সব্যসাচী সরকার
১
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে জোরে, আরও জোরে কলের নবটা খুলে দিচ্ছিল রাই। ভাবছিল, সব পাপ ধুয়ে সাফ হয়ে যাক। এতদিন যা যা পাপ সে করেছে। নিশ্চয়ই করেছে। না হলে তার সঙ্গেই কেন এমন হবে? দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। বাথরুমে একা একা কান্নার মধ্যে কোথাও একটা পরিতৃপ্তি আছে। কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না। বুঝবেও না। একঘর লোকের সামনে…
ভাবলেও তার মাথাটা দপদপ করছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক পরে সে কিচেনে ঢুকল। এক কাপ গরম কফি এখনই দরকার। তখনই চোখ পড়ল ডিভানে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে। তিনটে মিসড কল। এএইচ! আর্যনীল হাজরা। এর পরেও ফোন করছে লোকটা? এর পরেও? কেন?
ভাবতে না ভাবতে আবার বাজল ফোনটা। আবার এএইচ! ধরবে? ধরা উচিত? কী ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা ধরল রাই। লোকটা কী বলতে চায়, শোনা দরকার।
‘অনেকবার ফোন করছি। ধরছ না কেন?’ বেশ শান্ত উলটোদিকের গলা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাই। তার পরে গলা শক্ত করে, ‘কেন ফোন করছেন?’
‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড, ইউ মাস্ট বি আপসেট। কিন্তু আমার কথাটা শোনো, এটাকে সিরিয়াসলি নিও না। তুমি তো কাজ করতে এসেছ…আই অ্যাম শিওর আরও অনেক কাজ করবে…।’
‘আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, আমি জানি না। কাজ আমি করতে এসেছি ঠিকই, কিন্তু আপনি যা করেছেন, তার পরে আপনার সঙ্গে আমার পক্ষে কাজ করাটা অসম্ভব। আপনার সবার সামনে ক্ষমা চাওয়া উচিত’, কেটে কেটে বলল রাই।
‘ক্ষমা? ইউ মিন অ্যাপোলজি? হোয়াই? কাম অন, ইউ মাস্ট বি কিডিং। ক্ষমা কেন চাইতে যাব আমি? সেটে কাজ হচ্ছিল, একটা ইন্টিমেট সিন ছিল। সেটা কীভাবে করতে হবে, অ্যাজ ডিরেক্টর তোমাকে বোঝাচ্ছিলাম। যেটা খুব ন্যাচারাল। আরও অনেক মেয়েকে বোঝাই। সাডেনলি তুমি রিঅ্যাক্ট করলে। আস্ক এভরি ওয়ান প্রেজেন্ট দেয়ার। সবাই খুব অবাক হয়েছে। সারপ্রাইজড!’
এবার উত্তেজিত শোনায় রাইয়ের গলা, ‘আপনি যা খুশি বলবেন আর আমাকে সেটা মেনে নিতে হবে? যেভাবে আপনি…’
‘আহ!’, রাইকে থামান আর্যনীল, ‘তুমি গলা তুলো না। তোমাকে বোঝানোর জন্য ফোন করেছিলাম। যাতে মাথা ঠান্ডা হয়। যথেষ্ট ভালো একটা রোল এই ছবিটায় তোমাকে দেওয়া হয়েছে। এনাফ চান্স আছে নিজেকে প্রুভ করার। কাল শুটিংয়ে এসো, দরকার হলে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলব…।’
‘কাল? শুটিং? ওয়ান টু ওয়ান? আমার মনে হয় না, তার আর দরকার আছে।’
‘এখনও বলছি, নিজের পায়ে কুড়ুল মারছ তুমি! ভুল করছ!’
‘হয়তো করছি। কিন্তু আমি কী করব, সেটা আপনি বলে দেবেন না। রাখি।’ বলে কট করে ফোনটা কেটে দিল রাই। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। কেন ফোনটা ধরল সে?
২
‘জলে থেকে কেউ কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করে? তুমি পারবে? লোকটা ইন্ডাস্ট্রিতে পাওয়ারফুল, তার উপরে রুলিং পার্টির মাথাদের চেনে। তুমি নতুন, সবে কেরিয়ারটা তৈরি হচ্ছে…আমি বলব, একটু ভেবে ডিসিশন নাও।’
রবিদা যে এরকম কিছু একটা বলতে পারেন,আন্দাজ করেছিল রাই। আর্যনীল হাজরার ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ইন্ডাস্ট্রির ঘাঁতঘোঁত জানেন। রবিদার সঙ্গে একটা সিরিয়ালের সেটে আলাপ। রবিদাই মাসখানেক আগে ফোন করে আর্যনীল হাজরার ছবির কথা বলেছিলেন। স্ক্রিন টেস্ট হয়েছিল, সিলেক্টেডও হয়ে গিয়েছিল রাই। প্রথম দিন অফিসে বসিয়ে বেশ ভালো ব্যবহার করেছিল আর্যনীল। বলেছিল, ‘রোলটা তুমি ঠিকঠাক করতে পারলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। মিলিয়ে নিও।’
বেশ ফুরফুরে মন দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একটা এগ-চিকেন রোল কিনেছিল রাই। তার পছন্দের। ভেবেছিল। এখানে সাইড রোল হলেও স্ক্রিন পেজেন্স বেশ অনেকটা সময়ের। তার উপরে বড় ডিরেক্টর, বড় ব্যানার। ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছিল রোলটার জন্য।
স্ক্রিপ্ট পড়ার সময়ে জানতে পারল, দুটো ইন্টিমেট সিন আছে তার। এই লাইনে নতুন কাজ করতে এলেও দু’তিনটে সিরিয়ালে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। শরীর নিয়ে খুব বেশি ছুঁতমার্গ কোনওদিনই নেই। ইন্টিমেট সিন সে আগে করেওছে। গ্রুপ থিয়েটারে কাজ করেছে। এতসব ভেবে এই লাইনে কেউ আসে না। দেখতে শুনতে ভালো, জীবনের নিয়মে বেশ কয়েকটা পুরুষের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সম্পর্ক হয়েছে। আবার ভেঙেও গিয়েছে। বয়স প্রায় তিরিশ হতে চলল। এই মুহূর্তে সম্পর্কের প্রেশার সে আর নিতে চায় না। কেরিয়ারটাই মন দিয়ে তৈরি করলেই যথেষ্ট। সেজন্যই বারাসতে মা-বাবার বাড়ি থেকে উঠে এসে টালিগঞ্জের হরিদেবপুরে এক কামরার এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেওয়া।
রবিদার কথায় সে খুব একটা বিচলিত হল না। বলল, ‘কী বলছেন রবিদা! ইউনিটের সবার সামনে ঘটনাটা ঘটেছে। আর্যনীলদা কাছে ডেকেছিলেন। কাছে যেতেই উনি হাতটা চেপে আমাকে ওর কোলে বসিয়ে নিলেন। তার পরে বললেন, ব্যাপারটা এইরকম হবে…এর পরে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার গালে চুমু খেলেন। এর পরেই আমি হাত ছাড়িয়ে উঠে এসেছি–আই রিপিট উনি কী ভেবেছেন আমাকে? হাউ ডেয়ার হি?’
রবিদা বললেন, ‘তোমার অল্প বয়স। এই সাহসটা দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু তুমি কী করতে পারো? ইউনিটের কেউ কি তোমাকে সাপোর্ট করবে? তার বদলে প্রত্যেকে বলতে পারে, তারা কিছুই দেখেনি। তখন?’
‘অন্যদের কথা ছেড়ে দিন। ওখানে অন্তত দশটা লোক ছিল। কেউ হয়তো কিছু বলবে না। কিন্তু আপনি কী বলবেন রবিদা? আমি আপনার মেয়ের বয়সি। আজ যদি আপনার মেয়ের সঙ্গে একই জিনিস ঘটত, আপনি একই কথা বলতেন?’
