- সুমন মল্লিক
ছেলে, বৌমা আর নাতনির সঙ্গে সাত বছর ধরে লন্ডনে ছিলেন মিসেস ডিসুজা৷ বয়স ষাট পেরিয়েছে৷ আগে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেশেই থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের মালবাজারে৷ মিস্টার ডিসুজা ছিলেন রেলের রিটায়ার্ড অফিসার৷ স্বামীর মৃত্যুর পর মিসেস ডিসুজাকে লন্ডনে নিজের কাছে নিয়ে যায় ছেলে৷ সে লন্ডনে ভালো চাকরি করে৷ ছেলের বাড়িতে মিসেস ডিসুজার তেমন কোনও কাজ ছিল না৷ দু’দুটো কাজের লোক৷ তার ওপর বৌমাও খুব ভালো৷ সবটা নিজেই দেখেশুনে নেয়৷ তাই মিসেস ডিসুজার কাজ বলতে নাতনির সঙ্গে সময় কাটানো আর অবসর সময়ে লেখালেখি করা৷ মিসেস ডিসুজার বেশ কিছু ডায়েরি ছিল৷ ওগুলোতেই তিনি সময় পেলে লিখতেন৷ কিন্তু কী লিখতেন তা কেউ জানে না৷
মিসেস ডিসুজা লন্ডনে আসার পরও নিয়ম করে মালবাজারে আসতেন প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে৷ প্রায় এক মাস তিনি সেখানে থাকতেন স্বামীর তৈরি করা বাড়িতে৷ বাড়িটি তখনও বিক্রি করা হয়নি৷ ২০১০-এর ডিসেম্বরে তিনি শেষবারের মতো মালবাজারে আসেন৷ গোটা ডিসেম্বরটা তিনি সেখানে কাটান এবং মাসের শেষদিকে নিজের বাড়িতেই হঠাৎ মারা যান৷ মারা যাওয়ার আগে তিনি তাঁর একটি ছোট্ট ডায়েরি এবং একটি চিঠি কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের ঠিকানায়৷ ঘর গোছাতে গিয়ে চিঠি সহ সেই ডায়েরি বেশ কয়েক বছর পর হাতে পেয়ে যায় মিসেস ডিসুজার নাতনি৷ তখন সে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ ডায়েরি খুলে সে পড়তে শুরু করে৷
ডিসেম্বর ২০০৪
চা বাগানের ভেতর দিয়ে চাপা রাস্তা৷ গাড়িতে আধ ঘণ্টা মতো চলার পর শুনসান জায়গায় তৈরি হয়েছে একটি মেন্টাল অ্যাসাইলাম৷ আমার এখানে আসার কারণ হল ভিনসেন্ট৷ গত বছর থেকে ওকে এই অ্যাসাইলামে রাখা হয়েছে৷ এর আগে বাড়িতেই বেশ কয়েক বছর ওর ট্রিটমেন্ট চলেছে৷ কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগেই পরিজনরা ওকে এখানে ভর্তি করেছে৷ বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কউকেই ভিনসেন্ট আর ঠিকমতো চিনতে পারে না৷ চেনার চেষ্টা করে খুব৷ কিন্তু পারে না৷ আর সেটা না পারলেই পাগলামি শুরু হয়৷ কখনো-কখনো প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে৷ ভিনসেন্টের এমন অবস্থার খবর পেয়ে ওকে দেখতে না এসে পারলাম না৷ ওর এমন অবস্থার জন্য দায়ী তো আমিই৷
ভিনসেন্টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একটা কেকের দোকানে৷ সেদিন ছিল ক্রিসমাস৷ কেকের দোকান থেকে বাড়ি অবধি আমার পিছু নিয়েছিল সে৷ আমার তো ভয়ে হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল৷ পিছু নেওয়ার এই পালা চলেছিল প্রায় চার মাস৷ আমার তখন সবে কলেজজীবন শুরু হয়েছে৷ চার মাস অনেকটা সময়৷ ততদিনে আমার মন থেকে ভয় উবে গেছে৷ ভয়ের দখল নিয়েছে অজানা নতুন এক ভালোলাগা৷
ডিসেম্বর ২০০৫
ভিনসেন্ট ভালো নেই৷ ওকে দেখার পর থেকে আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না৷ প্রতি মুহূর্তে একটা অপরাধবোধ যেন আমাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে৷ ভিনসেন্টের ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, অ্যাসাইলামে কেউ শুরুর দিকে আসে না৷ পেশেন্ট কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলে তবেই বাড়ির লোক এখানে ভর্তি করায়৷ ভর্তি করানোর মূল কারণ যতটা না পেশেন্টের চিকিৎসা করানো, তার চেয়ে ঢের বেশি হল মুক্তি পাওয়া৷ পেশেন্টকে সুস্থ করে তোলার জন্য সাধ্যমতো সবরকম চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকে না৷ ওই শুধু রুটিন ট্রিটমেন্ট চলে৷ আর পরিকাঠামোর অবস্থাও ভালো না৷ সরকারও এসব দিকে নজর দিতে চায় না৷ দেবেই বা কেন৷ পাগলরা তো আর হাত পেতে ক্যামেরার সামনে অনুদান নেবে না কিংবা ভোটও দিতে যাবে না৷
