মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

ডিসেম্বরের ডায়েরি

শেষ আপডেট:

  • সুমন মল্লিক

ছেলে, বৌমা আর নাতনির সঙ্গে সাত বছর ধরে লন্ডনে ছিলেন মিসেস ডিসুজা৷ বয়স ষাট পেরিয়েছে৷ আগে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেশেই থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের মালবাজারে৷ মিস্টার ডিসুজা ছিলেন রেলের রিটায়ার্ড অফিসার৷ স্বামীর মৃত্যুর পর মিসেস ডিসুজাকে লন্ডনে নিজের কাছে নিয়ে যায় ছেলে৷ সে লন্ডনে ভালো চাকরি করে৷ ছেলের বাড়িতে মিসেস ডিসুজার তেমন কোনও কাজ ছিল না৷ দু’দুটো কাজের লোক৷ তার ওপর বৌমাও খুব ভালো৷ সবটা নিজেই দেখেশুনে নেয়৷ তাই মিসেস ডিসুজার কাজ বলতে নাতনির সঙ্গে সময় কাটানো আর অবসর সময়ে লেখালেখি করা৷ মিসেস ডিসুজার বেশ কিছু ডায়েরি ছিল৷ ওগুলোতেই তিনি সময় পেলে লিখতেন৷ কিন্তু কী লিখতেন তা কেউ জানে না৷

মিসেস ডিসুজা লন্ডনে আসার পরও নিয়ম করে মালবাজারে আসতেন প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে৷ প্রায় এক মাস তিনি সেখানে থাকতেন স্বামীর তৈরি করা বাড়িতে৷ বাড়িটি তখনও বিক্রি করা হয়নি৷ ২০১০-এর ডিসেম্বরে তিনি শেষবারের মতো মালবাজারে আসেন৷ গোটা ডিসেম্বরটা তিনি সেখানে কাটান এবং মাসের শেষদিকে নিজের বাড়িতেই হঠাৎ মারা যান৷ মারা যাওয়ার আগে তিনি তাঁর একটি ছোট্ট ডায়েরি এবং একটি চিঠি কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের ঠিকানায়৷ ঘর গোছাতে গিয়ে চিঠি সহ সেই ডায়েরি বেশ কয়েক বছর পর হাতে পেয়ে যায় মিসেস ডিসুজার নাতনি৷ তখন সে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ ডায়েরি খুলে সে পড়তে শুরু করে৷

ডিসেম্বর ২০০৪

চা বাগানের ভেতর দিয়ে চাপা রাস্তা৷ গাড়িতে আধ ঘণ্টা মতো চলার পর শুনসান জায়গায় তৈরি হয়েছে একটি মেন্টাল অ্যাসাইলাম৷ আমার এখানে আসার কারণ হল ভিনসেন্ট৷ গত বছর থেকে ওকে এই অ্যাসাইলামে রাখা হয়েছে৷ এর আগে বাড়িতেই বেশ কয়েক বছর ওর ট্রিটমেন্ট চলেছে৷ কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগেই পরিজনরা ওকে এখানে ভর্তি করেছে৷ বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কউকেই ভিনসেন্ট আর ঠিকমতো চিনতে পারে না৷ চেনার চেষ্টা করে খুব৷ কিন্তু পারে না৷ আর সেটা না পারলেই পাগলামি শুরু হয়৷ কখনো-কখনো  প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে৷ ভিনসেন্টের এমন অবস্থার খবর পেয়ে ওকে দেখতে না এসে পারলাম না৷ ওর এমন অবস্থার জন্য দায়ী তো আমিই৷

     ভিনসেন্টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একটা কেকের দোকানে৷ সেদিন ছিল ক্রিসমাস৷ কেকের দোকান থেকে বাড়ি অবধি আমার পিছু নিয়েছিল সে৷ আমার তো ভয়ে হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল৷ পিছু নেওয়ার এই পালা চলেছিল প্রায় চার মাস৷ আমার তখন সবে কলেজজীবন শুরু হয়েছে৷ চার মাস অনেকটা সময়৷ ততদিনে আমার মন থেকে ভয় উবে গেছে৷ ভয়ের দখল নিয়েছে অজানা নতুন এক ভালোলাগা৷

ডিসেম্বর ২০০৫

ভিনসেন্ট ভালো নেই৷ ওকে দেখার পর থেকে আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না৷ প্রতি মুহূর্তে একটা অপরাধবোধ যেন আমাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে৷ ভিনসেন্টের ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, অ্যাসাইলামে কেউ শুরুর দিকে আসে না৷ পেশেন্ট কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলে তবেই বাড়ির লোক এখানে ভর্তি করায়৷ ভর্তি করানোর মূল কারণ যতটা না পেশেন্টের চিকিৎসা করানো, তার চেয়ে ঢের বেশি হল মুক্তি পাওয়া৷ পেশেন্টকে সুস্থ করে তোলার জন্য সাধ্যমতো সবরকম চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকে না৷ ওই শুধু রুটিন ট্রিটমেন্ট চলে৷ আর পরিকাঠামোর অবস্থাও ভালো না৷ সরকারও এসব দিকে নজর দিতে চায় না৷ দেবেই বা কেন৷ পাগলরা তো আর হাত পেতে ক্যামেরার সামনে অনুদান নেবে না কিংবা ভোটও দিতে যাবে না৷

