- অজিত ঘোষ
কদম্ববাটী থানার দাপুটে আইসি হৃদয়জিৎ সামন্ত সমস্যায় পড়েছেন৷ একে-ওকে ফোন করে সমাধানের পথ খুঁজছেন৷ বারবার নিরাশ হচ্ছেন৷ আশা ছাড়ছেন না!
প্রায় সব পরিচিতর নম্বর ডায়াল করে নিরাশ হওয়ার মুহূর্তে খুঁজে পেলেন চিবুককাটা মনিরুদ্দিনের নম্বর৷ লাউপাতা থানায় পোস্টিং থাকার সময় এক সিঁধকাটা চুরির কেসের আসামি ছিল মনিরুদ্দিন৷ বিচারক মনিরুদ্দিনকে সাতদিনের পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দেন৷ সেই সাতদিনে হৃদয়জিৎ জেনেছেন মনিরুদ্দিনের সাতকাহন৷ সাতকাহন না বলে সাতসমুদ্র বলা ভালো৷ কারণ এমন চোরের এত বৈচিত্র্যের কথা তিনি আগে শোনেননি৷ মনিরুদ্দিনের কাছেই জেনেছেন, প্রেস্টিজই পজিশন৷ প্রেস্টিজ ধরে রাখতে নিজের চিবুক নিজে কেটে মনিরুদ্দিন হয়েছিল, চিবুককাটা মনিরুদ্দিন৷ ওদের লাইনে একটা-দুটো কাটাকাটির দাগ না থাকলে নাকি পজিশন ধরে রাখা মুশকিল৷ তিন মাস জেল খেটে এসে মনিরুদ্দিন ওর ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল, যে কোনও সমস্যায় একটা ফোন করবেন৷ সঙ্গে সঙ্গে হাজির হব৷ রামের সমস্যায় যেমন হাজির হত হনুমান৷
হৃদয়জিৎবাবু মনিরুদ্দিনের নম্বর ডায়াল করতে গিয়েও করলেন না৷ এত ছোট বিষয়ে ফোন করাটা ঠিক হবে না৷
মধ্যরাত্রি৷ থানার চৌহদ্দি শুনসান৷ নদীর জলে ভাসছে পূর্ণিমার চাঁদ৷ এই পূর্ণিমাকে অমাবস্যার মতো মনে হচ্ছে হৃদয়জিতের৷ মনের আলো না জ্বললে চাঁদের আলো ফিকেই মনে হয়৷ চারদিকে যেন অন্ধকার৷
এই অন্ধকারের উৎস সেদিনের সন্ধ্যা৷ সময়টা ঠিক সন্ধ্যা নয়, রাত্রি ন’টা হবে৷ থানায় বসে শুনছিলেন, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে…৷’ পরের গান, ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাবো না…’ শুনেই মনে পড়ল নিশিকান্তপুরের যাত্রাপালার কথা৷ ইস আর একটু হলেই মিস হয়ে যেত৷ যাত্রাপাগল আর মান্নাদের গানের অন্ধভক্ত গেয়ে উঠলেন, ‘না, না, না আজ রাতে আমি যাবো, যাবোই যাত্রা শুনতে৷’ ঝটপট কয়েকজন সিভিককে নিয়ে রওনা দিলেন নিশিকান্তপুর৷ ড্রাইভার সিধু জিপ স্টার্ট দিতেই হৃদয়জিৎ ধন্যবাদ দিলেন মান্না দে-কে৷
জিপে বসেও ফুরফুরে মেজাজে গান গাইছিলেন৷ সবাই তাল মেলাচ্ছিল৷ হঠাৎ গান থামালেন হারানকে দেখে৷ হারান এই এলাকার বিখ্যাত ছিঁচকে চোর৷ পুরোনো জামাকাপড় থেকে কলপাড়ে ফেলে রাখা এঁটো বাসনপত্রও ওর চুরির তালিকায়৷ অবশ্য ওর এগেনস্টে এখন থানায় চুরির কেস নেই৷ তো কী হয়েছে! গরাদটাতো ফাঁকাই পড়ে আছে৷ ধরে দু’চারদিন পুরে রাখলেও তো থানার সম্মান বাড়বে৷
এইসব ভেবে জিপ থামালেন হৃদয়জিৎ৷ সঙ্গে নামল সিভিক নিতাই৷ জোরালো টর্চের আলো হারানের মুখে ফেলে বললেন, ‘এত রাতে! কোথথেকে শুনি?’
