সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

বলির পাঁঠা

শেষ আপডেট:

  • অজিত ঘোষ

 

     কদম্ববাটী থানার দাপুটে আইসি হৃদয়জিৎ সামন্ত সমস্যায় পড়েছেন৷ একে-ওকে ফোন করে সমাধানের পথ খুঁজছেন৷ বারবার নিরাশ হচ্ছেন৷ আশা ছাড়ছেন না!

   প্রায় সব পরিচিতর নম্বর ডায়াল করে নিরাশ হওয়ার মুহূর্তে খুঁজে পেলেন চিবুককাটা মনিরুদ্দিনের নম্বর৷ লাউপাতা থানায় পোস্টিং থাকার সময় এক সিঁধকাটা চুরির কেসের আসামি ছিল মনিরুদ্দিন৷ বিচারক মনিরুদ্দিনকে সাতদিনের পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দেন৷ সেই সাতদিনে হৃদয়জিৎ জেনেছেন মনিরুদ্দিনের সাতকাহন৷ সাতকাহন না বলে সাতসমুদ্র বলা ভালো৷ কারণ এমন চোরের এত বৈচিত্র্যের কথা তিনি আগে শোনেননি৷ মনিরুদ্দিনের কাছেই জেনেছেন, প্রেস্টিজই পজিশন৷ প্রেস্টিজ ধরে রাখতে নিজের চিবুক নিজে কেটে মনিরুদ্দিন হয়েছিল, চিবুককাটা মনিরুদ্দিন৷ ওদের লাইনে একটা-দুটো কাটাকাটির দাগ না থাকলে নাকি পজিশন ধরে রাখা মুশকিল৷ তিন মাস জেল খেটে এসে মনিরুদ্দিন ওর ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল, যে কোনও সমস্যায় একটা ফোন করবেন৷ সঙ্গে সঙ্গে হাজির হব৷ রামের সমস্যায় যেমন হাজির হত হনুমান৷

     হৃদয়জিৎবাবু মনিরুদ্দিনের নম্বর ডায়াল করতে গিয়েও করলেন না৷ এত ছোট বিষয়ে ফোন করাটা ঠিক হবে না৷

    মধ্যরাত্রি৷ থানার চৌহদ্দি শুনসান৷ নদীর জলে ভাসছে পূর্ণিমার চাঁদ৷ এই পূর্ণিমাকে অমাবস্যার মতো মনে হচ্ছে হৃদয়জিতের৷ মনের আলো না জ্বললে চাঁদের আলো ফিকেই মনে হয়৷ চারদিকে যেন অন্ধকার৷

     এই অন্ধকারের উৎস সেদিনের সন্ধ্যা৷ সময়টা ঠিক সন্ধ্যা নয়, রাত্রি ন’টা হবে৷ থানায় বসে শুনছিলেন, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে…৷’ পরের গান, ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাবো না…’ শুনেই মনে পড়ল নিশিকান্তপুরের যাত্রাপালার কথা৷ ইস আর একটু হলেই মিস হয়ে যেত৷ যাত্রাপাগল আর মান্নাদের গানের অন্ধভক্ত গেয়ে উঠলেন, ‘না, না, না আজ রাতে আমি যাবো, যাবোই যাত্রা শুনতে৷’ ঝটপট কয়েকজন সিভিককে নিয়ে রওনা দিলেন নিশিকান্তপুর৷ ড্রাইভার সিধু জিপ স্টার্ট দিতেই হৃদয়জিৎ ধন্যবাদ দিলেন মান্না দে-কে৷

   জিপে বসেও ফুরফুরে মেজাজে গান গাইছিলেন৷ সবাই তাল মেলাচ্ছিল৷ হঠাৎ গান থামালেন হারানকে দেখে৷ হারান এই এলাকার বিখ্যাত ছিঁচকে চোর৷ পুরোনো জামাকাপড় থেকে কলপাড়ে ফেলে রাখা এঁটো বাসনপত্রও ওর চুরির তালিকায়৷ অবশ্য ওর এগেনস্টে এখন থানায় চুরির কেস নেই৷ তো কী হয়েছে! গরাদটাতো ফাঁকাই পড়ে আছে৷ ধরে দু’চারদিন পুরে রাখলেও তো থানার সম্মান বাড়বে৷

