উত্তর সম্পাদকীয়

রামের দাক্ষিণ্যে জয় অসম্ভব, মোদির লক্ষ্য ভিন্ন

সম্বিত পাল

২৫ বছরের তরুণীটি বোধহয় সারা জীবনে এতটা অবাক হননি, যতটা এই বছরের ২২ জানুয়ারি হয়েছেন! সারা দিন অবাক হয়ে চারদিকে দেখেছেন, এ কোন উৎসব এসে গেল তাঁর ঘরের কাছে। দিন দশেক কেটে যাওয়ার পরও কথা বলতে গিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেই দিনটি নিয়ে তাঁর ঘোর কাটেনি।

হায়দরাবাদের এই তরুণী রামনবমীর দিন মন্দির বা বাড়িতে রামের পুজো হতে দেখেছেন ছোট থেকেই। কিন্তু রামের এরকম সর্বজনীন ‘অকালবোধন উৎসব’ তাঁর কাছে প্রথম। দুর্গাপুজোর সময়  তেলেঙ্গানাজুড়ে যে কোনও জলাশয়ের কাছে ফুল নিয়ে গান গেয়ে বটুকাম্মা এতদিন তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব ছিল। কিন্তু ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার আচার ঘিরে হায়দরাবাদ শহরজুড়ে রাস্তা আটকে প্যান্ডেল করে রামের মূর্তিপুজো, অযোধ্যার অনুষ্ঠানের লাইভ টেলিকাস্ট, চারদিকে গেরুয়া পতাকায় ছেয়ে যাওয়া — তাঁর প্রথম দেখা।

সবচেয়ে বেশি বোধহয় তাঁকে অবাক করেছে তাঁর বয়সি বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে রামের পুজো করা, প্রদীপ দিয়ে বাড়ি সাজানোর আয়োজন!

হায়দরাবাদের এই তরুণীর অভিজ্ঞতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ‘জয় শ্রীরাম’ মূলত উত্তর ভারতের ‘স্লোগান’ হলেও, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মতো সেই স্লোগান দক্ষিণের রাজ্যগুলিতেও সুচারুভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন বিজেপি ও সংঘ পরিবারের কর্মীরা। শ্রীরামের প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান ঘিরে সেই চেষ্টা খানিকটা সংগঠিতভাবে করা হয়েছে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে। কোনও কোনও জায়গায় তা সাধারণ মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। কোথায় বিরোধও তৈরি হয়েছে। কেরলে খুব মাতামাতি না হলেও বেশির ভাগ জায়গায় ২২ জানুয়ারি ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলেছে। কর্ণাটকে বিজেপির থেকেও নিজেকে বেশি রামভক্ত প্রমাণ করতে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া নিজেই রামসীতার মূর্তির আবরণ উন্মোচনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন এবং সরকারি উদ্যোগেই মন্দিরে মন্দিরে রাম-ভজনের আয়োজন হয়েছে। তামিলনাডুতে রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানের লাইভ টেলিকাস্টে ডিএমকে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে — এই অভিযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছে একদল। কাজেই উত্তরের মতো দক্ষিণেও রামনাম হয়েছে সর্বত্র।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশজুড়েই রামের অস্তিত্ব আছে। তুলসীদাসের রামায়ণ যেমন উত্তর ভারতে বহুল প্রচলিত, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে যেমন কৃত্তিবাসের রামায়ণ জনপ্রিয়, তেমন দক্ষিণ ভারতে দ্বাদশ শতকের কাম্পান ও ইঝুথাচানের রামায়ণের চল। গল্পে ও আলেখ্যতে কিছুটা ফারাক থাকলেও রামের কাহিনী অজানা নয় দক্ষিণ ভারতীয়দের। তবে উত্তর ভারতের মতো বা বাংলায় এখনকার রাস্তায় রাস্তায় শোভাযাত্রা করে রামনবমী পালনের মতো রাম কখনোই ‘জনদেবতা’ হয়ে ওঠেননি দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে। তার মূল কারণ দাক্ষিণাত্যের ভাষা ও জাতিগত আন্দোলন, লৌকিক দেবতার পুজো ব্রাহ্মণ্যবাদকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অনেকদিন থেকেই।

তামিলনাডুর দ্রাবিড় আন্দোলন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাই ডিএমকে নেতা ও তামিলনাডুর মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতে পিছপা হন না।

