- শুভময় দত্ত
কয়েকবছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পদ্ধতিবিজ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনায় নিম্নবর্গীয় ইতিহাসের পুরোধা গৌতম ভদ্র বলেছিলেন, ‘গবেষণার প্রতিটি শব্দ হল ‘ব্রহ্ম’, তাই ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের শব্দচয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
সদ্য প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অমিয়কুমার বাগচী একই সময় মন্তব্য করেছিলেন : ‘ইতিহাস কথা বলে না, ইতিহাসকে কথা বলানোর দায়িত্ব একজন গবেষকের।’
বিশেষভাবে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ধারাবাহিক কালানুক্রম না জানলে বিজ্ঞাননির্ভর ইতিহাসচর্চার গতি রোধ হতে বাধ্য। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, রাজভক্তির স্তুতি, ব্যক্তিনির্ভর ইতিহাস হতে পারে না। ইতিহাস বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে পরিশোধিত না হলে তা সংকটের।
ইতিহাস নিয়ে সবাই পড়তেই পারেন, জানতেই পারেন কিন্তু ইতিহাস লেখার অধিকার সবার নয়। গবেষণার পদ্ধতিবিজ্ঞানে এই সত্য কথাটির মূল্য অপরিমেয়, গভীরতাও অসীম। গবেষণার পরিভাষায় ‘মেথডোলজি’ অর্থাৎ পদ্ধতিবিজ্ঞান। সঠিক তথ্য বারবার যাচাইকরণ, নিবন্ধীকরণ, রাজ্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আর্কাইভের কাজ শিখতে হয়। তাকে নিয়ে বিশ্লেষণ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যা জানতে হয়, দীর্ঘশ্রম দিয়ে পড়তে হয়।
যার জন্য ইতিহাস লেখার চাইতেও বেশি প্রয়োজন ইতিহাস লেখার পদ্ধতিবিজ্ঞান সম্পর্কে অধ্যয়ন। প্রতি ক্ষেত্রের ইতিহাস লেখার ধারা-উপধারার স্বতন্ত্র পদ্ধতিবিজ্ঞান আছে। সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে নিয়ম, তা লোকসংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে পৃথক। ইতিহাস নিয়ে পড়লে বা পড়ালেই যেমন ইতিহাস লেখার অধিকার জন্মায় না, তেমন বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই সে বিজ্ঞানী, এই এক ভ্রান্ত ধারণা। তথাকথিত ইতিহাসবিদ বিষয়টি খুব মারাত্মক প্রভাব তৈরি করেছে জনমনে।
খুব সাধারণ ও শিক্ষায় প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ যেহেতু গবেষণার বিষয়ে ধারণা পোষণ করেন না, তাঁরা সেই তথ্যসম্পর্কিত বিষয়ের বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনুপুঙ্ক্ষ যাচাই না করেই সেই বিশ্লেষণকে বেদবাক্য মনে করে বসেন। এখানেই একজন প্রত্যয়ী গবেষকের বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক সময়ে লেখার চর্চা বেড়েছে। ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। ফলে যে যার ইচ্ছেমতো ইতিহাসনির্ভর বিষয়গুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে, বিনা যাচাইয়ে, অথবা বিধিবদ্ধ পদ্ধতিবিজ্ঞান না মেনেই লিখে ফেলছেন।
উচ্চতর গবেষণা শুধু যে ডিগ্রি অর্জনের ঈপ্সিত স্পর্ধা, তা নয়। বরং দীর্ঘ গবেষণা করে সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস লেখা ও তাঁকে প্রমাণ করাও তার দায়িত্ব। যেহেতু ইতিহাসচর্চায় সত্যনিষ্ঠা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভুল ইতিহাসের প্রভাব যে কী ভয়ংকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লক্ষ করা যায় ইতিহাসচেতনা যাঁদের নেই, তাঁদেরই ইতিহাসকেন্দ্রিক লেখার দাপট বেশি।
আধুনিক জোয়ারে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেশ অভাব অনুভূত হয়। যতটুকু আলোর উদ্দীপন আছে তাঁকে লালন করার দায়িত্ব সকলের। নইলে ভবিষ্যতে কে দেবে আলো, কে দেবে আশা।
(লেখক আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা। পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক)