- পূর্বা সেনগুপ্ত
কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলির কথা আমরা কে না জানি। অজয়ের তীরে কেঁদুলি গ্রামে বাস ছিল কবি জয়দেবের। আমরা আজ তাঁরই গৃহদেবতার কথা আলোচনা করতে বসেছি। কবি জয়দেব যখন এই ধরাতলে এসেছিলেন তখনও নদিয়ায় শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাব হয়নি। আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগেকার কথা। চারিদিকে তখন তন্ত্র সাধনার গোপন চক্র চলছে। বঙ্গভূমিতে তন্ত্র সাধনার নামে নারীদের নিয়ে স্বেচ্ছাচারে দেশ ভরে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নারীদের সামাজিক অবস্থান ধীরে ধীরে অধোগামী। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও খুব স্বচ্ছ নয়। কারণ গৌড়ে বাংলার রাজা তখন বল্লাল সেন। তিনি তখন বৃদ্ধ। যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন কিন্তু রাজকার্য সুচারুভাবে পরিচালনা করেন। তবু তন্ত্র ধারায় বল্লাল সেনের আকর্ষণ রাজ্যকেও ক্লেদযুক্ত করে তোলে। লক্ষ্মণ সেনের পরাক্রমে বঙ্গভূমি তখন কলিঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। যুবক লক্ষ্মণ সেন অসামান্য যোদ্ধা, তাঁর নিক্ষিপ্ত তির গঙ্গার প্রবাহ ভেদ করে এপার থেকে ওপারকে বিদ্ধ করে নিপুণ কৌশলে। এই লক্ষ্মণ সেনই একদিন জানলেন পিতা বল্লাল সেন এক তান্ত্রিকের প্রভাবে চরিত্রকে কলঙ্কিত করেছেন। তিনি এক যুবতী চণ্ডাল রমণীর সঙ্গে একান্তে প্রেমালাপ করছেন।
বৃদ্ধ পিতার এই ভ্রষ্ট জীবন লক্ষ্মণ সেনকে ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ করে তুলল। বঙ্গভূমির মাটি তন্ত্রের ক্লেদে পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। তার সংশোধন আশু প্রয়োজন- এ কথা তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন। তিনি পিতাকে কঠোর ভাষায় এক চিঠি লিখে বসলেন। যে চিঠির মাধ্যমে তিনি এক রাজাকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। বল্লাল সেনের মনে হল পিতাকে কটু কথা শোনানোর মধ্যে লক্ষ্মণ সেনের ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে। পিতা আর পুত্রের মধ্যে মনোমালিন্যের সূত্রপাত হল। যুবরাজ বলেছিলেন, যদি রাজার কাছেই নারীর কোনও সম্মান না থাকে, তবে সাধারণ নারীরা কতখানি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করে- এ বিষয়টি উপলব্ধি করার ইচ্ছা কি রাজার নেই? বল্লাল সেন যখন বুঝলেন না তখন লক্ষ্মণ সেন রাজধানী গৌড় ছেড়ে উপস্থিত হলেন অধুনা বীরভূমের কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলির কাছে, যেখানে অজয়ের তীরে সেন রাজাদের এক দুর্গ ছিল। সেই অঞ্চলটিকে তাই ‘সেনপাহাড়ী’ নামে চিহ্নিত করত সকলে। বর্তমানে বীরভূমের ‘শ্যামপাহাড়ী’ বোধহয় তারই অপভ্রংশ। যে সময় লক্ষ্মণ সেন গৌড় ছেড়ে এলেন রাঢ়বঙ্গে সেই সময় কেন্দুবিল্বতে বাস করছেন এক অতি প্রতিভাবান যুবক। তিনিই হলেন জয়দেব। তিনি তখন একমনে কাব্য আর শাস্ত্রচর্চা করে চলেছেন। তাঁর জীবনে গৃহদেবতা লাভ ছিল এক অলৌকিক কাহিনী।
শ্রীভোজদেব আর বামা দেবীর পুত্র ছিলেন জয়দেব। তাঁর বাড়ি ঠিক কোথায় তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। তাঁর মধ্যে শিশুকাল থেকেই কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটলেও সাংসারিক মনোবাসনার তিলমাত্র ক্লেদ ছিল না। কিন্তু এই জয়দেবের মধ্য দিয়েই তান্ত্রিক ভাবনার স্থলে শুদ্ধ প্রেমময় ঈশ্বর সাধনার ধারা রচিত হয়েছিল। জয়দেবের জীবন যেন শ্রীচৈতন্য আগমনের পথকে প্রস্তুত করেছিল বা ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা করেছিল নিপুণভাবে। অন্তর্রাধা আর বহির্কৃষ্ণ- এই যে ঈশ্বর প্রেমের ধারা তারই ছায়া আমরা দেখতে পাই জয়দেবের মধ্যে।
বিচিত্র এক চরিত্র জয়দেব। তৎকালীন সমাজে একেবারে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি ঈশ্বরের কাছে কেঁদে কেঁদে ফেরেন, এক মহৎ প্রেমকে জীবনে মূর্ত করবেন তিনি। কিন্তু সেই প্রেমকে কাব্যবদ্ধ করতে চাই এক প্রতীক, এক মাধ্যম। প্রেমকে আরাধনা করে জীবনে ধারণ করবেন তবেই না তিনি প্রেমকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন? দিনরাত কেঁদে ফেরেন জয়দেব। লোকে বলে এ উন্মাদ, এ কীসের জন্য কাঁদে? জয়দেবের এই কান্নাকে সার্থক করতে দরকার ছিল যোগ্য সহধর্মিণীর। সে আয়োজনও তৈরি হচ্ছিল নীরবে, বিধাতার ইচ্ছায়।
দক্ষিণ দেশ থেকে এক ভক্ত ব্রাহ্মণ পরিবার এসেছে নীলাচলে, প্রভু জগন্নাথ দেবের কাছে। অনেক পথ পদব্রজে অতিক্রম করে এসেছেন তাঁরা। সমুদ্রে স্নান সেরে সিক্ত বসনে জগন্নাথ মন্দিরের অভ্যন্তরে গিয়ে একমনে ইষ্টনাম জপ করে চলেন দুজন। প্রভু জগন্নাথের কাছে আকুতি জানান, একটিমাত্র সন্তান চাই তাঁদের। নিঃসন্তান জীবন নিস্তরঙ্গ লাগে। সারাদিন মন্দিরে উপবাসী থেকে মন্দির সংলগ্ন চত্বরে ধর্না দিয়ে থাকেন তাঁরা। যদি প্রভুর দয়া হয়। তৃতীয় দিন রাত্রে স্বামী-স্ত্রী যুগপৎ স্বপ্ন দেখলেন, মন্দির চত্বর আলো করে এক জ্যোতির্ঘন মূর্তি আবির্ভূত হলেন। তারপর তাঁদের দিকে অভয় হস্ত প্রসারিত করে বললেন, তোমাদের বাসনা পূর্ণ হবে।
ভোরের পাখির কূজন শুরু হওয়ার আগেই ব্রাহ্মণ দম্পতি উঠে পড়েন। আজ তাঁদের মন কানায় কানায় পূর্ণ। আবার সমুদ্র স্নান সেরে জগন্নাথ প্রভুকে প্রণাম জানিয়ে নিজেদের দেশের দিকে রওনা হলেন আনন্দিত মনে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের ঘরে এক অপরূপ রূপবতী কন্যা জন্মগ্রহণ করলেন। কন্যাটি যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, তাই দক্ষিণী দম্পতি তাঁর নাম রাখলেন পদ্মাবতী। কন্যাটি যে দেবাদিষ্ট সে সম্বন্ধে কারও দ্বিমত রইল না। সংগীত বা তাল শুনলেই পদ্মাবতীর অঙ্গ আন্দোলিত হয়। এত সুকণ্ঠের অধিকারিণী, যে গান শোনে সেই-ই মুগ্ধ হয়ে যায়। পদ্মাবতীর পিতা সুযোগ্য শিক্ষক রেখে কন্যাকে সংগীত ও নৃত্যের তালিম দেন। ধীরে ধীরে সেই কন্যা কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে উপনীত হয়। ব্রাহ্মণ যে জগন্নাথের চরণে কিছু শপথ করেছিলেন তা আর তাঁর স্মরণে থাকে না। দিনগুলি আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব সেই স্বাচ্ছন্দ্য দিনযাপনের ছন্দে তালভঙ্গ করল। পিতার আদেশে তাঁকে ভিক্ষা দিতে অগ্রসর হলেন পদ্মাবতী। ভিক্ষাগ্রহণ করে সন্ন্যাসী অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন। ‘আপনি হাসলেন কেন?’ পদ্মাবতীর পিতা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন। এই প্রশ্ন শুনে প্রতিপ্রশ্ন করেন সন্ন্যাসী, ‘এই কন্যাটি কার?’ – কেন আমার!- ‘এ কন্যার অঙ্গে যে চিহ্ন দেখলাম তাতে স্পষ্ট এই কন্যা দেবতার। দেবতার নৈবেদ্যে তো মানুষের অধিকার নেই।’ সন্ন্যাসীর মুখে এ কথা শুনে বিদ্যুৎঝলকের মতো মনে পড়ে যায় ব্রাহ্মণের। সত্যিই তো তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন দেবতার কাছে, ‘যদি কন্যাসন্তান হয় তবে তাঁকে তোমার চরণে নিবেদন করে যাব। সে হবে তোমার চরণে দেবদাসী।’ এতদিন বিস্মরণে ছিলেন ব্রাহ্মণ। আজ সন্ন্যাসী তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। কিন্তু পদ্মাবতীকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারেন না ব্রাহ্মণ। তাই মনের দুঃখ মনে রেখেই দিন অতিবাহিত করেন। কিন্তু তিনি ভুলে থাকতে চাইলেও ঈশ্বর তাঁকে ভুলে থাকতে দেবেন কেন? তাই হঠাৎ-ই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন পদ্মাবতী। কোনও বৈদ্যই তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারেন না। প্রবল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে কি যেন বলছে পদ্মাবতী। ব্রাহ্মণ শুনতে পান, জ্বরের ঘোরে পদ্মাবতী বলছেন, ‘যাই প্রভু যাই। তিনি আমাকে ডাকছেন।’ একথা শুনে চমকে যান ব্রাহ্মণ। মনে মনে বলেন, ‘জগন্নাথ তাঁকে ডাকছেন যখন, তখন আমি কেন বাধা হই। আমিই তাঁকে প্রভুর কাছে নিয়ে যাব, তাঁর কাছে দিয়ে আসব।’ ব্রাহ্মণ অঙ্গীকার করার পরদিনই ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন পদ্মাবতী। সম্পুর্ণ সুস্থ হলে ভারাক্রান্ত মনে, তাঁকে নিয়ে ব্রাহ্মণ দম্পতি চললেন নীলাচলে। একবার চাইতে গিয়েছিলেন, আর এবার যাকে চেয়েছিলেন তাঁকে দিতে চলেছেন দেবতার পায়ে।
মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে পা যেন আর চলে না। তবু প্রধান পুরোহিতের কাছে পদ্মাবতীকে নিয়ে গিয়ে অর্পণ করেন দুজনে। পদ্মাবতী থাকে মন্দির মধ্যে, আর বৃদ্ধ দম্পতি মন্দিরের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। গৃহে ফিরে যাওয়ার কোনও বাসনা তাঁদের নেই। সকালবিকাল কন্যাকে দেখেন দেবতার সম্মুখে নৃত্য করছেন। এটুকুই তাঁদের জীবনে যথেষ্ট। ব্রাহ্মণ দম্পতি নিজেদের এই ভাগ্যকে মেনে নিলেও বিধাতার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। একরাতে তিনজন একসঙ্গে স্বপ্ন দেখলেন, প্রভু বলছেন ব্রাহ্মণকে, ‘তোমার ভক্তিতে আর কন্যার সেবায় আমি তুষ্ট হয়েছি। তুমি এই কন্যাকে নিয়ে কেন্দুবিল্ব যাও, সেখানে জয়দেব গোস্বামী নামে এক ব্রাহ্মণ কুমার রয়েছে। তাঁর সঙ্গে পদ্মাবতীর বিবাহ দেবে।’ সকালে উঠেই দুজনে ছুটলেন মন্দিরের উদ্দেশে। প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁকে স্বপ্নের কথা জানালে তিনি কি বিশ্বাস করবেন? উৎকণ্ঠায় প্রাণ যেন কণ্ঠে আঘাত করে। দৌড়াতে দৌড়াতে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখেন প্রধান পুরোহিত তাঁদের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। প্রভু তাঁকেও একই স্বপ্নাদেশ করেছেন।
পদ্মাবতীর জীবনে শুরু হয় আরেক অধ্যায় পিতা-মাতার সঙ্গে তিনি বঙ্গভূমির এককোণে অবস্থিত কেন্দুবিল্ব গ্রামে উপস্থিত হন। সেই ভারতের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে একটি পরিবার ঈশ্বরের বিশেষ কার্য সাধিত করতে উপস্থিত হন বাংলায়। পাঠক স্মরণে রাখবেন তৎকালের রাঢ় অঞ্চল বিশেষ করে বীরভূম কিন্তু তন্ত্র সাধনের জায়গা। তন্ত্রভূমি বীরভূমের মধ্যে দক্ষিণের বৈষ্ণব সংস্কারে পরিপুষ্ট এক পরিবার, এক কন্যা, যিনি প্রভু জগন্নাথের আঙিনায় দেবদাসী ছিলেন তিনি এলেন বঙ্গদেশে। এ কেবল একটি পরিবার বা একটি কন্যার আগমন নয়। এ হল একটি ভাবের পরিভ্রমণ।
কেন্দুবিল্বতে এসে ব্রাহ্মণ দম্পতি কিন্তু বেশ হতাশ হন। যাকেই জয়দেব গোস্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করেন সেই-ই বলে অর্ধ উন্মাদ বাউন্ডুলে এক ছেলে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ তাঁর খবর দিতে পারলেন না, নীচু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কিছু সংবাদ পাওয়া গেল। ব্রাহ্মণ দেখলেন যাঁর খোঁজ করছেন তিনি সে জয়দেব প্রেমোন্মাদ। পাতায় পাতায়, বৃক্ষের কাণ্ডে লিখে চলেন কৃষ্ণ নাম। শুকনো পাতায় কৃষ্ণনাম লিখে অজয়ের জলে ভাসিয়ে দেন। যে নারীর মধ্যে স্বর্গীয় প্রেমধারণের ক্ষমতা রয়েছে সেই নারীকে কামলীলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। বৈষ্ণবদের কুঞ্জে কুঞ্জে, তান্ত্রিকদের আখড়ার মধ্যে সেই একই বিকৃত কামের আধিক্য। কিন্তু অন্তরে জয়দেব অনির্বচনীয় প্রেমের আহ্বান শুনেছেন। তাঁকে সফল করে তোলার জন্য সঠিক সঙ্গীর প্রয়োজন। তাই খুঁজে চলেন জয়দেব। এদিকে তাঁর খোঁজে চলেছেন পদ্মাবতীর পিতা।
অবশেষে দেখা হল দুজনের। কথোপকথন হল এই রকম,
- তোমার নাম জয়দেব?
- হ্যাঁ। উত্তর দিয়ে মনে মনে ভাবেন ইনি জানলেন কী করে?
- তোমার ঘর নেই?
- আমার চেয়ে বড় ঘর আর কারও নেই।
- যেমন?
- এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমার ঘর।
- সে ঘরের কথা বলছি না। বাসগৃহের কথা বলছিলাম।
- তার কোনও দরকার নেই।
- তুমি কী করো?
- অপেক্ষা করে আছি। এই আমার কাজ।
- কার অপেক্ষা?
- যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আসবে বলে।
ব্রাহ্মণ ভাবে এর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই। কিন্তু দেবাদেশ মান্য না করে যাব কী করে? পদ্মাবতীকে সব কথা জানালেন ব্রাহ্মণ। নতমুখে পদ্মাবতী জানালেন, তিনি যেমনই হোন না কেন তিনিই আমার স্বামী। ব্রাহ্মণ কাতর হয়ে প্রভু জগন্নাথকে ডাকতে থাকেন।
সেদিনই রাত্রে ঘটল আশ্চর্য ঘটনা। অবসন্ন জয়দেব রাত্রে এক গাছের তলায় শুয়ে পড়েছিলেন। গভীর রাত্রে কে যেন তাঁকে বলে গেল, ‘হে আমার ভক্ত আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি। অজয়ের কূলে কদম্বখণ্ডীর ঘাটে জলের তলায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসো।’
ভোর না হতেই জয়দেব ছুটে যান সেই কদম্বখণ্ডীর ঘাটে। জলে ঝাঁপ দিয়ে উন্মাদের মতো খুঁজতে থাকেন কিছু। বহুক্ষণ অজয়ের জলে অবগাহন ও অনুসন্ধানের পর হঠাৎ কীসে যেন হাত ঠেকে গেল। ডুব দিয়ে সজোরে তুলে নিয়ে এলেন শ্যাম ও রাধার বিগ্রহ। নাম হল ‘রাধা-বিনোদ’।
বিগ্রহ লাভ করলেন চালচুলোহীন জয়দেব। জল থেকে তুলে এক কদম্বগাছের তলায় বিগ্রহটি রাখলেন জয়দেব। উচ্চস্বরে শুরু করলেন কৃষ্ণনাম। গৃহহীন যাযাবরের কাছে দেবতা এসে ধরা দিলেন। কিন্তু তাঁর মন্দির কোথায়? জয়দেবের কৃষ্ণনামের টানে একে একে বহু লোক জড়ো হয়ে গেল। সেই বিরাট জনতাকে নিয়ে অজয়ের তীরে কৃষ্ণনামের স্রোত বয়ে গেল। যেন এক মেলা। জয়দেবের বিগ্রহ লাভের কথা কী করে যেন বর্ধমানের মহারাজের কানে উঠল। তিনি সেই কদম্বখণ্ডী ঘাটের কাছেই বিরাট মন্দির তৈরি করে দিলেন। দেবতা পেল মন্দির। কেবল দেবতা নয়, জয়দেবও পেলেন আশ্রয়স্থান। পদ্মাবতীর সঙ্গে বিবাহ হল তাঁর। দুজন অসামান্য প্রতিভাধর মানুষ জীবনের বাস্তব প্রেম দিয়ে রচনা করলেন মহান কাব্য ‘গীতগোবিন্দ’। এই কাব্যের প্রেরণা হয়ে রইলেন গৃহদেবতা ‘রাধা-বিনোদ’।