রণজিৎ ঘোষ, শিলিগুড়ি: মানেভঞ্জন-টংলু/টুমলিং-কালিপোখরি হয়ে সান্দাকফু (Sandakphu)। এই রুট ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়। ট্রেকিংয়ে প্রতি বাঁকে মুগ্ধতা কিংবা ল্যান্ডরোভারে চড়ে হেলতে-দুলতে ওপরে ওঠা, দুটোই অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দেয়। ঘুমন্ত বুদ্ধের সৌন্দর্য, মরশুমে রডোডেনড্রন আর স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার হাতছানি। সম্প্রতি যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার পর থেকে একদিকে যেমন পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সান্দাকফুতে, অন্যদিকে বাড়ছে বিপদও।
চারচাকা গাড়ি নিয়েই সমতল থেকে সরাসরি সান্দাকফুতে পৌঁছে যাচ্ছেন পর্যটকরা। এতে আবহাওয়া ও উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়া হচ্ছে না তাঁদের। ফলে গন্তব্যে পৌঁছে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কারও কারও পরিস্থিতি গুরুতর হচ্ছে। অথচ সান্দাকফু এবং মানেভঞ্জনে এখনও পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। কেউ সামান্য অসুস্থ হলেও চিকিৎসার জন্য চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সুখিয়াপোখরিতে নামিয়ে আনতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে পর্যটকদের জীবন বাঁচাতে পরিবহণচালক থেকে হোটেল কর্মী, সরকারি কর্মচারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে দার্জিলিং জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার মানেভঞ্জনে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়। সেখানে দার্জিলিং সদরের মহকুমা শাসক রিচার্ড লেপচা, সুখিয়াপোখরির বিডিও অর্ঘ্য গুহ, উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (১) সহ স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সান্দাকফুর তুষারপাত বা সূর্যোদয়ের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে মানেভঞ্জন থেকে ট্রেকিং করে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়াই ছিল রেওয়াজ। সেজন্য তাঁদের গাইড নিতে হত সঙ্গে। ব্যাগপত্র বহনের জন্য ঘোড়া বা খচ্চরের ব্যবহার বহুদিন ধরে হয়ে এসেছে। এছাড়া যাঁরা চড়াই উতরাইয়ের ধকল নিতে পারেন না, তাঁরা ল্যান্ড রোভারে চেপে সান্দাকফুতে যান। এখন মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাতায়াতের জন্য ঝাঁ চকচকে রাস্তা তৈরি হয়েছে। শুধু ল্যান্ডরোভার নয়, অন্য গাড়িও অনায়াসে সেই পথে চলে। তাই সেখানে বছরভর পর্যটকদের ভিড় থাকছে।
সুখিয়াপোখরির বিডিও অর্ঘ্য গুহ বললেন, ‘প্রায় রোজ পর্যটকরা আসছেন। অধিকাংশই নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে নেমে গাড়ি নিয়ে সরাসরি সান্দাকফু পৌঁছান। অনেকেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমতলের উষ্ণতা থেকে সরাসরি প্রচণ্ড ঠান্ডায় চলে এসে এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। ফলে অসুস্থতা।’ বিডিওর দাবি, আগে শুধু প্রবীণরা অসুস্থ হচ্ছিলেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এখন মাঝবয়সি ও ছোটরা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছে। অক্সিজেনের অভাববোধ করছে। সম্প্রতি কয়েকটি বাচ্চার মধ্যে এমন অসুবিধে দেখা গিয়েছে।
এত উচ্চতায় মানুষের শরীরে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, কীভাবে সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব- সেসব ব্যাপারে সবাইকে বোঝানো হয়েছে। কারও শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কীভাবে সুস্থ করে তোলা যায়, সেটা স্বাস্থ্য আধিকারিকরা হাতে-কলমে দেখান। পাশাপাশি কীভাবে পালস মাপতে হয়, অক্সিজেন প্রয়োজন হলে কীভাবে দিতে হবে, প্রয়োজনে অসুস্থ ব্যক্তিকে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর দেওয়ার পদ্ধতিও দেখানো হয়েছে এদিন।
কর্মশালায় স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে স্থানীয়দের চারটি পালস অক্সিমিটার, রক্তচাপ পরিমাপের জন্য দুটি ডিজিটাল মেশিন দেওয়া হয়েছে। সান্দাকফুতে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) তরফে পর্যটন দপ্তরের অফিসে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বে থাকা কর্মী নরবু শেরপার কথায়, ‘শুধু একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে আমাদের কাছে। তাছাড়া এখানে আর কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। কোনও পর্যটক অসুস্থবোধ করলে তাঁকে সুখিয়াপোখরি বা দার্জিলিং, শিলিগুড়িতে নামাতে হবে।’
দার্জিলিং সদরের মহকুমা শাসক রিচার্ড লেপচার আশ্বাস, ‘সান্দাকফুতে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব রয়েছে। সেজন্য জমিও দেখা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত অনুমোদন চলে আসবে।’