     এইসব ভেবে জিপ থামালেন হৃদয়জিৎ৷ সঙ্গে নামল সিভিক নিতাই৷ জোরালো টর্চের আলো হারানের মুখে ফেলে বললেন, ‘এত রাতে! কোথথেকে শুনি?’

    অতর্কিতে আইসির সাক্ষাৎ পাওয়া বাঘের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো৷ হারান বলল, ‘স্যর শ্বশুরবাড়ি গেছিলাম৷ পথে নিশিকান্তপুরের মেলায় একটু দেরি হয়ে গেল৷’

     ‘তা তো হবেই৷ তা বাছা সত্যি কথাটা বলো দেখি; কার সর্ব্বনাশ করে এলে?’

     ‘সত্যি বলছি স্যর৷ ওসব ছেড়ে দিয়েছি৷ ভদ্রলোকের মতো বাঁচতে বিয়ে করেছি৷ নতুন বৌয়ের দিব্যি৷’

     ‘মারব না এমন গাঁট্টা! মেয়েমানুষের দিব্যি খাওয়া বের করে দেব। সত্যি কথা বল৷’

     ‘মিথ্যে বলছি না স্যর৷’

     কিছুদিন আগে অবশ্য শুনেছিলেন হারান পুরোনো কাজ ছেড়ে সংসারে মন দিয়েছে৷ তাহলে মিথ্যে শোনেননি৷ তবুও পুলিশের মন৷ হাল ছাড়ার আগে টর্চের আলোটা হারানের মুখ থেকে গড়িয়ে নীচে নামালেন৷ নিরাশ হলেন৷ পুনরায় আলোটা হারানের বুক থেকে ডান হাত বরাবর গড়াতেই দেখলেন, হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা দড়ি৷ কিছু না বলে দড়ির পথ অনুসরণ করে দেখলেন শেষপ্রান্ত ঝুলছে একটি পাঁঠার গলায়৷ ব্যাস আর পায় কে! বললেন, ‘কী বাছাধন তুমি নাকি ভদ্রলোক হয়েছ? ভদ্রলোক হওয়া কি এতই সোজা? চলো সোনা, থানায় চলো৷ হাতেনাতে যখন ধরেছি৷ তিন মাস জেল হবেই৷’

    নিতাই পাঁঠা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হলে হারান বাধা দিয়ে বলল, ‘স্যর আপনি ভুল বুঝছেন৷ সত্যি বলছি, চুরি ছেড়ে দিয়েছি৷ চুরির মতো কাজ কী কারও সারাজীবন ভালো লাগে বলুন৷ পাঁঠা আমার নিজের।’

     ‘শোন, জ্ঞানের কথা বলবি না৷ তোকে হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় ছিলাম৷ সাধ পূরণ হল৷ ভদ্রলোক কী করে হতে হয়, থানায় গেলেই বুঝবি চল৷’

     ‘স্যর আমি সত্যিই ভদ্রলোক হয়েছি৷ সেজন্যইতো পদ্মাকে বিয়ে করলাম৷ পদ্মা খুব ভালো মেয়ে স্যর৷ ওই আমাকে বলেছে, এবার বাড়িতে একটা বলিপুজো দিয়ে মাকে সন্তুষ্ট করতে৷ তাতে নাকি পুরোনো পাপ মাফ করে দেন মা কালী৷ সেই আশাতেই তুলসিহাটায় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে এই পাঁঠাটা নিয়ে এলাম৷ বিশ্বাস করুন এই পাঁঠা চুরির নয়৷ আমার শ্বশুর শ্রীহরি বিশ্বাসের৷’

