শংকর
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর জন্মতিথি পালন করা হলেও ইংরেজি তারিখটিকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। রামকৃষ্ণদেবের সেই জন্মতারিখটি ১৮ ফেব্রুয়ারি। সবে আমরা পেরিয়ে এলাম দিনটি। এমন পরম পুরুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আরেক মহামানবের। তিনি নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালের বিবেকানন্দ। কেন এবং কীভাবে সাক্ষাৎ, কিছু আপাত না চেনা কথা আমরা ইতিহাস খুঁড়ে উল্লেখ করতে পারি।
স্বামীজিরা ছিলেন দশ ভাইবোন। নরেন্দ্রনাথ ষষ্ঠ সন্তান। এঁদের সম্বন্ধে আজও বহুকিছু অজানা। কিছু কিছু কথা বিবেকানন্দ নানা সময়ে উল্লেখ করেছেন। সেগুলি থেকে দু-এক আঁজলা আমরা পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে পারি। গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। স্বামীর আকস্মিক অকালমৃত্যু ও বড়ছেলের গৃহত্যাগের পর নিঃসম্বল অবস্থায় তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের পিত্রালয়। অসহায়া কন্যার পাশে সারাজীবন দাঁড়িয়েছেন জননী রঘুমণি বসু। স্বামীজিও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। যাইহোক, মায়ের আকস্মিক মৃত্যু হলে মায়ের অবস্থা কী হবে, কীভাবে ভরণ-পোষণ হবে, তার মর্মস্পর্শী ইঙ্গিত রয়েছে স্বামীজির চিঠিতে।
আমরা কথায় ফিরব সেই সময়ে, যখন পিতাকে হারিয়ে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী দিশেহারা। কালচক্রে রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি স্বামীজির নিজের কথা তুলে ধরব এখানে। নরেন্দ্রনাথের জন্মের পর তাঁর পিতৃদেব একটি জন্মকুণ্ডলী করান, কিন্তু তিনি তা পুত্রের কাছে কখনও প্রকাশ করেননি। পিতৃদেবের মৃত্যুর পর কিছু কাগজপত্রের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ সেই জন্মকুণ্ডলী খুঁজে পান। তাতে তিনি দেখেন, তাঁর পরিব্রাজক হওয়ার কথা সেখানে নির্দিষ্ট ছিল।
ছোটবেলা থেকেই ধর্ম ও দর্শনচর্চায় নরেন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি শাস্ত্রের উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করেন। বুঝতে পারেন, মানুষের পক্ষে ত্যাগই শ্রেষ্ঠ আদর্শ। পরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারেন, ‘আমাদের যা শ্রেষ্ঠ আদর্শ তা তিনি জীবনে পরিণত করেছেন। ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ যে পথের পথিক, সেই পথ অবলম্বন করবার প্রবল আকাঙ্খা আমার মধ্যেও জেগে উঠল। আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করবার সংকল্প নিলাম।’ বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পেয়েছিলাম, তিনি অদ্ভুত লোক। পাণ্ডিত্য তাঁর কিছুই ছিল না। পড়াশোনাও বিশেষ করেননি। কিন্তু শৈশব থেকেই সত্যের প্রত্যক্ষানুভূতি লাভ করার তীব্র আকাঙ্খা তাঁর মনে জেগেছিল। স্বধর্ম-চর্চার মধ্য দিয়ে তাঁর সাধনার শুরু। পরে তিনি অন্যান্য ধর্মমতের মধ্যে দিয়ে সত্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় একের পর এক অন্য ধর্মসম্প্রদায়ে যোগদান করলেন। কিছুকাল তিনি সম্প্রদায়গুলির নির্দেশ অনুযায়ী সাধন করতেন, সেই সেই সম্প্রদায়ের ভক্তদের সঙ্গে বাস করে তাদের ভাবাদর্শে তন্ময় হয়ে থাকতেন। কয়েক বছর পরে আবার তিনি অন্য এক সম্প্রদায়ে যেতেন। এইভাবে সব সাধনার শেষে তিনি সিদ্ধান্ত করলেন, সব মতই ভালো। কোনও ধর্মমতেরই তিনি সমালোচনা করতেন না। তিনি বলতেন, বিভিন্ন ধর্মমতগুলো একই সত্যে পৌঁছোবার বিভিন্ন পথ মাত্র। তিনি আরও বলতেন, এতগুলো পথ থাকা তো খুবই গৌরবের বিষয়, কারণ, ঈশ্বরলাভের পথ যদি একটিমাত্র হত, তবে সেটা একজন ব্যক্তির পক্ষেই উপযোগী হত। পথের সংখ্যা যত বেশি থাকবে, ততই আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে সত্যলাভের বেশি সুযোগ ঘটবে। যদি এক ভাষায় শিখতে না পারি, তবে আরেক ভাষা শিখবার চেষ্টা করব, সব ধর্মমতের প্রতি তাঁর এমনই গভীর শ্রদ্ধা ছিল।
