Friday, January 17, 2025
Homeরংদার রোববারছোটগল্পআশারামের ভগবান

আশারামের ভগবান

  • অবন বসু

আকাশ দেখতে দেখতেই মাথাটাথা ঘুরে, চোখে ধুতুরা ফুল ঘনিয়ে, অবিকল একটা লেত্তি-ফসকানো লাট্টুর মতোই একদিকে কেতরে পড়ে ছিল আশারাম। তিনদিন ধরে নাগাড়ে আকাশ দেখা যেমন চাট্টিখানি কম্ম নয়, গ্রামের শেষ মাথায় ভিটে হওয়াটাও তেমনই সুবিধার ব্যাপার নয়। মোটের উপর সে যে ঠাঠা রোদে এমন চিতপাত হয়ে পড়ে ছিল, কেউ সে কথা জানতেও পারেনি।
এদিকে, আদাড়পাদাড় ঘুরে পিড়িংশাক তুলতে গেছিল আশারামের বৌ ধুলাবতী। মাঝদুপুরে বাড়ি ফিরে আশারামকে অমন উঠোন আলো করে পড়ে থাকতে দেখেই একেবারে আহা-হাহা করে ছুটে এল। তারপর তার সোয়ামি লোকটাকে যথাসাধ্য টেনেমেনে উঠিয়ে, গায়ে মাথায় কিছুটা ডোবার জল ছিটোতে, তবে হুঁশ ফিরল আশারামের!
কিন্তু ধুলাবতী তখন রাগ সামলাতে না পেরে, সেই পিড়িংশাকের বোঝা দিয়েই আশারামের পিঠে আচ্ছামতন দু’-ঘা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘রোজ এমন ভূতেচাটার মতন উঠোনে বসে থাকো কেন, শুনি? বলি, আকাশ থেকে কি পরি নামবে নাকি তোমার জন্য?’
আশারাম ততক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। পচা জল আর পিড়িংয়ের গুঁতোয় তার মাথাটাও অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে। ধুলাবতীকে সে বলল, ‘হ্যাঁ বৌ, আর কিছু লুকোব না তোমার কাছে। আকাশ থেকে নামবে বটে, তবে কি না পরি নয়, ভগবান!’
‘ভগবান?’ আর একটা ঘা বসাতে গিয়েও ধুলাবতী কেমন একটু ভড়কে যায়। লোকটা হঠাৎ পেগলে গেল নাকি?
আশারামের মধ্যে কিন্তু কোনও পাগলের লক্ষণই ধরা গেল না। বেশ বড়সড়ো ভাবুক চোখেই আকাশটাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘শোনো বৌ, পরশু ভোররাতে স্বপ্নের ভেতর যেন দেখি, পিরহাটায় গেছি কার না কার কাঁচকলা বেচতে। তা, আমার তো কোনও দিনই কপাল ভালো না, তুমি জানো। তা, স্বপ্নেও ঠিক তা-ই হল। কলার মনে কলা পড়ে রয়, খদ্দের আর ছুঁয়েও দেখে না। শেষে ফস করে ঝুঁঝকোবেলায় ধুলো ওড়ানো একটা বাতাস দিতেই, হাট গেল ভেঙে! আর লোকে অমনি পিলপিল করে ছুটল যে যার ঘরের টানে! সেই অশৈলী ধারার ভাঙা হাটেও কে যেন একটা মাজাভাঙা লন্ঠন জ্বালিয়ে দিয়েছিল ঠিক কোনও কবরের বাতির মতন… তারই মিটমিটে আলোয় আমি বড় দুঃখী দুঃখী মুখে হাটের কোনায় একা পড়ে রইলাম অভাগার ধারা!
তা, পড়ে থাকতে থাকতে হয়তো বা ঘুমিয়েও পড়তাম আর একটু হলে। কিন্তু এমন সময়ে কে যেন পেছন থেকে ডেকে বলল, ‘আশারাম, তুমি আমায় ডাকছিলে?’ চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, উঃ সে কী রূপ রে বৌ! মানুষের মাঝে অমন চেহারা-চরিত্তির ইহজম্মে কারও হয় না। তালঢ্যাঙা শরীরে দুধে আলতার রং আর তার ওপর যেন মেঘের মতন বাবরি করা একঝাঁক চুল আর হুবহু পাটনাই গোরুর মতোই টানাটানা চোখ। তবে কিনা সবচেয়ে যা সাংঘাতিক তা হল, মাথার পিছনে যেন ক্যালেন্ডারের ছবির মতোই ঝকঝকে পিতল কি কাঁসার একখান থালা বসানো। তাতে আলো পড়ে যেন আস্ত এক আলোর গোলাই! আমি তো দেখামাত্রই কারবারটা ঠাহর করতে পেরে… একেবারে ঝপাস করেই ওঁর পায়ের উপরে পড়ে বললাম, ‘তুমি তো সবই জানো ঠাকুর! এই হদ্দমুদ্দ বেহাল জেবন নিয়ে আমি যে আর পারি না গো!’
‘তা, কথাটা শুনে উনি একটুখানি হেসে, পায়ের ওপর থেকে আমায় তুলে ধরে বললেন, ‘ভেবো না আশারাম, তোমার উঠোনে গিয়েই তোমার কপাল ফিরিয়ে দিয়ে আসব আমি। তুমি শুধু আর একটুখানি অপেক্ষা করো।’ ব্যাস, স্বপ্নটা অমনি দুম করেই ভেঙে গেল!