    যদি কোনও অপরাধী বারবার একই কথা বলে নিজের কথাকে সত্য প্রমাণের পয়েন্টে অনড় থাকে এবং বলার সময় যদি তার মুখ লালায় ভরে যায় তাহলে বুঝতে হবে অপরাধী সত্যি বলছে৷ পুলিশের লাইনে এই অভিজ্ঞতা হৃদয়জিতের হয়েছে৷ তাছাড়া প্রমাণের আগে কাউকে অপরাধী বলা যায় না৷

     সুর নরম করে বললেন, ‘আচ্ছা হারান একবার হাঁ কর তো দেখি৷’

     হারান কী বুঝল সেই জানে! হাঁ করল৷

     হাঁ-মুখে আলো ফেলে হৃদয়জিৎ দেখলেন, লালায় ভর্তি৷ আলজিভটা জবজবে রসে ডুবে আছে৷

    নিরাশ হলেন৷ বার বার নিরাশ হলে সিগারেটের সংখ্যা বাড়ে৷ মনে পড়ল মায়ের কথা— তোর নাম হৃদয়জিৎ৷ ন্যায়-অন্যায় হৃদয় দিয়ে বিচার করবি৷

    ততক্ষণে নিতাই দড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে৷ পৃথিবীর এই এক অমোঘ নীতি, দড়ি যার পাঁঠা তার৷ হৃদয়জিৎ নিতাইকে দড়ি ফিরিয়ে দিতে বললেন৷ সিগারেট শেষ করে হারানের কাঁধে হাত রেখে গার্জিয়ানের মতো বললেন, ‘মানলাম পাঁঠা তোর কিন্তু কি জানিস আমি তো পুলিশ৷ পুলিশের একটা ধর্ম আছে৷ সেই ধর্ম অনুযায়ী পাঁঠা সাতদিন থানায় থাকবে৷ থানার পক্ষ থেকে পত্রিকায় পাঁঠার বিবরণ ও ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে৷ যদি সাতদিনের মধ্যে পাঁঠার দাবিদার না মেলে বা কারও পাঁঠা চুরির অভিযোগ থানায় জমা না পড়ে তাহলে তুই পাঁঠা ফেরত পাবি৷’

     সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই! পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও পাঁঠার দাবিদার মেলেনি৷ পাঁঠা চুরির অভিযোগ জানাতে কেউ থানায় আসেনি৷ মাঝখান থেকে এক তরুণ সাংবাদিক ছোকরা এসে বুদ্ধি দিল হৃদয়জিৎকে, ‘একবার যখন পাঁঠা থানায় এসেই গেছে তখন পাঁঠার সদগতি না করে ছাড়বেন না স্যর৷ এ নিশ্চয়ই মায়ের ইচ্ছে৷’

    ‘কোন মা?’

    ‘কেন থানার মা! মা কালী৷ অনেক দিন পুজো বন্ধ আছে৷ ক’দিন পরেই কালীপুজো৷ নতুন করে পুজো দিন৷ বলি দিয়ে মা কালীকে খুশি করুন৷ মা-ভক্তদের পাঁঠার মাংসের প্রসাদ খাইয়ে নিজের ক্ষমতাটাকেও জাহির করুন৷ লিস্টে আমার নামটাও রাখবেন স্যর৷ কচি পাঁঠা… জগতে এর স্বাদের তুলনা হয় নাকি?’

    তারপর থেকেই দোটানায় পড়েছেন হৃদয়জিৎ৷ সাংবাদিক ছোকরার পরামর্শে কালীপুজোর আয়োজন করে ফেলেছেন৷ পুরোনো মন্দির ইতিমধ্যেই রং করা হয়েছে৷ জোরকদমে প্রতিমা তৈরিও চলছে৷ মন্দির আর তৈরি হওয়া প্রতিমা দেখলে যে মুখটা আলোয় ভরে যাচ্ছে, সেই মুখই অন্ধকারে ডুবছে হারানকে দেখলে৷

   সাদা ধবধবে পাঁঠা৷ কোথাও একটুও অন্য রংয়ের ছিটে নেই৷ এই পাঁঠা বলি দিলে নাকি মনস্কামনা পূরণ হয়৷ হারান প্রতিদিন সকালে এসে পাঁঠা দেখে যাচ্ছে আর বলছে সেকথা৷ তার উঠোনেও কালী প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে৷ সব ঠিকঠাক সম্পূর্ণ হলে ভদ্রলোক হওয়া থেকে তাকে কে আটকায়!