অতর্কিতে আইসির সাক্ষাৎ পাওয়া বাঘের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো৷ হারান বলল, ‘স্যর শ্বশুরবাড়ি গেছিলাম৷ পথে নিশিকান্তপুরের মেলায় একটু দেরি হয়ে গেল৷’
‘তা তো হবেই৷ তা বাছা সত্যি কথাটা বলো দেখি; কার সর্ব্বনাশ করে এলে?’
‘সত্যি বলছি স্যর৷ ওসব ছেড়ে দিয়েছি৷ ভদ্রলোকের মতো বাঁচতে বিয়ে করেছি৷ নতুন বৌয়ের দিব্যি৷’
‘মারব না এমন গাঁট্টা! মেয়েমানুষের দিব্যি খাওয়া বের করে দেব। সত্যি কথা বল৷’
‘মিথ্যে বলছি না স্যর৷’
কিছুদিন আগে অবশ্য শুনেছিলেন হারান পুরোনো কাজ ছেড়ে সংসারে মন দিয়েছে৷ তাহলে মিথ্যে শোনেননি৷ তবুও পুলিশের মন৷ হাল ছাড়ার আগে টর্চের আলোটা হারানের মুখ থেকে গড়িয়ে নীচে নামালেন৷ নিরাশ হলেন৷ পুনরায় আলোটা হারানের বুক থেকে ডান হাত বরাবর গড়াতেই দেখলেন, হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা দড়ি৷ কিছু না বলে দড়ির পথ অনুসরণ করে দেখলেন শেষপ্রান্ত ঝুলছে একটি পাঁঠার গলায়৷ ব্যাস আর পায় কে! বললেন, ‘কী বাছাধন তুমি নাকি ভদ্রলোক হয়েছ? ভদ্রলোক হওয়া কি এতই সোজা? চলো সোনা, থানায় চলো৷ হাতেনাতে যখন ধরেছি৷ তিন মাস জেল হবেই৷’
নিতাই পাঁঠা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হলে হারান বাধা দিয়ে বলল, ‘স্যর আপনি ভুল বুঝছেন৷ সত্যি বলছি, চুরি ছেড়ে দিয়েছি৷ চুরির মতো কাজ কী কারও সারাজীবন ভালো লাগে বলুন৷ পাঁঠা আমার নিজের।’
‘শোন, জ্ঞানের কথা বলবি না৷ তোকে হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় ছিলাম৷ সাধ পূরণ হল৷ ভদ্রলোক কী করে হতে হয়, থানায় গেলেই বুঝবি চল৷’
‘স্যর আমি সত্যিই ভদ্রলোক হয়েছি৷ সেজন্যইতো পদ্মাকে বিয়ে করলাম৷ পদ্মা খুব ভালো মেয়ে স্যর৷ ওই আমাকে বলেছে, এবার বাড়িতে একটা বলিপুজো দিয়ে মাকে সন্তুষ্ট করতে৷ তাতে নাকি পুরোনো পাপ মাফ করে দেন মা কালী৷ সেই আশাতেই তুলসিহাটায় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে এই পাঁঠাটা নিয়ে এলাম৷ বিশ্বাস করুন এই পাঁঠা চুরির নয়৷ আমার শ্বশুর শ্রীহরি বিশ্বাসের৷’
যদি কোনও অপরাধী বারবার একই কথা বলে নিজের কথাকে সত্য প্রমাণের পয়েন্টে অনড় থাকে এবং বলার সময় যদি তার মুখ লালায় ভরে যায় তাহলে বুঝতে হবে অপরাধী সত্যি বলছে৷ পুলিশের লাইনে এই অভিজ্ঞতা হৃদয়জিতের হয়েছে৷ তাছাড়া প্রমাণের আগে কাউকে অপরাধী বলা যায় না৷
সুর নরম করে বললেন, ‘আচ্ছা হারান একবার হাঁ কর তো দেখি৷’
হারান কী বুঝল সেই জানে! হাঁ করল৷
হাঁ-মুখে আলো ফেলে হৃদয়জিৎ দেখলেন, লালায় ভর্তি৷ আলজিভটা জবজবে রসে ডুবে আছে৷
নিরাশ হলেন৷ বার বার নিরাশ হলে সিগারেটের সংখ্যা বাড়ে৷ মনে পড়ল মায়ের কথা— তোর নাম হৃদয়জিৎ৷ ন্যায়-অন্যায় হৃদয় দিয়ে বিচার করবি৷