     সবটুকু শোনার পর ধুলাবতী এবার আলগোছেই আকাশের দিকে ফিরে একটা নাম-কা-ওয়াস্তে প্রণাম ঠুকে বলল, ‘দ্যাখো, যদি কিছু হয়। কিন্তু তাই বলে বাপু, তোমার আর এমন বাইরে পড়ে থাকা চলবে না! পিড়িংশাক ক’টা রান্নার ফাঁকে আমিই নয় মাঝেসাঝে উঠোনের দিকে নজর রাখতে পারব।’

দুই

কিন্তু পালা করে দুজনে নজর রাখতে রাখতেই কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল… আর বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেল। আর সেইসঙ্গেই নামল আকাশভাঙা বৃষ্টি। ভগবান তো দূরের কথা, ওই ঝড়জলের ভেতরে একটা কাক-কুকুরও আর আসার অবস্থা রইল না আশারামের কুঁড়েতে!
শেষে বৃষ্টির জল বাড়তে বাড়তে যখন ঘরের দাওয়া ছুঁয়েছে, ধুলাবতী রেগেমেগে চৌকাঠে এক লাথি মেরে বলল, ‘নিকুচি করেছে তোমার স্বপ্নের! কাল থেকে দুজনে ভিক্ষেয় বেরোব, তাও ভালো। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্ন করে তোমায় আর পড়ে থাকতে দেব না, এই বলে রাখছি!’

     কিন্তু তার কথাটা ভালোমতো শেষ হয়েছে কি হয়নি, তার মধ্যেই ধড়াম করে একটা বিকট আওয়াজ উঠল উঠোনের দিক থেকেই! একেবারে ঠায়ঠিক স্পষ্ট! আর সেই সঙ্গেই ‘ও হো হো’ করে একটা বেয়াড়া বেকায়দা চিৎকার! যার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরেই, আশারাম তড়িঘড়ি ঘর থেকে একটা জ্বলন্ত কুপি বার করে এনে হাঁক পাড়ল, ‘কে রে? কে বটে ওখানে!’
আর তখনই অন্ধকার থেকে হ্যঁাচোড়-প্যাঁচোড় করে একটা বিচিত্র কাদামাখা মূর্তি আলোর সামনে এসে কেঁদেকেটে বলল, ‘ভাই রে, আমি কৃষ্ণ! তোর উঠোনে কী জোর আছাড় খেলাম, দ্যাখ দেখি! ও হো হো!’
এদিকে ধুলাবতীও ততক্ষণে সামনে এগিয়ে এসে, মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে বলে উঠেছে, ‘তাই তো, বট ঠাকুরই তো! কিন্তু এ কী হাল আপনার? উঠুন, উঠুন, শিগগিরই ওপরে উঠুন।’
এরপর শুকনো গামছা, জল, কাপড় এইসব আনতে ধুলাবতী যখন ভেতরে ছুটেছে— আশারাম আর আশাকৃষ্ণ দুই ভাই একেবারে গলা ধরাধরি করে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল তারস্বরে। আশারাম কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ‘দাদা গো, সামান্য জমিজমার ভাগের জন্য ঝগড়া করে, এত বছর ছেড়ে থাকতে পারলে আমায়!’ শুনে আশাকৃষ্ণ কাঁদতে কাঁদতেও অল্প হাসে, ‘আরে, গেছিলাম বলেই তো ব্যবসা ফেঁদে এত টাকাকড়ি করতে পারলাম, আর তোর কথাও এত বেশি করে মনে পড়ল।’