ভিনসেন্টের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সাত মাস পর সে আমাকে প্রপোজ করেছিল৷ শ্রাবণের মেঘভাঙা বৃষ্টির মাঝে আমরা একছাতার নীচে হাঁটছিলাম৷ হঠাৎ একটা লাল গোলাপ বের করে হাঁটু গেড়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভিনসেন্ট প্রপোজ করেছিল আমাকে৷ ওর এই পাগলামি দেখে না হেসে থাকতে পারিনি৷ আর আমার সেই হাসিতেই ছিল ভিনসেন্টের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর৷
ডিসেম্বর ২০০৬
ভিনসেন্টের শরীর আগে থেকে আরও খারাপ হয়েছে৷ ক্রমশ শুকিয়ে যেতে যেতে শরীরের হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায় এখন৷ অ্যাসাইলামে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাই ভিনসেন্টের সঙ্গে৷ পুরোনো দিনের নানা কথা বলি৷ আমাদের একসঙ্গে কাটানো বিভিন্ন আনন্দমুহূর্তের কথা বলি৷ ভিনসেন্ট আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে৷ সে কি কথার ভেতর নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, নাকি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে চিনতে চায়? আমি বুঝতে পারি না৷
ভিনসেন্ট আমার থেকে এক বছরের সিনিয়ার ছিল৷ ও পড়ত অন্য কলেজে৷ কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ওকে আমার কলেজেই বেশি দেখা যেত৷ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কখনও আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম, কখনও আবার পার্ক কিংবা নদীর পাড়ে সময় কাটাতাম৷ আমার বাবা যে চা বাগানের ডাক্তার ছিল, সেই চা বাগানেই শ্রমিক ইউনিয়ন লিডার ছিল ভিনসেন্টের বাবা৷ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় চা বাগানের কর্মীদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল৷ এক বাগানেই কাজ করার ফলে আমার বাবার সঙ্গেও তার দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল৷
ডিসেম্বর ২০০৭
এবার এসে ভিনসেন্টকে দেখে খুব খারাপ লাগল৷ অ্যাসাইলামটার অবস্থাও আগের মতো আর নেই৷ ডাক্তার একই থাকলেও, বেশ কিছু কর্মী ও গার্ডের বদল হয়েছে৷ আগে ভিনসেন্টকে সবাই একটু করুণার চোখেই দেখত৷ এখন নতুন নিযুক্ত লোকদের মধ্যে করুণা ব্যাপারটা একেবারেই নেই৷ তার ওপর ভিনসেন্টের পরিজনরাও ওকে দেখতে আসাটা বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন ওকে দেখতে আসার মধ্যে শুধু আমি একা৷ তাও আমি তো শুধু বছরের এই একটা মাস আসি৷ আমার খুব ইচ্ছে করে, বাকি জীবনটা মালবাজারে থাকতে, ভিনসেন্টের পাশে থাকতে৷ কিন্তু সেটা সম্ভব নয়৷
আমার আর ভিনসেন্টের সম্পর্কের কথা যখন আমার বাবা জানতে পারে তখন আমার সবে কলেজের পড়া শেষ হয়েছে৷ জানতে পারার পর থেকেই তুমুল অশান্তি শুরু হয়৷ বাবা-মা কিছুতেই আমার আর ভিনসেন্টের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেনি৷ কারণ, ভিনসেন্টরা ছিল চা বাগানের গরিব শ্রমিক৷ আমার কলেজ পরবর্তী পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়৷ এমনকি ঘর থেকে বেরোনোই প্রায় বন্ধ হয়ে যায় আমার৷ একদিন ভিনসেন্টের বাবাকে ডাকা হয় আমাদের বাংলোতে৷ আমার মা ও বাবার কাছে ভীষণভাবে অপমানিত হয় ভিনসেন্টের বাবা৷ ভিনসেন্ট নানাভাবে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করে৷ পারে না৷ বাধ্য হয়ে একদিন আমাদের বাংলোতে চলে আসে৷ কিন্তু আমাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়৷ বাবা ও মা ভিনসেন্টকে নানারকমের কুকথা বলে অপমান করতে করতে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে৷ সেদিনের পর থেকে আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়৷
ডিসেম্বর ২০০৮
