন। বাবা-মা দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন। তাঁদের সামলে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে দুবেলা টিউশন পড়াতে হয়েছে। জীবনের সঙ্গে সমানে লড়াইয়ে ফলটাও হাতেনাতে মিলেছে। তুফানগঞ্জ-২ ব্লকের রামপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের রাজদীপ মালাকার রামপুর সিঙ্গিমারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে পড়াশোনা করে ৯৫.৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৭৭।
পরীক্ষায় বসাটা অবশ্য তার কাছে খুব একটা সহজ ছিল না। বাবা গোবিন্দ মালাকার স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মা ঘর সামলাতেন। একমাত্র সন্তান রাজদীপকে নিয়ে সুখেই তাঁদের সংসার চলছিল। অতিমারের জেরে লকডাউন পর্বে তাতে ছন্দপতন। বাবা-মা দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। সে সময় মাধ্যমিকের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজদীপকে তার বাবা-মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য শিলিগুড়ি, কলকাতা সহ নানা জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়। তবে তাতে কাজ হয়নি। ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের মানসিক ভারসাম্যহীনতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়ার জেরে গোবিন্দবাবুর মাইনে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলে শিক্ষকতা করে যেটুকু টাকা জমিয়েছিলেন তা দুজনের চিকিৎসা ও ওষুধের পিছনেই খরচ হয়ে যায়।
জীবন সমানে প্রতিকূল হয়ে উঠতে থাকলেও রাজদীপ হাল ছাড়েনি। সেই সময় থেকেই বাজার হাট থেকে বাড়ির রান্নাবান্না, সবই সে একা হাতে সামলেছে। সংসারের খরচ জোগাতে ষষ্ঠ শ্রেণি ও দশম শ্রেণির দুই পড়ুয়াকে সে ইংরেজিতে টিউশন পড়ানো শুরু করে। টিউশনির টাকাতেই সে সংসার খরচ সামলানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যায়। এভাবে লড়াই চালিয়ে তার এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা। বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর : বাংলায় ৯০, ইংরেজিতে ৯৯, ইতিহাসে ৯০, ভূগোলে ৯২, অর্থনীতিতে ৯৯ এবং দর্শনে ৯৭।
রাজদীপ বলল, লকডাউনের পর থেকেই আমার বাবা-মা দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। সে সময় আত্মীয়স্বজনরা কেউই আমাদের কোনও খোঁজ নেয় না। দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়ায় বাবার মাইনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুজনকে টিউশন পড়িয়ে যেটুকু আয় হত তা দিয়ে সংসার খরচ চালানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুলের শিক্ষকরা বইখাতা সহ নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। বাড়ির রান্নাবান্না শেষ করে বাবা-মাকে স্নান, খাওয়ানো থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ সমস্তটাই নিজের হাতে করতে হত। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে সরকারি স্কলারশিপ হয়তো পাব না। ডব্লিউবিসিএস বা আইপিএস অফিসার হতে চাই। কিন্তু আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে আমার সেই স্বপ্ন কোনওদিন পূর্ণ হবে কি না তা জানা নেই। পরিস্থিতির চাপে তাকে হয়তো বাড়ির কাছাকাছি কোনও কলেজ থেকেই পড়াশোনা করতে হবে বলে রাজদীপ মনে করছে। প্রতিবেশী রাজু সাহা বললেন, রাজদীপ বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। তবে তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসাটা খুব একটা সহজ ছিল না। শিশুদের মতো করে বাবা-মাকে স্নান করানো, খাওয়ানো থেকে শুরু করে সমস্তটাই তাকে একা হাতে সারতে হয়েছে। এত সব সামলেও উচ্চমাধ্যমিকে ও নজরকাড়া ফল করেছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে ও অনেকটাই এগোবে।
ছাত্রের লড়াইকে রামপুর সিঙ্গিমারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রামদুলাল সাহারায় সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তিনি বললেন, রাজদীপ বরাবরই মেধাবী পড়ুয়া। শত বাধা অতিক্রম করে ও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বরও পেয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে তাঁদের অন্যতম প্রিয় পড়ুয়ার স্বপ্ন সফল হবে বলে রামদুলালবাবুরা মনে করছেন।