হাজার হাজার লোক এই অপূর্ব মানুষটিকে দেখতে এবং সরল গ্রাম্যভাষায় তাঁর উপদেশ শুনতে আসতে লাগল। তাঁর প্রত্যেকটি কথায় বিশেষ শক্তি মেশানো থাকত। তাঁর প্রত্যেক কথা হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে দিত। অদ্ভুত এই মানুষটি সেকালের ভারতের রাজধানী এবং আমাদের দেশের শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র, যেখানে প্রতি বছর শত শত সন্দেহবাদী ও জড়বাদীর সৃষ্টি হচ্ছিল, সেই কলকাতা শহরের কাছে বাস করতেন। তবু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী, অনেক সন্দেহবাদী এবং অনেক নাস্তিক তাঁর কাছে এসে তাঁর কথা শুনতেন। এমন আশ্চর্য মানুষটির খবর একসময় পেলেন নরেন্দ্রনাথ। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই মানুষটির খবর পেয়ে আমিও তাঁকে দর্শন করতে গেলাম। কিন্তু তাঁকে একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হল, কিছু অসাধারণত্ব খুঁজে পেলাম না।’
প্রথম দর্শন দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে। তাঁরই ঘরে। সেইদিন দুটি গান গেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। গান শুনে তাঁর ভাব হয়ে গিয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ রামবাবুদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ছেলেটি কে? আহা কি গান!’ গান তো গাইলেন নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু তার পরেই ঠাকুর হঠাৎ উঠে আমার হাত ধরে তাঁর ঘরের উত্তরের দিকের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। তখন শীতকাল, উত্তুরে হাওয়া আটকাবার জন্যে বারান্দাটা ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা ছিল। তাই বাইরের কাউকে আর দেখা যাচ্ছিল না। তারপর তিনি সেখানে যা বললেন এবং করলেন তা কল্পনাতীত। তিনি হঠাৎ নরেন্দ্রনাথের হাত ধরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পূর্ব পরিচিতের মতো বলতে লাগলেন, ‘এতদিন পরে আসতে হয়? আমি তোমার জন্যে যে কীভাবে প্রতীক্ষা করে আছি, তা একবার ভাবতে নেই? বিষয়ী লোকের কথা শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে গেল, প্রাণের কথা কাউকে বলতে পাইনে।’
এইভাবে অনেক কথা বলতে লাগলেন। সেইসঙ্গে কাঁদতেও লাগলেন। তারপর নরেন্দ্রনাথের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি— নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি দূর করবার জন্যে আবার শরীর ধারণ করেছ।’ ইত্যাদি।
নরেন্দ্রনাথ তো শুনে নির্বাক। স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এ তিনি কাকে দেখতে এসেছেন? এ তো একেবারে উন্মাদ। নাহলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্রকে এইসব কথা কেউ বলে! নরেন্দ্রনাথ চুপ করে গেলেন। ঘরের ভিতর গিয়ে ঠাকুর মাখন, মিছরি ও কতকগুলি সন্দেশ এনে নরেন্দ্রনাথকে নিজে হাতে খাওয়াতে লাগলেন। নরেন্দ্রনাথ বারবার বললেন, ‘খাবারগুলো আমাকে দিন, আমাদের সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করে খাব।’ কিন্তু ঠাকুর কিছুতেই সেসব কথা শুনলেন না। বললেন, ‘ওরা খাবে এখন, তুমি খাও।’ বলেই হাতে যা ছিল সব নরেন্দ্রনাথকে খাইয়ে তবে নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘বলো, তুমি শীঘ্র আর একদিন একা আমার কাছে আসবে!’