ততক্ষণে নিতাই দড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে৷ পৃথিবীর এই এক অমোঘ নীতি, দড়ি যার পাঁঠা তার৷ হৃদয়জিৎ নিতাইকে দড়ি ফিরিয়ে দিতে বললেন৷ সিগারেট শেষ করে হারানের কাঁধে হাত রেখে গার্জিয়ানের মতো বললেন, ‘মানলাম পাঁঠা তোর কিন্তু কি জানিস আমি তো পুলিশ৷ পুলিশের একটা ধর্ম আছে৷ সেই ধর্ম অনুযায়ী পাঁঠা সাতদিন থানায় থাকবে৷ থানার পক্ষ থেকে পত্রিকায় পাঁঠার বিবরণ ও ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে৷ যদি সাতদিনের মধ্যে পাঁঠার দাবিদার না মেলে বা কারও পাঁঠা চুরির অভিযোগ থানায় জমা না পড়ে তাহলে তুই পাঁঠা ফেরত পাবি৷’
সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই! পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও পাঁঠার দাবিদার মেলেনি৷ পাঁঠা চুরির অভিযোগ জানাতে কেউ থানায় আসেনি৷ মাঝখান থেকে এক তরুণ সাংবাদিক ছোকরা এসে বুদ্ধি দিল হৃদয়জিৎকে, ‘একবার যখন পাঁঠা থানায় এসেই গেছে তখন পাঁঠার সদগতি না করে ছাড়বেন না স্যর৷ এ নিশ্চয়ই মায়ের ইচ্ছে৷’
‘কোন মা?’
‘কেন থানার মা! মা কালী৷ অনেক দিন পুজো বন্ধ আছে৷ ক’দিন পরেই কালীপুজো৷ নতুন করে পুজো দিন৷ বলি দিয়ে মা কালীকে খুশি করুন৷ মা-ভক্তদের পাঁঠার মাংসের প্রসাদ খাইয়ে নিজের ক্ষমতাটাকেও জাহির করুন৷ লিস্টে আমার নামটাও রাখবেন স্যর৷ কচি পাঁঠা… জগতে এর স্বাদের তুলনা হয় নাকি?’
তারপর থেকেই দোটানায় পড়েছেন হৃদয়জিৎ৷ সাংবাদিক ছোকরার পরামর্শে কালীপুজোর আয়োজন করে ফেলেছেন৷ পুরোনো মন্দির ইতিমধ্যেই রং করা হয়েছে৷ জোরকদমে প্রতিমা তৈরিও চলছে৷ মন্দির আর তৈরি হওয়া প্রতিমা দেখলে যে মুখটা আলোয় ভরে যাচ্ছে, সেই মুখই অন্ধকারে ডুবছে হারানকে দেখলে৷
সাদা ধবধবে পাঁঠা৷ কোথাও একটুও অন্য রংয়ের ছিটে নেই৷ এই পাঁঠা বলি দিলে নাকি মনস্কামনা পূরণ হয়৷ হারান প্রতিদিন সকালে এসে পাঁঠা দেখে যাচ্ছে আর বলছে সেকথা৷ তার উঠোনেও কালী প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে৷ সব ঠিকঠাক সম্পূর্ণ হলে ভদ্রলোক হওয়া থেকে তাকে কে আটকায়!
এদিকে পাঁচদিন পার হয়েছে৷ কী যে হবে! দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়েছে হৃদয়জিতের৷ ভাবছেন, যার পাঁঠা তাকে দিয়ে প্রয়োজনে নতুন পাঁঠা কিনে থানার কালীপুজো সারবেন৷ আবার ভাবছেন, পাঁঠা বড় কথা নয়, বড় কথা প্রেস্টিজ৷ এইসব ছোটখাটো সমস্যা চুটকিতে সমাধান না করতে পারলে কীসের আইসি তিনি৷ আবার মাঝে মাঝে সমস্ত দোষ দিচ্ছেন ওই চ্যাংড়া সাংবাদিককে৷ শালা সাংবাদিক না পার্টির মুখপাত্র! বদবুদ্ধির ঢেঁকি৷
যুবতী চাঁদ ঢলে পড়ছে পশ্চিমে৷ হারানের চোখে ঘুম নেই৷ মটকা মেরে পড়ে থেকেও লাভ হল না৷ উঠে বসল৷ ঢক ঢক করে দু’গ্লাস জল গলায় ঢেলে বিড়ি ধরাল৷ হাবিজাবি চিন্তা মাথায় জট পাকাচ্ছে৷ ‘ধুর শালা’ বলে অর্ধেক বিড়ি ফেলে পদ্মাকে ডাকল ‘পদ্মা, ও পদ্মা৷’
পদ্মা বলল, ‘আমি তো বলেছি, বাবাকে বলব৷ আরেকটি পাঁঠার ব্যবস্থা ঠিক করে দেবে৷ আমার কথা বাবা ফেলতে পারবে না৷ এখন তো ঘুমাও৷’
‘না রে ঘুম আসছে না৷ নতুন পাঁঠা না হয় তোর বাবা দেবে কিন্তু আমার লড়াইয়ের কী হবে? আমি যে ভদ্রলোক হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছি৷ হার মানব কেন? তাছাড়া পাঁঠা আমার৷ আমি নিয়েই ছাড়ব৷’
