শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

শেষ আপডেট:

প্রশান্ত মল্লিক

কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র শুরু হয়, তখন স্থানীয় পর্যটন বিকাশের জন্য প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের বোঝানো কঠিন ছিল। দেখতাম, বেশিরভাগই রাজি হতেন না। অল্প কিছু পরিবার রাজি হত। ধীরে ধীরে কয়েক বছরে হোমস্টে পর্যটন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে, এখনকার মতো পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি বাঁকে, গ্রামে এত হোমস্টে গড়ে ওঠেনি।

গত ১২-১৪ বছরে পরিচিত-অপরিচিত সব গ্রামেই দ্রুত হোমস্টের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুরুতে, গ্রামের হোমস্টেগুলো সাধারণ মানের, পাহাড়ি ঐতিহ্যের নির্মাণ ছিল। কিন্তু পরে আধুনিক নির্মাণ শুরু হয়। যা অনেক নামীদামি হোটেল-রিসর্টকেও হার মানায়। শুরুতে, দুই-তিনটি ঘর নিয়ে হোমস্টে শুরু হলেও, পরে সেই সংখ্যা বেড়ে কোথাও কোথাও ১০-১২টিতে পৌঁছায়।

২০১৬-’১৭ সালে সরকারের নজরে এলে, কিছু নিয়মকানুন প্রণয়ন করা হয়। প্রতিটি হোমস্টের ঘরের সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু গ্রামে গ্রামে বড় বড় হোটেলের মতো হোমস্টে নির্মাণের পেছনে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের কথা জানা যায়। ঘরের সংখ্যা ও মানের ওপর ভিত্তি করে, বার্ষিক লিজ চুক্তিতে হোমস্টের নামে হোটেল বা রিসর্টের ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। এই ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, এজেন্টদের মাধ্যমে হোমস্টে খোঁজা শুরু হয়। লিজ নিতে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা টাকার থলি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরদাম করে চুক্তি সেরে হোমস্টের নামে হোটেল-রিসর্ট ব্যবসা শুরু করে।

লিজ চুক্তিতে হোমস্টে মালিকদের দাপটে পাহাড়ি গ্রামের পরিবেশ বদলাতে থাকে। কিছু হোমস্টে মালিক লিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁদের মতে, হোমস্টে কখনও লিজ দেওয়া যায় না। সরকার হোমস্টে নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ছাড় ও অনুদান দেয়। হোমস্টে মালিকরা পর্যটন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ বা চার লাখ টাকার বার্ষিক চুক্তিতে তাঁদের বাড়ি ছেড়ে দেন। এককালীন টাকা পাওয়া এবং দায়িত্ব এড়ানোর লোভে তাঁরা লিজ দেওয়াকেই সুবিধাজনক মনে করেন। আর ব্যবসায়ীরা হোটেল-রিসর্টের কর ফাঁকি দিয়ে হোমস্টে লিজ নিয়ে ব্যবসা করতে শুরু করেন। বর্তমানে, প্রায় ৭০ শতাংশ বা তার বেশি হোমস্টে লিজ অন্য মালিকদের হাতে চলে গিয়েছে।

গত ২০-২২ বছর ধরে যাঁরা স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে পর্যটন বিকাশের জন্য কাজ করছেন, তাঁরা হতাশ। গ্রামবাসীদের হোমস্টে খোলার জন্য উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য ব্যর্থ।

গত কয়েক বছরে, কিছু কিছু জায়গায় গ্রামবাসীরা হোমস্টে লিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছেন। দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় কিছু ক্ষেত্রে হোমস্টে লিজ দেওয়া বন্ধ হয়েছে। পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে সত্যিই এখন লাল সংকেত।

কালিম্পং জেলার কাফেরগাঁওয়ে সম্প্রতি জোরালো প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। কাফেরগাঁওয়ে হোমস্টে মালিক সংগঠনের সদস্য বুদ্ধ তামাংয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, এই সপ্তাহে জেলা শাসক সহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিবাদপত্র জমা দিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চাওয়া হবে। যত দ্রুত সম্ভব হোমস্টে লিজ প্রথা বন্ধ করার দাবি তাঁদের। লিজ চুক্তিতে ব্যবসা করা হোমস্টেগুলোর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে হোটেল-রিসর্টের লাইসেন্স নিতে বাধ্য করতে হবে। কালিম্পং জেলার সব গ্রামে হোমস্টে মালিকদের সংগঠিত করা হচ্ছে আন্দোলনের জন্য। সব মিলিয়ে হোমস্টে নিয়ে নতুন জট।

(লেখক কালিম্পংয়ের বাসিন্দা)

Sushmita Ghosh
Sushmita Ghoshhttps://uttarbangasambad.com/
Sushmita Ghosh is working as Sub Editor Since 2018. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad Digital. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.

Share post:

Popular

More like this
Related

বাংলাদেশে জঙ্গি হচ্ছে তরুণ-কিশোর প্রজন্ম

  মীর রবি ষড়যন্ত্রমূলক জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নৈরাজ্যবাদের...

মুর্শিদাবাদ-মালদায় সংঘর্ষ : অতঃকিম?

  সুমন ভট্টাচার্য আপাতত ‘অ্যাডভান্টেজ’ বিজেপির। মালদার মোথাবাড়ি এবং মুর্শিদাবাদের...

পকেটভরা চপমুড়ি ও বিচিত্র মানুষদের ভুলিনি

ভগীরথ মিশ্র সুকোমল। বালুরঘাটের ছেলে। তাকে চিনতাম। ব্লক পরিচালিত একটি...

নয়া বছরে চাই না ‘ভাল্লাগে না’ রোগ 

  সাহানুর হক  বাসে উঠেই মেয়েটি বান্ধবীকে বলতে লাগল, ‘উফ...