খোকন সাহা, বাগডোগরা: লাল টিনের চালের সারি সারি ঘর। দূর থেকে চেনা যায় নতুন ঝাঁ চকচকে রিসর্টটি। এমন রিসর্ট কম নেই উত্তরবঙ্গে। কিন্তু চম্পাসারির মিলন মোড়ের রিসর্টটি (Resort) ব্যতিক্রম। কারণ, মহানন্দা অভয়ারণ্যের ইকো সেনসেটিভ জোনের মধ্যে শুধু নয়, রিসর্টটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মহানন্দা নদীতে (Mahananda river)।
রিসর্টটি গড়ে তুলতে কম সময় লাগেনি। কিন্তু এই রিসর্ট নিয়ে কোনও তথ্যই এতদিন ছিল না মাটিগাড়া ব্লক প্রশাসনের কাছে। ফলে প্রশাসনিক ‘নজরদারি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যা কার্যত স্পষ্ট হয়েছে বিডিও বিশ্বজিৎ দাসের বক্তব্যে। তিনি বলছেন, ‘আজকেই বিএলআরও অফিসের টিম ওখানে গিয়েছে তদন্ত করতে। আমাদের গোচরে আসার পরই বিএলআরওকে জাননো হয়। বিএলআরও দপ্তর থেকে পরিদর্শন করে রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভয়ারণ্যের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বা ইকো সেনসেটিভ জোনে এবং নদীতে যে রিসর্ট হতে পারে না, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিডিও।
অভয়ারণ্যের ইকো সেনসেটিভ জোনের মধ্যে কোনও নির্মাণ থাকবে না -স্পষ্ট করে দিয়েছে বন ও পরিবেশমন্ত্রক। সংরক্ষিত এলাকায় কোনও নির্মাণ থাকলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ভাঙা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে মহানন্দা অভয়ারণ্যে এবং নদীর মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াল একটি রিসর্ট, সেই প্রশ্ন উঠেছে। এর পিছনে রাজনৈতিক প্রভাব যে রয়েছে, তাও উঠে আসছে প্রশাসনিক সূত্রে।
চম্পাসারির মিলন মোড় থেকে ডানদিকে আধ কিলোমিটার পথ গেলেই মহানন্দা নদীর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে রিসর্টটি। পাশে রয়েছে রাজ্য সরকারের জমি চিহ্নিত করা বোর্ড। অদূরেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। এর কাছেই ৩টি ক্র্যাশার বসানো হয়েছে। রিসর্টে বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া হয়েছে। দিনভর খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে। চলে ‘খানা পিনা’ও।
ইকো সেনসেটিভ জোন এবং নদীর ওপর তৈরি রিসর্টে বিদ্যুৎ সংযোগ কীভাবে দেওয়া হল, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্টেশনের কোঅর্ডিনেটর ও পরিবেশপ্রেমী অনিমেষ বসু বলছেন, ‘ইকো সেনসেটিভ জোনে বা নদীর মধ্যে কোনওভাবেই এমন রিসর্ট করা যায় না। পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াও আইনবিরুদ্ধ কাজ কীভাবে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গেল? প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে পদক্ষেপ করা।’
তাৎপর্যপূর্ণভাবে দায় এড়াতে চাইছেন কর্তারা। বিডিওর সাফাই, ‘আসলে রিমোট এলাকা বলে সবসময় নজর রাখা যায় না। তবে খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
কার্সিয়াং বন বিভাগের ডিএফও দেবেশ পান্ডে আবার বলছেন, ‘আমার বিভাগের অধীনে ওই রিসোর্ট রয়েছে কি না, খোঁজ নিয়ে বলতে পারব। তবে আমি কোনও রিসর্টের অনুমতি দিইনি।’
এলাকাটি চম্পাসারি গ্রাম পঞ্চায়েত মধ্যে। সেখানকার প্রধান জনক সাহার মন্তব্য, ‘কতদিন হলে তৈরি হয়েছে বলতে পারব না। তবে খুব বেশিদিন হয়নি। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে কোনও অনুমতি বা ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।’
এদিকে, যিনি এই রিসর্ট তৈরি করছেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। সূত্রের খবর, মালিক সম্ভবত ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। রিসর্টের এক কর্মী বলছেন, ‘আমি কিছু জানি না। যা বলার মালিকই বলবেন।’ কিন্তু স্থানীয় কারও বিনিয়োগ না থাকলে যে এই এলাকায় রিসর্ট তৈরি সম্ভব নয়, তা খোলসা করেছেন আরেক কর্মী।
বিষয়টি নিয়ে মাটিগাড়ার বিএলআরও ক্রিস্টোফার ক্লেমেন্ট ভুটিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে ফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিএলআরও দপ্তর সূত্রে খবর, এদিন বিডিওর নির্দেশেই মাপজোখ করা হয়েছে।
বেআইনি রিসর্টটি কি আদৌ ভাঙা হবে নাকি প্রশাসনিক ‘সেটিং’য়ে চাপা পড়বে পরিবেশপ্রেম- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।