‘লড়াই, লড়াই করছ৷ বলি, সব লড়াই কি সবাই জেতে? থানাপুলিশের হাতে যখন পড়েছে তখন ওই পাঁঠার মায়া ছেড়ে দাও, বুঝলে৷’
‘সাধে কী আর করছি! মায়ের পুজো দেব৷ পাঁঠা নয় নিজের ভেতরের চোরটাকে বলি দিয়ে মাথা তুলে বাঁচব৷ সেজন্যই তো পাঁঠাটা তোর বাবার কাছে চেয়েছিলাম৷ উনি দিলেনও৷ কিন্তু ওই শালা হৃদয়জিৎ কেড়ে নিল৷ ছাড়ব না৷ পাঁঠা আমার চাই-ই চাই৷’
থানার ফুলবাগানের পাশে কাঁঠালপাতা চিবোচ্ছে পাঁঠা৷ খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে আর গায়েগতরে ফুলছে৷ বোঝা যাচ্ছে ক’দিনেই ওজন বেড়েছে৷ পাঁঠা হচ্ছে ছেলে ছাগল৷ কিন্তু অনায়াসে সুখী রমণীর সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ সুখী রমণীও গায়েগতরে ফুলেফেঁপে ওঠে৷
মনে মনে তুলনাটা করে ফিক করে হাসলেন হৃদয়জিৎ৷ দু’দিন আগেও তিনি হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন৷ এখন বেশ হাসছেন৷ বুদ্ধি একটু এদিক-ওদিক করলেই হাসি কে আটকায়৷ একঢিলে দুই পাখি মারার বুদ্ধি ঠিকঠাক মগজে খেলে গেলে যৌবনের মতো হাসিও ধরে রাখা সহজ৷ আজ সন্ধেতেই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে৷ মুক্তিদাতা রতন তান্ত্রিক৷ আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা৷ তারপরই সন্ধ্যা৷ সমস্যা ফুড়ুত…
হাসতে হাসতেই জিপের দিকে এগোলেন৷ যাবেন চম্পাপুরে৷ সেখানে একই দলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে এলাকার মানুষের ঘুম উড়েছে৷ শালা, ভাগ-ভাগ করে দুনিয়াটা শেষ হয়ে গেল!
কাশীপুর শ্মশানের রতন তান্ত্রিককে এলাকার সবাই চেনে৷ রতনের বয়স কত? সে নিজেও না৷ এখনও খালি গায়ে থাকার অভ্যেসটা আছে৷ লম্বা চেহারার ছিপছিপে রতন মাঝে মাঝে, ‘মা, মা…’ বলে গর্জন ছাড়ে৷ মাটি কেঁপে ওঠে৷ তান্ত্রিক হলেও রতন তন্ত্রমন্ত্রের ধার ধারেন না৷ মানুষকে সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দেন৷ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন বুদ্ধি৷ লোকে ওকে ‘বুদ্ধিতান্ত্রিক’ বলেও চেনে৷
নদীর ধারের পুরোনো বটগাছের নীচে সন্ধেবেলায় এসে হাজির রতন৷ বসেছে লালশালুর ওপর৷ দু’চোখ বন্ধ৷ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চোখ খুলবেন না৷ রতনকে চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখে ভরসা পেলেন হৃদয়জিৎ৷ ভরসা অবশ্য আগে থেকেই ছিল৷
হারান-পদ্মার মুখেও ভরসার আলো৷ বুদ্ধিতান্ত্রিকের কাছে ছোট-বড় নেই৷ সবাই সমান৷ চারজনের সভায় হৃদয়জিৎই শুরু করলেন, ‘‘বাবা, এবার তাহলে শুরু করা যাক৷ দেরি করে লাভ কী! হাতে মাত্র কয়েকটি দিন৷ প্রতিমার গায়ে রঙের পোঁচ পড়েছে৷ মন্দিরও সেজে উঠেছে৷ এবার হারান ‘হ্যাঁ’ করলেই শুভকাজ সম্পন্ন করতে পারি৷’’
রতন তান্ত্রিক চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন, ‘শুভকাজে হারান না বলার কে? এত বড় বুকের পাটা?’