    এদিকে পাঁচদিন পার হয়েছে৷ কী যে হবে! দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়েছে হৃদয়জিতের৷ ভাবছেন, যার পাঁঠা তাকে দিয়ে প্রয়োজনে নতুন পাঁঠা কিনে থানার কালীপুজো সারবেন৷ আবার ভাবছেন, পাঁঠা বড় কথা নয়, বড় কথা প্রেস্টিজ৷ এইসব ছোটখাটো সমস্যা চুটকিতে সমাধান না করতে পারলে কীসের আইসি তিনি৷ আবার মাঝে মাঝে সমস্ত দোষ দিচ্ছেন ওই চ্যাংড়া সাংবাদিককে৷ শালা সাংবাদিক না পার্টির মুখপাত্র! বদবুদ্ধির ঢেঁকি৷

                     যুবতী চাঁদ ঢলে পড়ছে পশ্চিমে৷ হারানের চোখে ঘুম নেই৷ মটকা মেরে পড়ে থেকেও লাভ হল না৷ উঠে বসল৷ ঢক ঢক করে দু’গ্লাস জল গলায় ঢেলে বিড়ি ধরাল৷ হাবিজাবি চিন্তা মাথায় জট পাকাচ্ছে৷ ‘ধুর শালা’ বলে অর্ধেক বিড়ি ফেলে পদ্মাকে ডাকল ‘পদ্মা, ও পদ্মা৷’

     পদ্মা বলল, ‘আমি তো বলেছি, বাবাকে বলব৷ আরেকটি পাঁঠার ব্যবস্থা ঠিক করে দেবে৷ আমার কথা বাবা ফেলতে পারবে না৷ এখন তো ঘুমাও৷’

     ‘না রে ঘুম আসছে না৷ নতুন পাঁঠা না হয় তোর বাবা দেবে কিন্তু আমার লড়াইয়ের কী হবে? আমি যে ভদ্রলোক হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছি৷ হার মানব কেন? তাছাড়া পাঁঠা আমার৷ আমি নিয়েই ছাড়ব৷’

    ‘লড়াই, লড়াই করছ৷ বলি, সব লড়াই কি সবাই জেতে? থানাপুলিশের হাতে যখন পড়েছে তখন ওই পাঁঠার মায়া ছেড়ে দাও, বুঝলে৷’

     ‘সাধে কী আর করছি! মায়ের পুজো দেব৷ পাঁঠা নয় নিজের ভেতরের চোরটাকে বলি দিয়ে মাথা তুলে বাঁচব৷ সেজন্যই তো পাঁঠাটা তোর বাবার কাছে চেয়েছিলাম৷ উনি দিলেনও৷ কিন্তু ওই শালা হৃদয়জিৎ কেড়ে নিল৷ ছাড়ব না৷ পাঁঠা আমার চাই-ই চাই৷’

                    থানার ফুলবাগানের পাশে কাঁঠালপাতা চিবোচ্ছে পাঁঠা৷ খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে আর গায়েগতরে ফুলছে৷ বোঝা যাচ্ছে ক’দিনেই ওজন বেড়েছে৷ পাঁঠা হচ্ছে ছেলে ছাগল৷ কিন্তু অনায়াসে সুখী রমণীর সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ সুখী রমণীও গায়েগতরে ফুলেফেঁপে ওঠে৷