     ভিনসেন্টের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সাত মাস পর সে আমাকে প্রপোজ করেছিল৷ শ্রাবণের মেঘভাঙা বৃষ্টির মাঝে আমরা একছাতার নীচে হাঁটছিলাম৷ হঠাৎ একটা লাল গোলাপ বের করে হাঁটু গেড়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভিনসেন্ট প্রপোজ করেছিল আমাকে৷ ওর এই পাগলামি দেখে না হেসে থাকতে পারিনি৷ আর আমার সেই হাসিতেই ছিল ভিনসেন্টের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর৷

ডিসেম্বর ২০০৬

ভিনসেন্টের শরীর আগে থেকে আরও খারাপ হয়েছে৷ ক্রমশ শুকিয়ে যেতে যেতে শরীরের হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায় এখন৷ অ্যাসাইলামে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাই ভিনসেন্টের সঙ্গে৷ পুরোনো দিনের নানা কথা বলি৷ আমাদের একসঙ্গে কাটানো বিভিন্ন আনন্দমুহূর্তের কথা বলি৷ ভিনসেন্ট আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে৷ সে কি কথার ভেতর নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, নাকি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে চিনতে চায়? আমি বুঝতে পারি না৷

     ভিনসেন্ট আমার থেকে এক বছরের সিনিয়ার ছিল৷ ও পড়ত অন্য কলেজে৷ কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ওকে আমার কলেজেই বেশি দেখা যেত৷ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কখনও আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম, কখনও আবার পার্ক কিংবা নদীর পাড়ে সময় কাটাতাম৷ আমার বাবা যে চা বাগানের ডাক্তার ছিল, সেই চা বাগানেই শ্রমিক ইউনিয়ন লিডার ছিল ভিনসেন্টের বাবা৷ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় চা বাগানের কর্মীদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল৷ এক বাগানেই কাজ করার ফলে আমার বাবার সঙ্গেও তার দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল৷

ডিসেম্বর ২০০৭

এবার এসে ভিনসেন্টকে দেখে খুব খারাপ লাগল৷ অ্যাসাইলামটার অবস্থাও আগের মতো আর নেই৷ ডাক্তার একই থাকলেও, বেশ কিছু কর্মী ও গার্ডের বদল হয়েছে৷ আগে ভিনসেন্টকে সবাই একটু করুণার চোখেই দেখত৷ এখন নতুন নিযুক্ত লোকদের মধ্যে করুণা ব্যাপারটা একেবারেই নেই৷ তার ওপর ভিনসেন্টের পরিজনরাও ওকে দেখতে আসাটা বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন ওকে দেখতে আসার মধ্যে শুধু আমি একা৷ তাও আমি তো শুধু বছরের এই একটা মাস আসি৷ আমার খুব ইচ্ছে করে, বাকি জীবনটা মালবাজারে থাকতে, ভিনসেন্টের পাশে থাকতে৷ কিন্তু সেটা সম্ভব নয়৷

     আমার আর ভিনসেন্টের সম্পর্কের কথা যখন আমার বাবা জানতে পারে তখন আমার সবে কলেজের পড়া শেষ হয়েছে৷ জানতে পারার পর থেকেই তুমুল অশান্তি শুরু হয়৷ বাবা-মা কিছুতেই আমার আর ভিনসেন্টের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেনি৷ কারণ, ভিনসেন্টরা ছিল চা বাগানের গরিব শ্রমিক৷ আমার কলেজ পরবর্তী পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়৷ এমনকি ঘর থেকে বেরোনোই প্রায় বন্ধ হয়ে যায় আমার৷ একদিন ভিনসেন্টের বাবাকে ডাকা হয় আমাদের বাংলোতে৷ আমার মা ও বাবার কাছে ভীষণভাবে অপমানিত হয় ভিনসেন্টের বাবা৷ ভিনসেন্ট নানাভাবে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করে৷ পারে না৷ বাধ্য হয়ে একদিন আমাদের বাংলোতে চলে আসে৷ কিন্তু আমাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়৷ বাবা ও মা ভিনসেন্টকে নানারকমের কুকথা বলে অপমান করতে করতে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে৷ সেদিনের পর থেকে আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়৷

ডিসেম্বর ২০০৮

এবার এসে ভিনসেন্টকে দেখার পর থেকে স্থির থাকতে পারছি না৷ না ঠিক মতো খেতে পারছি, না ঠিক মতো ঘুমোতে পারছি৷ অপমানের যে আগুন একদিন ভিনসেন্টকে পুড়িয়েছিল, তা এখন যেন অনুশোচনা, অপারগতা ও অপরাধবোধের এক মিশ্র আগুনে পরিণত হয়ে আমাকে পুড়িয়ে চলেছে৷ এই দহন থেকে মুক্তি নেই আমার৷ এটাই আমার ভবিতব্য৷ চোখের সামনে মনের মানুষটিকে এভাবে তিলে তিলে শেষ হতে দেখাই আমার ভবিতব্য৷ এটাই হয়তো আমার শাস্তি৷ ভিনসেন্টকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে৷ মাঝে মাঝে এতটাই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে যে, এটা না করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকছে না৷ শক দেওয়ার সময় ভিনসেন্ট গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে৷ আর শেষ হলে পাথরের মতো পড়ে থাকে৷ শুধু অপলক চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে নামে৷ এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না৷

     অবশেষে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়৷ পাত্র রেলের অফিসার৷ পরে জানতে পারি, আমার বিয়ের দিন সেই যে নেশার চক্রপাকে ঢুকে বসেছিল ভিনসেন্ট; আর বেরোতে পারেনি৷ আমাকে ভুলে থাকার জন্য সে দিন-দিন একটু একটু করে নেশার অতলে তলিয়ে গেছে৷ আস্তে আস্তে সব ভুলে গেছে৷ এমনকি নিজেকেই ভুলে গেছে একটা সময়৷ ভিনসেন্টের বাবা ছেলের শোকে শোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷ মা ও বোনের ওপর দিন-দিন একটা বোঝা হয়ে ওঠে ভিনসেন্ট৷ তারপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে একসময় ভিনসেন্ট একজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়৷

ডিসেম্বর ২০০৯

ভিনসেন্ট এখন গুটিয়ে একটা জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছে৷ সারাটা দিন অ্যাসাইলামে ভিনসেন্টের বেডের পাশে বসে থাকি৷ অতীতের স্মৃতিচারণ করি৷ একদিন আমার কথা বলার সময় হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল ভিনসেন্ট৷ তারপর ভীষণরকমের ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ল৷ নিজেকেই আঘাত করতে লাগল৷ অ্যাসাইলামের লোকেরা এসে ওকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়ার রুমে নিয়ে গেল৷ আমি আর থাকতে পারিনি৷ ছুটে বেরিয়ে এসেছি৷

     বিয়ের পরও আমি পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে ভিনসেন্টের খোঁজখবর নিতাম৷ বছর এভাবেই গড়াতে লাগল৷ মা হলাম৷ তারপর একে একে মা ও বাবা মারা গেল৷ হাজবেন্ডের বদলি হয়ে গেল অনেক দূরে৷ কিন্তু তারপরও আমি নিয়মিত ভিনসেন্টের খবর রাখতাম৷ মায়ার বাঁধন থেকে আমি কোনওদিনই মুক্তি পাইনি৷ হয়তো মুক্তি চাইওনি৷

ডিসেম্বর ২০১০

ভিনসেন্ট হয়তো ডিসেম্বরের জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ বোধহয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ এবার অ্যাসাইলামে আসার পরের দিনই মারা গেল ভিনসেন্ট৷ গুটিয়ে একটা ছোট্ট শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিল৷ তিনদিন থেকে কিচ্ছু খাচ্ছিল না৷ আমি যখন ওর মুখে জল দিচ্ছি তখন একবার শুধু তাকাল আমার দিকে আর দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷ ওর এই চোখের জলে আমি বিয়াল্লিশ বছর ধরে ডুবে চলেছি৷ দিনরাত ডুবে চলেছি৷ অবশেষে ভিনসেন্ট আমাকে নীরবে মুক্তি দিয়ে চলে গেল৷ কিন্তু আদৌ কি আমি মুক্তি পেলাম? না, মুক্তি আমি পাইনি৷ যে অপরিসীম কষ্ট পেতে পেতে ভিনসেন্ট মারা গেল, তার জন্য দায়ী তো একমাত্র আমি এবং তার সঙ্গে আমার পরিবার৷ এই পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি কি আর বেঁচে থাকতে পারব?

চিঠির শেষাংশ

“ভিনসেন্ট মারা যাওয়ার পর তিনদিন আমি ঘুমোতে পারিনি৷ বারবার ভেবেছি, বেশ তো ছিলাম দূরেই৷ তবে কেন বছর বছর ছুটে আসতাম ভিনসেন্টকে দেখার জন্য? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি খুঁজে পাইনি৷ পাগল পাগল লাগছে৷ এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভিনসেন্ট জানে৷ তাই সেই উত্তরের জন্য আমি ভিনসেন্টের কাছেই চললাম৷ তোরা সবাই ভালো থাকিস৷ আমার শেষ ইচ্ছে হল, ভিনসেন্টের কবরের পাশেই যেন আমাকে রাখা হয়৷ আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে৷”

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতার কথা

পূর্বা সেনগুপ্ত   তখন বৈষ্ণবদের ভক্তির রসে আপ্লুত, তন্ত্রের আচারে...

দীপার পাত্র

জয়ন্ত দে             দ্যুতিমানকে দুশ্চরিত্র কোন শালা বলে। দ্যুতিমান ভগবান...

শাপলা

মনোনীতা চক্রবর্তী             আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে  স্বচ্ছতোয়া। আরও...

১ আনমনা   সুব্রতা ঘোষ রায়    বসন্ত এসেছিল পলাশের ডালে, আনমনা মেয়ে তার কোন ব‍্যথা...