এবার এসে ভিনসেন্টকে দেখার পর থেকে স্থির থাকতে পারছি না৷ না ঠিক মতো খেতে পারছি, না ঠিক মতো ঘুমোতে পারছি৷ অপমানের যে আগুন একদিন ভিনসেন্টকে পুড়িয়েছিল, তা এখন যেন অনুশোচনা, অপারগতা ও অপরাধবোধের এক মিশ্র আগুনে পরিণত হয়ে আমাকে পুড়িয়ে চলেছে৷ এই দহন থেকে মুক্তি নেই আমার৷ এটাই আমার ভবিতব্য৷ চোখের সামনে মনের মানুষটিকে এভাবে তিলে তিলে শেষ হতে দেখাই আমার ভবিতব্য৷ এটাই হয়তো আমার শাস্তি৷ ভিনসেন্টকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে৷ মাঝে মাঝে এতটাই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে যে, এটা না করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকছে না৷ শক দেওয়ার সময় ভিনসেন্ট গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে৷ আর শেষ হলে পাথরের মতো পড়ে থাকে৷ শুধু অপলক চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে নামে৷ এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না৷
অবশেষে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়৷ পাত্র রেলের অফিসার৷ পরে জানতে পারি, আমার বিয়ের দিন সেই যে নেশার চক্রপাকে ঢুকে বসেছিল ভিনসেন্ট; আর বেরোতে পারেনি৷ আমাকে ভুলে থাকার জন্য সে দিন-দিন একটু একটু করে নেশার অতলে তলিয়ে গেছে৷ আস্তে আস্তে সব ভুলে গেছে৷ এমনকি নিজেকেই ভুলে গেছে একটা সময়৷ ভিনসেন্টের বাবা ছেলের শোকে শোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷ মা ও বোনের ওপর দিন-দিন একটা বোঝা হয়ে ওঠে ভিনসেন্ট৷ তারপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে একসময় ভিনসেন্ট একজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়৷
ডিসেম্বর ২০০৯
ভিনসেন্ট এখন গুটিয়ে একটা জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছে৷ সারাটা দিন অ্যাসাইলামে ভিনসেন্টের বেডের পাশে বসে থাকি৷ অতীতের স্মৃতিচারণ করি৷ একদিন আমার কথা বলার সময় হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল ভিনসেন্ট৷ তারপর ভীষণরকমের ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ল৷ নিজেকেই আঘাত করতে লাগল৷ অ্যাসাইলামের লোকেরা এসে ওকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়ার রুমে নিয়ে গেল৷ আমি আর থাকতে পারিনি৷ ছুটে বেরিয়ে এসেছি৷
বিয়ের পরও আমি পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে ভিনসেন্টের খোঁজখবর নিতাম৷ বছর এভাবেই গড়াতে লাগল৷ মা হলাম৷ তারপর একে একে মা ও বাবা মারা গেল৷ হাজবেন্ডের বদলি হয়ে গেল অনেক দূরে৷ কিন্তু তারপরও আমি নিয়মিত ভিনসেন্টের খবর রাখতাম৷ মায়ার বাঁধন থেকে আমি কোনওদিনই মুক্তি পাইনি৷ হয়তো মুক্তি চাইওনি৷
ডিসেম্বর ২০১০
ভিনসেন্ট হয়তো ডিসেম্বরের জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ বোধহয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ এবার অ্যাসাইলামে আসার পরের দিনই মারা গেল ভিনসেন্ট৷ গুটিয়ে একটা ছোট্ট শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিল৷ তিনদিন থেকে কিচ্ছু খাচ্ছিল না৷ আমি যখন ওর মুখে জল দিচ্ছি তখন একবার শুধু তাকাল আমার দিকে আর দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷ ওর এই চোখের জলে আমি বিয়াল্লিশ বছর ধরে ডুবে চলেছি৷ দিনরাত ডুবে চলেছি৷ অবশেষে ভিনসেন্ট আমাকে নীরবে মুক্তি দিয়ে চলে গেল৷ কিন্তু আদৌ কি আমি মুক্তি পেলাম? না, মুক্তি আমি পাইনি৷ যে অপরিসীম কষ্ট পেতে পেতে ভিনসেন্ট মারা গেল, তার জন্য দায়ী তো একমাত্র আমি এবং তার সঙ্গে আমার পরিবার৷ এই পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি কি আর বেঁচে থাকতে পারব?
চিঠির শেষাংশ
“ভিনসেন্ট মারা যাওয়ার পর তিনদিন আমি ঘুমোতে পারিনি৷ বারবার ভেবেছি, বেশ তো ছিলাম দূরেই৷ তবে কেন বছর বছর ছুটে আসতাম ভিনসেন্টকে দেখার জন্য? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি খুঁজে পাইনি৷ পাগল পাগল লাগছে৷ এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভিনসেন্ট জানে৷ তাই সেই উত্তরের জন্য আমি ভিনসেন্টের কাছেই চললাম৷ তোরা সবাই ভালো থাকিস৷ আমার শেষ ইচ্ছে হল, ভিনসেন্টের কবরের পাশেই যেন আমাকে রাখা হয়৷ আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে৷”