তিন

রাতে ঝড়জল থামার পর চাঁদ উঠল একখানা নিখুঁত আস্ত। হাওয়া ছড়াল ধীর চালে মৌতাত টেনে। আর ঠিক তখনই পিড়িংশাক আর কলাইয়ের ডাল দিয়ে গরম ভাত মাখতে মাখতে আশাকৃষ্ণ বলল, ‘আয়োজনটাকে খারাপ বলছি না, তার ওপর বৌমার হাতে তো সব রান্নাই খাসা-কিন্তু কাল থেকে এ বাড়িতে মাছ-মাংস ঘি, দুধের গন্ধ ফুরোবে না, এই আমি আগাম বলে রাখলাম!’
দু’গাছি শুকনো পিড়িং চিবোতে চিবোতে আশারাম একটু ভয়ে ভয়েই বলে, ‘কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! তোমার ব্যবসাটা কীসের, দাদা? মানে বলছি, অতশত কুলোবে তো?’
‘ওহ, সেটাই বলিনি বুঝি? অর্জুনপুরে ধান-চালের ঢালাও কারবার আমার। লোকে তো মহাজনই বলে! কিন্তু সে সব আর ভালো লাগছে না রে, রাম। এবার ভাবছি, ব্যবসার পাশাপাশি দু’ভাই মিলে অন্য কিছুও করব— বাপঠাকুরদার কাজবাজ আর কী— দ্যাখ না, অমন কিছু ভেবেচিন্তেই আসার আগে বিঘা তিরিশের একটা কলাবাগান কিনে রেখে এলাম পিরহাটায়। মস্ত ব্যাপার! চ’ দু’ভাইয়ে মিলে হাজার হাজার কাঁদি কাঁচকলা ফলাই গিয়ে! তাতে যে কত লাভ, তুই ভাবতে পারবিনে!’

     অবশ্য ভাববেই বা কে! আশারাম ততক্ষণে ভাতের পাতেই মাথা ঘুরে, চিত হয়ে পড়েছে— আর তার মুখ থেকে জপের মতোই নাগাড়ে বেরুচ্ছে শুধু দুটো মাত্র শব্দ— কাঁচকলা আর ভগবান!

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Harishchandrapur | পুরোনো হামলার প্রতিশোধ! মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধ কে খুঁটিতে বেঁধে পেটালেন জনতা  

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে এক মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে মারধরের ঘটনা ঘটল হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকায়। মারধরের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঘটনাস্থলে গিয়ে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বৃদ্ধকে...

Yoga | থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন? নিয়ম মেনে করুন ৩ ব্যায়াম, মিলবে সুফল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: থাইরয়েডে সমস্যা থাকলে জীবনযাপন কড়া নিয়মে বেঁধে দেন চিকিৎসকরা। খাওয়াদাওয়ায় বিধি-নিষেধ থেকে শুরু করে নিয়মিত শরীরচর্চা। ওজন কমানো ছাড়াও নিয়ম...

Health Tips | স্বাস্থ্যের পাশাপাশি খেয়াল রাখে ত্বকের! কীভাবে খাবেন লেবু জল? দেখে নিন

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক:  প্রতিদিন লেবুর রস বা লেবু জল  অনেকেই খান। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাল্কা গরম জলে পাতিলেবুর রস আর মধু মিশিয়ে...

Saline Controversy | আরও বিপাকে জুনিয়ার চিকিৎসকেরা! স্যালাইন কাণ্ডের জেরে খুনের মামলা দায়ের করল CID

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: স্যালাইন কাণ্ডের (Saline Controversy) জেরে আরও বিপাকে সাসপেন্ড হওয়া ১২ জন চিকিৎসক (Doctors)! বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)...

Saif Ali Khan | ছয়বার ছুরিকাঘাত, সইফ’কে ‘টাইগার’ বলে সম্বোধন চিকিৎসকদের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ছয়বার ছুরিকাঘাত। তারপরও তাঁর জীবনশক্তি দেখে হতবাক চিকিৎসকরাই। হেঁটে, হাসিমুখে কথা বললেন সবার সঙ্গে। সইফ আলি খানকে (Saif Ali Khan)...

Most Popular