এ কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও অজানা নয় যে, দক্ষিণ ভারত ও উত্তর ভারতের মধ্যে একটি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বিভাজনরেখা রয়েছে। কর্ণাটক এবং হায়দরাবাদের পুরসভার নির্বাচন ছাড়া বিজেপি দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে দাঁত ফোটাতে পারেনি। গত বছর কর্ণাটক নির্বাচনে বেঙ্গালুরু সংলগ্ন অঞ্চলগুলির বাইরে মোদি ম্যাজিক কাজই করেনি। কেরলে আরএসএস-এর সবচেয়ে বেশি শাখা থাকলেও, সেখানে বিজেপি কিন্তু বাম-কংগ্রেস দ্বৈরথে ভাগ বসাতে পারেনি। তেলেঙ্গানাতেও প্রমাণিত হয়েছে, হিন্দুত্বের রাজনীতি বিজেপিকে নির্বাচনি ডিভিডেন্ড দেয়নি। শেষমুহূর্তে কৌশল বদল করেও লাভ হয়নি গেরুয়া শিবিরের।

তবু রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রামায়ণের পথ ধরে একে একে দক্ষিণের রামবিজড়িত মন্দিরগুলি শুধু দর্শনই করেননি, সেখানে পুজো-আচার সব পালন করেছেন। একে একে ঘুরে বেড়িয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের জটায়ুর স্মৃতি নিয়ে তৈরি বীরভদ্র মন্দির (যেখানে রামনবমীর দিন রামসীতার বিয়ের অনুষ্ঠান হয় প্রতি বছর), কেরলের ত্রিশূরে ত্রিপ্র্যায়ার শ্রীরামস্বামী মন্দির (কাছাকাছি রাম ছাড়াও লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন ও ভরতের মন্দির রয়েছে), তামিলনাডুর শ্রীরঙ্গনাথ মন্দির (কথিত রয়েছে এখানের বিষ্ণুমূর্তি রাম বিভীষণকে দিয়েছিলেন লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার জন্য), রামেশ্বরম মন্দির (সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার আগে রাম এখানে শিবের পুজো করেছিলেন), শ্রীকোঠানধারামা স্বামী মন্দির (যেখানে বিভীষণের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল)।

তিনি কাশীতামিল সংগম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন বারাণসীর সঙ্গে তামিলনাডুর যোগাযোগ বহুকালের। অবশ্য দক্ষিণকে দিল্লির সঙ্গে জোড়ার জন্য নতুন সংসদ ভবনে সেঙ্গল স্থাপন করে সেই কাজ তিনি অনেক আগেই শুরু করেছেন। এর অন্যতম কারণ যদি হয় এটা দেখানো যে, রাম শুধুমাত্র উত্তর ভারতের দেবতা নন, তাঁর সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের যোগ রয়েছে। অন্য কারণও রয়েছে এর পিছনে।

২০২৪-এ তৃতীয় বারের জন্য সরকারে ক্ষমতায় আসার প্রস্তুতির মধ্যে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে ভারতের একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার কাছাকাছি আর কোনও নেতা নেই। রাজনৈতিক নেতা থেকে তিনি নিজেকে একজন ‘স্টেটসম্যান’ বা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তুলে ধরছেন। যিনি ছোটখাটো রাজনৈতিক জটিলতার ঊর্ধ্বে। এই ইমেজটি পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ তিনি দক্ষিণের মানুষের মন জয় করতে পারবেন। তাই তিনি রামের হাত ধরেছেন।

এর পিছনে নির্বাচনি রাজনীতির অঙ্ক যে একেবারেই নেই, তা নয়। তৃতীয় বারের জন্য যদি মোদি ক্ষমতায় আসেন, তাঁর লক্ষ্যই থাকবে ৪০০-র বেশি আসন পাওয়া এবং দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের ভোট। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধির হত্যার পরে কংগ্রেস সহানুভূতির হাওয়ায় ৪১৪টি আসন পেয়েছিল। যদিও উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলির উপরই বেশি ভরসা বিজেপির। জম্মু-কাশ্মীর ও পঞ্জাবকে বাদ দিলে এবং বিহারকে ধরে এদিকে ২৯৩টি আসন রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আরও ২৫টি। এই রাজ্যগুলি থেকে সব আসনই মোদি জিতে নেবেন এমনটা নয়। মহারাষ্ট্রে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। পূর্ব ভারতের ওডিশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৭৮টি আসনের মধ্যে কতগুলি আসন বিজেপি পেতে পারে তা এখনই হলফ করে বলা যায় না। ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গে যে ফলাফল বিজেপি করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নাও হতে পারে। সুতরাং দক্ষিণের দিকে তাঁকে তাকাতেই হবে।