     মনে মনে তুলনাটা করে ফিক করে হাসলেন হৃদয়জিৎ৷ দু’দিন আগেও তিনি হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন৷ এখন বেশ হাসছেন৷ বুদ্ধি একটু এদিক-ওদিক করলেই হাসি কে আটকায়৷ একঢিলে দুই পাখি মারার বুদ্ধি ঠিকঠাক মগজে খেলে গেলে যৌবনের মতো হাসিও ধরে রাখা সহজ৷ আজ সন্ধেতেই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে৷ মুক্তিদাতা রতন তান্ত্রিক৷ আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা৷ তারপরই সন্ধ্যা৷ সমস্যা ফুড়ুত…

    হাসতে হাসতেই জিপের দিকে এগোলেন৷ যাবেন চম্পাপুরে৷ সেখানে একই দলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে এলাকার মানুষের ঘুম উড়েছে৷ শালা, ভাগ-ভাগ করে দুনিয়াটা শেষ হয়ে গেল!

              কাশীপুর শ্মশানের রতন তান্ত্রিককে এলাকার সবাই চেনে৷ রতনের বয়স কত? সে নিজেও না৷ এখনও খালি গায়ে থাকার অভ্যেসটা আছে৷ লম্বা চেহারার ছিপছিপে রতন মাঝে মাঝে, ‘মা, মা…’ বলে গর্জন ছাড়ে৷ মাটি কেঁপে ওঠে৷ তান্ত্রিক হলেও রতন তন্ত্রমন্ত্রের ধার ধারেন না৷ মানুষকে সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দেন৷ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন বুদ্ধি৷ লোকে ওকে ‘বুদ্ধিতান্ত্রিক’ বলেও চেনে৷

    নদীর ধারের পুরোনো বটগাছের নীচে সন্ধেবেলায় এসে হাজির রতন৷ বসেছে লালশালুর ওপর৷ দু’চোখ বন্ধ৷ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চোখ খুলবেন না৷ রতনকে চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখে ভরসা পেলেন হৃদয়জিৎ৷ ভরসা অবশ্য আগে থেকেই ছিল৷

     হারান-পদ্মার মুখেও ভরসার আলো৷ বুদ্ধিতান্ত্রিকের কাছে ছোট-বড় নেই৷ সবাই সমান৷ চারজনের সভায় হৃদয়জিৎই শুরু করলেন, ‘‘বাবা, এবার তাহলে শুরু করা যাক৷ দেরি করে লাভ কী! হাতে মাত্র কয়েকটি দিন৷ প্রতিমার গায়ে রঙের পোঁচ পড়েছে৷ মন্দিরও সেজে উঠেছে৷ এবার হারান ‘হ্যাঁ’ করলেই শুভকাজ সম্পন্ন করতে পারি৷’’

   রতন তান্ত্রিক চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন, ‘শুভকাজে হারান না বলার কে? এত বড় বুকের পাটা?’

    ভয় পেতে পেতে একসময় মানুষ ভয়কেই জয় করে ফেলে৷ হারান বলল, ‘পাঁঠা আমার৷ আপনাকে প্রণাম জানিয়ে বলতে চাই— আমি পাঁঠা ফেরত চাই৷ পুজোর আয়োজন আমিও করেছি৷ এই আশা আমার অনেক দিনের বাবা৷’

    প্রমাদ গুনলেন হৃদয়জিৎ৷ মনে পড়ল মনিরুদ্দিনের কথা, প্রেস্টিজই পজিশন৷ বললেন,  ‘আজেবাজে কথায় সময় নষ্ট করা কি ঠিক হবে! চম্পাপুরে যে কোনও সময় বোমাবাজি শুরু হতে পারে৷ ওপর মহল তেমনই আন্দাজ করছে৷ আমাকে সব সময় রেডি থাকতে বলা হয়েছে৷’