ভয় পেতে পেতে একসময় মানুষ ভয়কেই জয় করে ফেলে৷ হারান বলল, ‘পাঁঠা আমার৷ আপনাকে প্রণাম জানিয়ে বলতে চাই— আমি পাঁঠা ফেরত চাই৷ পুজোর আয়োজন আমিও করেছি৷ এই আশা আমার অনেক দিনের বাবা৷’
প্রমাদ গুনলেন হৃদয়জিৎ৷ মনে পড়ল মনিরুদ্দিনের কথা, প্রেস্টিজই পজিশন৷ বললেন, ‘আজেবাজে কথায় সময় নষ্ট করা কি ঠিক হবে! চম্পাপুরে যে কোনও সময় বোমাবাজি শুরু হতে পারে৷ ওপর মহল তেমনই আন্দাজ করছে৷ আমাকে সব সময় রেডি থাকতে বলা হয়েছে৷’
সমস্যা সমাধানের পথে এলে রতন তান্ত্রিক উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন৷ হাসতে হাসতে বললেন, ‘মা এক৷ দুজনেই পুজো করবি! তা কর না, মায়ের কোনও সমস্যা নেই৷ সমস্যা তোদের৷ আর তোদের সমস্যার মূলে একটি পাঁঠা— সবই মায়ের ছলনা৷ একজন বলি দে ওই শালাকে, অন্যজন দে চালকুমড়ো৷ শাস্ত্রে আছে চালকুমড়ো বলি দিলে মা একযুগ প্রসন্ন থাকেন৷ তবে একযুগের অপেক্ষা করার কী দরকার! সামনের বছর না হয় দুটো পাঁঠার জোগাড় করা যাবে৷’
হৃদয়জিৎ ভরসা পেলেন৷ চোখের সামনে ভেসে উঠল থানার পুজো৷ বলির পাঁঠাকে স্নান করানো হয়েছে৷ ঢাকের আওয়াজে থানা চত্বর গমগম করছে৷ মাইকে বাজছে শ্যামাসংগীত ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে…’ না, না, ‘সকলই তোমার ইচ্ছে, চিন্তাময়ী তারা তুমি…৷’
মনে মনে মা কালীকে প্রণাম ঠুকে বললেন, ‘আমার কোনও সমস্যা নেই বাবা৷ সবই মায়ের ইচ্ছে৷ শাস্ত্রে যখন চালকুমড়ো বলি সিদ্ধ তখন তো আর সমস্যাই রইল না৷ হারান তবে চালকুমড়োই বলি দিক৷ সামনের বছর না হয়…’
‘তাহলে আমার পাঁঠা আমি নিয়ে যাই৷ থানার পুজোতে এবারটা চালকুমড়ো বলিই হোক৷’ হৃদয়জিৎকে থামিয়ে বলল হারান৷
বেগতিক বুঝল তান্ত্রিক৷ হারানকে থামিয়ে হৃদয়জিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ ওঁকে থামিয়ে বলল, ‘বুঝেছি, তোদের দুজনকে আমি বুঝেছি৷ এবার আমার কাজ আমায় করতে দে৷ ওই পাঁঠা আমি নিয়ে যাব৷ কাল সকালে নদীর ঘাট থেকে যে রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে, একটি গিয়েছে গ্রামের দিকে, অন্যটি থানার দিকে, ঠিক সেখানে ছেড়ে দেব৷ পাঁঠা যদি থানার দিকে যায় তবে পাঁঠার বলি পাবে থানার মা৷ আর যদি গ্রামের রাস্তা ধরে তবে পাঁঠা হারানের মায়ের৷ এরপর নিশ্চয় তোদের কোনও সমস্যা থাকবে না৷ যে কালীর পাঁঠা সেই কালীই বুঝে নিক৷ ব্যোম তারা, ব্যোম তারা, জগতে সব ছন্নছাড়া৷ মা… মা…’
‘মা নিশ্চয় আমায় ভদ্রলোক হওয়া থেকে বঞ্চিত করবে না’, অস্ফুট উচ্চারণ করল হারান৷
হৃদয়জিৎ ভালোমন্দ কিছু বুঝলেন না! ওঁর কেবলই মনে হতে লাগল, রাতের মধ্যেই মনিরুদ্দিনকে ফোন করতে হবে৷ একমাত্র সে-ই পারতে পারে পাঁঠাকে থানার পথ চেনাতে৷