২০১৯-এর নির্বাচনে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, তামিলনাডু, কেরল, পুদুচেরি এবং লাক্ষাদ্বীপ মিলিয়ে ১৩১টি লোকসভা আসনের মধ্যে  বিজেপি জিতেছিল মাত্র ২৯টি আসন। তার মধ্যে কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানা থেকেই ছিল ২৫টি। আঞ্চলিক দলগুলি বেশিরভাগ আসনে জয়ী হলেও দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছিল ২৮টি আসন।

তবে মোদি আশার জায়গাগুলি চিহ্নিত করেছেন। যেমন ত্রিশূর। মন্দির দর্শনের পরে অভিনেতা-রাজনীতিবিদ সুরেশ গোপীকে নিয়ে রোড শো করেছেন নরেন্দ্র মোদি।  তাঁর মেয়ের বিয়েতে যোগ দিয়েছেন। তাঁকেই এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করতে চলেছে বিজেপি। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য মাঝে মাঝেই শিরোনামে উঠে আসা ত্রিশূরে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ১১ শতাংশ থেকে বিজেপির ভোট ২৮ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল।

তামিলনাডুতে জোটসঙ্গী এআইডিএমকে বিজেপির হাত ছেড়ে দিলেও রাজ্য সভাপতি আন্নামালাইয়ের হাত ধরে মেরুকরণের রাজনীতির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটকের ভোটাররা বিধানসভা নির্বাচনে যাই করুন, লোকসভা নির্বাচনে মোদিকেই ভোট দেবেন বলে ধরছে গেরুয়া শিবির।

এইসবের মধ্যে রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠাকে ঘিরে দাক্ষিণাত্য সফরে রাম কতটা দাক্ষিণ্য দেখাবেন, তা বলা কঠিন। রামনামের তেজ যে জানুয়ারির পরে দক্ষিণীদের মনে বেশিদিন থাকবে না, তাও একপ্রকার নিশ্চিত। কিন্তু ছবিগুলি সাধারণ মানুষের মনে থেকে যাবে। যেমন হায়দরাবাদের তরুণীর এখনও বিস্ময় কাটেনি। তাই রামনামের প্রচার হোক বা না হোক, মোদি নামের একজন নেতা যে দক্ষিণীদের মনে নিজের ছবি ও ইমেজের ছাপ রাখতে চেয়েছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এবার সেই ছবি দিয়ে ভোট পাওয়া সংগঠনের কাজ। সে কাজে বিজেপি এখনই কতটা সফল হবে তা বলা কঠিন।

(লেখক পুনের এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুনের বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Antibiotics | কমছে দেহের রোগ প্রতিরোধ! অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রুখতে কড়া কেন্দ্র

শিলিগুড়িঃ মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে মানব শরীরের। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার…

7 mins ago

Accident | ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে সাইকেল আরোহীর মৃত্যু, দেহ ঘিরে বিক্ষোভ

রসাখোয়া: ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হল এক সাইকেল আরোহীর। শনিবার দুর্ঘটনাটি (Accident) ঘটে রসাখোয়ার…

12 mins ago

Lightning | মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে বিপত্তি, বজ্রাঘাতে মৃত্যু হল এক ব্যক্তির

তুফানগঞ্জ: মালদার পর তুফানগঞ্জ। বাজ (Lightning) পড়ে মৃত্যু (Death) হল এক ব্যক্তির। ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে…

14 mins ago

Tourist death | নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি নদীতে, সিকিমের সিংতামের কাছে মৃত্যু বাঙালি পর্যটকের

শিলিগুড়ি: পাহাড়ে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল এক বাঙালি পর্যটকের। শনিবার সকালে ঘটনাটি ঘটে শিলিগুড়ি থেকে…

27 mins ago

Snatching Incident | মোটরবাইকে চেপে হার ছিনতাই, নিরাপত্তা নিয়ে সরব বাসিন্দারা

শিলিগুড়ি: ছিনতাই থেমে নেই শহরে। শুক্রবার শিলিগুড়ি (Siliguri) শহরের ভারত নগর ও দেশবন্ধু পাড়ায় দু’টি…

39 mins ago

Kalyan Banerjee | ‘১ লক্ষ ভোটে হারবেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়’, এমন পোস্টার ঘিরে উত্তেজনা শ্রীরামপুরে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ভোটের আগে শ্রীরামপুরে পোস্টার ঘিরে উত্তেজনা। তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য…

55 mins ago

This website uses cookies.