   সমস্যা সমাধানের পথে এলে রতন তান্ত্রিক উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন৷ হাসতে হাসতে বললেন, ‘মা এক৷ দুজনেই পুজো করবি! তা কর না, মায়ের কোনও সমস্যা নেই৷ সমস্যা তোদের৷ আর তোদের সমস্যার মূলে একটি পাঁঠা— সবই মায়ের ছলনা৷ একজন বলি দে ওই শালাকে, অন্যজন দে চালকুমড়ো৷ শাস্ত্রে আছে চালকুমড়ো বলি দিলে মা একযুগ প্রসন্ন থাকেন৷ তবে একযুগের অপেক্ষা করার কী দরকার! সামনের বছর না হয় দুটো পাঁঠার জোগাড় করা যাবে৷’

    হৃদয়জিৎ ভরসা পেলেন৷ চোখের সামনে ভেসে উঠল থানার পুজো৷ বলির পাঁঠাকে স্নান করানো হয়েছে৷ ঢাকের আওয়াজে থানা চত্বর গমগম করছে৷ মাইকে বাজছে শ্যামাসংগীত ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে…’ না, না, ‘সকলই তোমার ইচ্ছে, চিন্তাময়ী তারা তুমি…৷’

    মনে মনে মা কালীকে প্রণাম ঠুকে বললেন, ‘আমার কোনও সমস্যা নেই বাবা৷ সবই মায়ের ইচ্ছে৷ শাস্ত্রে যখন চালকুমড়ো বলি সিদ্ধ তখন তো আর সমস্যাই রইল না৷ হারান তবে চালকুমড়োই বলি দিক৷ সামনের বছর না হয়…’

     ‘তাহলে আমার পাঁঠা আমি নিয়ে যাই৷ থানার পুজোতে এবারটা চালকুমড়ো বলিই হোক৷’ হৃদয়জিৎকে থামিয়ে বলল হারান৷

    বেগতিক বুঝল তান্ত্রিক৷ হারানকে থামিয়ে হৃদয়জিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ ওঁকে থামিয়ে বলল, ‘বুঝেছি, তোদের দুজনকে আমি বুঝেছি৷ এবার আমার কাজ আমায় করতে দে৷ ওই পাঁঠা আমি নিয়ে যাব৷ কাল সকালে নদীর ঘাট থেকে যে রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে, একটি গিয়েছে গ্রামের দিকে, অন্যটি থানার দিকে, ঠিক সেখানে ছেড়ে দেব৷ পাঁঠা যদি থানার দিকে যায় তবে পাঁঠার বলি পাবে থানার মা৷ আর যদি গ্রামের রাস্তা ধরে তবে পাঁঠা হারানের মায়ের৷ এরপর নিশ্চয় তোদের কোনও সমস্যা থাকবে না৷ যে কালীর পাঁঠা সেই কালীই বুঝে নিক৷ ব্যোম তারা, ব্যোম তারা, জগতে সব ছন্নছাড়া৷ মা… মা…’

    ‘মা নিশ্চয় আমায় ভদ্রলোক হওয়া থেকে বঞ্চিত করবে না’, অস্ফুট উচ্চারণ করল হারান৷

    হৃদয়জিৎ ভালোমন্দ কিছু বুঝলেন না! ওঁর কেবলই মনে হতে লাগল, রাতের মধ্যেই মনিরুদ্দিনকে ফোন করতে হবে৷ একমাত্র সে-ই পারতে পারে পাঁঠাকে থানার পথ চেনাতে৷

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতার কথা

পূর্বা সেনগুপ্ত   তখন বৈষ্ণবদের ভক্তির রসে আপ্লুত, তন্ত্রের আচারে...

দীপার পাত্র

জয়ন্ত দে             দ্যুতিমানকে দুশ্চরিত্র কোন শালা বলে। দ্যুতিমান ভগবান...

শাপলা

মনোনীতা চক্রবর্তী             আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে  স্বচ্ছতোয়া। আরও...

১ আনমনা   সুব্রতা ঘোষ রায়    বসন্ত এসেছিল পলাশের ডালে, আনমনা মেয়ে তার কোন ব‍্যথা...