রবি মজুমদার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তার পরে ধীরে ধীরে বলেন, ‘আমি কী করতাম, সেটা ভেবে কী লাভ? তোমাদের জেনারেশন আমার দিকটা বুঝবে না। আমি চাকরি করি। অনেক কিছুই ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বাকিটা তোমার উপরে।’
রাই একটু ভেবে বলল, ‘আপনি ওই লোকটাকে বলে দিতে পারেন, আমি আর কাজ করছি না।’
৩
ঘরটায় ঢোকার আগে কাঁপছিল রাই। তার টেনশন হচ্ছিল। বাড়িতে আয়নার সামনে অনেকবার রিহার্সাল দিয়েছে, কিন্তু কীভাবে বলবে, ভাবতে গিয়ে এখন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
এয়ারকন্ডিশনড ঘরটায় উলটোদিকে চারজন। একেবারে মাঝখানে মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান উজ্জয়িনী সেন। যিনি হেসে বললেন, ‘তোমার ভয় নেই। ঠিক কী হয়েছিল, খুলে বলো। ডিটেলসে।’
একই কাহিনী যখন বারবার বলতে হয়, তখন একটা সময়ে বিরক্তি আসতে বাধ্য। কিন্তু প্রতিকার খুঁজতে হলে, প্রতিবাদ করতে হলে তোমাকে বলতে হবে। তোমার মতো করে। বারবার কাটা রেকর্ড বাজানো ছাড়া রাস্তা কোথায়?
বলতে যখন হবে, সবটাই বলা ভালো। ঠিক সেটাই করে রাই। কমিশনের মেম্বাররা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন সব। আর্যনীল হাজরার ফোনের কথাটাও বলে। উজ্জয়িনী সেন চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে প্রশ্ন করেন, ‘এর আগে এই ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ঘটনা ফেস করেছ?’
‘দু’একটা রোলের জন্য অফার পেয়েছিলাম। তার পরে শুনেছিলাম, প্রোডিউসারের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে হবে। অ্যাভয়েড করে গিয়েছি। নাটকের মেয়ে। অভিনয়টা করতে জানি বলে বিশ্বাস করি।’
উজ্জয়িনী হাসেন, ‘তুমি পুলিশ জানিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ, পরের দিনই থানায় গিয়ে জানিয়েছিলাম। জিডি করেছিলাম। তার রেকর্ড আছে।’ থানায় যাওয়ার আগে একবারও ভাবেনি রাই। একটা মরিয়া জেদ কাজ করেছিল। ঠিক করেছিল, দরকার হলে অভিনয় ছেড়ে দেবে। থানায় ইনস্পেকটর দু’একটা প্রশ্ন করার পরে বলেছিল, ‘আপনি জানেন তো, কার বিরুদ্ধে কমপ্লেনটা করছেন?’
রাই জোর দিয়ে বলেছিল, ‘জানি’।
ইনস্পেকটর কথা বাড়াননি। থানায় জিডি করেই চুপ করে বসে থাকেনি রাই। বন্ধুদের কয়েকজনকে বলেছিল। থিয়েটারের মেয়ে স্মিতা সোজাসাপটা, প্রতিবাদী চরিত্র। ও-ই বলেছিল মহিলা কমিশনের কথা। স্মিতার কথায় সেখানে একটা মেল করেছিল সে। কিন্তু ডাক আর আসছিল না। তার মধ্যেই স্মিতা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল সুদীপ বসুর সঙ্গে। ‘এখন দুনিয়া’ কাগজের রিপোর্টার। সুদীপই দিনসাতেক আগে কাগজে খবরটা ফ্ল্যাশ করে। হেডিংটাও মনে আছে রাইয়ের। ‘অভিনেত্রীর শ্লীলতাহানি, অভিযুক্ত আর্যনীল।’
এর পর থেকেই সকাল থেকে বাজছিল রাইয়ের সেলফোন। বিভিন্ন চ্যানেল না বলে-কয়ে চলে এসেছে বাড়িতে। ইন্টারভিউয়ের জন্য। বেশ কিছু ইউটিউবার এসেছে, সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট।
পরিচালক হিসেবে আর্যনীলের বাজার যথেষ্ট ভালো। ঠিক সময়ে রং বদলে গিরগিটি হয়ে যেতে বরাবরই পারফেক্ট। সে দেখেছে, ঠান্ডা মাথায় কীভাবে মিডিয়াকে হ্যান্ডেল করে লোকটা। একটা চ্যানেলকে হাসতে হাসতে বলল, ‘হাস্যকর অভিযোগ। মেয়েটিকে একটা সিন বোঝানোর ছিল। সেই সময়ে ওর গালটা আমার গালে লেগে যায়। ব্যাস, তাতেই ও সেটেই সিন ক্রিয়েট করে। আপনারা ইউনিটের সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগ করা হচ্ছে।’
রিপোর্টার পালটা প্রশ্ন করেছিল, ‘কিন্তু মেয়েটি যে বলছে, আপনি ওকে জোর করে কোলে বসিয়েছিলেন?’