ঠাকুরের এই একান্ত অনুরোধ এড়াতে পারলেন না নরেন্দ্রনাথ। মুখে বললেন, ‘আসব’। তারপর নরেন্দ্রনাথ আবার ঘরে এসে সঙ্গীদের পাশে বসলেন। সেখানে বসেই ঠাকুরকে লক্ষ করতে লাগলেন নরেন্দ্রনাথ। না, ইনি তো উন্মাদ নন। তাঁর চালচলন, কথাবার্তা ইত্যাদিতে উন্মাদের কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। বরং ভক্তদের প্রতি তাঁর উপদেশ শুনে ও তাঁর অদ্ভুত ভাবসমাধি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তখন নরেন্দ্রনাথের মনে হল, তিনি সত্যি-সত্যি একজন ঈশ্বর-জানিত মানুষ। তিনি মুখে যা বলছেন, তা তিনি নিজেও অনুভব করেছেন। তাই ধীরে ধীরে তাঁর দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন নরেন্দ্রনাথ, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?’ বিন্দুমাত্র দেরি না ঠাকুর উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। তোমাদের যেমন দেখছি, তোমাদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলছি, ঠিক তেমনি ভাবেই তাঁকে দেখা যায় ও তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু কে তা চায়? লোকে স্ত্রী, পুত্র, ধন-সম্পত্তি ইত্যাদির শোকে কত চোখের জল ফেলে, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কে ওইরূপ করে? তাঁকে পাবার জন্যে কেউ যদি তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে, তবে তিনি নিশ্চয়ই তাকে দেখা দেন।’
ঠাকুরের এই উত্তর শুনে নরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন, মানুষটি তাঁর নিজ উপলব্ধি থেকেই কথাগুলো বলছেন। কিন্তু কোনও ভাবেই একটু আগে উন্মাদের মতো তাঁর আচরণের সঙ্গে এই কথার সামঞ্জস্য খুঁজে পেলেন না। তা সত্ত্বেও মনে হতে লাগল, উন্মাদ হলেও ইনি মহাত্যাগী ও মহাপবিত্র এবং শুধু এই জন্য মানবহৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাবার যথার্থ অধিকারী। এইসব নানাবিধ চিন্তা করতে করতে সেদিন ঠাকুরকে প্রণাম করে নরেন্দ্রনাথ বিদায় নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়বার দুজনের দেখা সেই দক্ষিণেশ্বরে। সেবার নরেন্দ্রনাথকে দেখে স্তব করেছিলেন ঠাকুর। বলতে লাগলেন, ‘নারায়ণ, তুমি আমার জন্য দেহ ধারণ করে এসেছ!’
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি যে কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে তা প্রথমবার গাড়িতে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ ঠিক ঠাহর করতে পারেননি। তারপর গিয়েছেন হাঁটাপথে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে গেলেন কালীবাড়ি। সোজা চলে গেলেন ঠাকুরের ঘরে। নরেন্দ্রনাথ দেখলেন, ঠাকুর তাঁর ছোট তক্তপোশখানির উপরে বসে আছেন। নরেন্দ্রনাথকে দেখেই তিনি আনন্দের সঙ্গে ডেকে তাঁর বিছানার উপর বসালেন। বসেই দেখলেন, তিনি যেন কীরকম ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছেন। এবং নরেন্দ্রনাথের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে বলতে তাঁর দিকে সরে এলেন।
নরেন্দ্রনাথ ভাবলেন, আগের দিনের মতো বুঝি আবার একটা পাগলামি করবেন। কিন্তু তা নয়। ঠাকুর করলেন কী, তাঁর ডান পা নরেন্দ্রনাথের গায়ের উপর রাখলেন। ওই স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত উপলব্ধি হল। চোখ মেলে নরেন্দ্রনাথ দেখলেন, দেয়ালগুলো ও ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র বেগে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যেন সব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘আমার আমিত্ব সহ সারা বিশ্বটাই যেন এক সর্বগ্রাসী মহাশূন্যে বিলীন হতে ছুটেছে। তখন আমি এক মহাভয়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হল— আমিত্বের নাশেই মরণ, সেই মরণ আমার সামনে, অতি নিকটে। সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম, ওগো, তুমি আমার এ কি করলে, আমার যে বাপ-মা আছেন!’
নরেন্দ্রনাথের কথা শুনে সেদিন ঠাকুর উচ্চৈস্বরে হেসে উঠলেন। হাত দিয়ে বুকে টুক টুক করে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘তবে এখন থাক, একেবারে কাজ নেই, কালে হবে।’ আশ্চর্যের বিষয়, ঠাকুর একথা বলতে না বলতেই নরেন্দ্রনাথের ওই অদ্ভুত উপলব্ধি নিমেষে থেমে গিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে এই দুই মণি-কাঞ্চনযোগে সমাজে, দেশে, বিশ্বে কী ঘটেছে তা কম-বেশি সকলের জানা।