আর্যনীল হা হা করে হাসেন, ‘সবটাই মন গড়া। মিথ্যে।’
টিভিতে সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছিল রাইকে। একটু একটু করে তার মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবীটাই তার বিপক্ষে।
এর দু’দিন পরেই এসেছিল মহিলা কমিশনের ফোন। জেনেই সুদীপ বলেছিল, ‘কী হবে জানি না, কিন্তু মহিলা কমিশন থেকে আপনাকে ডেকেছে মানে সহজে পার পাবে না আর্যনীল হাজরা!’
৪
স্মিতা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস তুই সুদীপকে বলেছিলি। ও যদি খবরটা বের না করত, মহিলা কমিশন বা ডিরেক্টরস গিল্ড এত তাড়াতাড়ি ওকে সাসপেন্ড করার স্টেপটা নিত না। ভালো কেস খেয়েছে আর্যনীল হাজরা।’
দুপুরেই খবর পেয়েছিল, ডিরেক্টরস গিল্ড সাসপেন্ড করেছে আর্যনীল হাজরাকে। তার পরেই এক বিখ্যাত অভিনেত্রী এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘অবশেষে! এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম!’
তার ভালো লাগছিল। স্মিতার সঙ্গে সন্ধেয় লম্বা আড্ডা হল। হোম ডেলিভারিতে অর্ডার দিয়ে বিরিয়ানি, কাবাব। সঙ্গে ওয়াইন। টেলর সুইফ্ট চালিয়ে নাচলও দুজনে বেশ কিছুক্ষণ।
স্মিতা চলে যাওয়ার পরে সে দেখল, ফোনে বেশ কয়েকটা মেসেজ এসেছে। সবই গতানুগতিক। ওয়েল ডান, ব্রেভ গার্ল, হোয়াট আ ফাইট, এইসব। তার মধ্যে ঋতমের মেসেজটা তার চোখ টানল। অন্যরকম। পুরোনো প্রেমিক। দুটো শব্দ লিখেছে, ‘গার্ল পাওয়ার!’ সঙ্গে একটা লাল পান পাতা।
প্রায় সাত মাস হল, ঋতমের সঙ্গে শেষ হয়ে গিয়েছে তার সম্পর্ক। একসঙ্গে দশটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে ছেলেটা। মন্দারমণির ট্রিপে না গেলে সে এসব জানতেই পারত না। কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ মেসেজ করায় ভালো লাগল রাইয়ের। ঋতম তা হলে গোটা এপিসোডটা ফলো করেছে। সে রসিকতার জন্যই কী ভেবে শ্রীদেবীর বলিউডি ডায়লগ লিখল, ‘ইয়াপ! ইউ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ড!’
কিছুক্ষণের মধ্যে রাইয়ের মোবাইলে ঢুকল মন্দারমণির হোটেল রুমের একটা মিনিটখানেকের ভিডিও। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ঋতমের কোলে বসে আছে রাই। ঋতম চুমু খাচ্ছে তাকে।
তলায় ঋতমের একটা ছোট্ট মেসেজ। ‘ওয়ান মোর টাইম বেবি? ইউ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ড! ইউ টেল মি হোয়েন? হোয়্যার?’
মাঝরাতে ফোনের সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাই। থ্রেট। সামনে পুরুষ, আর একটা যুদ্ধে নামতে হবে তাকে!