- সুতপন চট্টোপাধ্যায়
দমদম বিমানবন্দরে নামল অনুপম।
লিপি মেসেজ পাঠিয়েছিল। দাদা, এবার টিকিট কেটে চলে আয়। প্রোমোটারের সঙ্গে প্রাথমিক কথা শেষ। পড়তির বাজারে মোটামুটি একটা দাম পেয়েছি। এলে সামনাসামনি ফাইনাল কথা হবে। খুব দেরি করিস না। রিয়েল এস্টেটের বাজার খুব খারাপ। যা ইঙ্গিত পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে এটাই বেস্ট ডিল।
গত বৈশাখে পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন সুচেতনা। পড়ে আছে সত্যেন রায় রোডের উপর দোতলা বাড়ি। বিজনের নিজে হাতে তৈরি বাড়ির সামনে একফালি বাগান। বিজন চলে গেছেন আগে।
লিপি থাকে জামশেদপুরে। বরের বিরাট বাংলো ও বাগান নিয়ে সারাদিন সে ব্যস্ত। সপ্তাহান্তে বরের নানা পার্টি। বিমান সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত। এইটুকু জানে অনুপম। এখন হয়তো অনেক বদলে গেছে। প্রায় দশ বছর জার্মানির ডেটমল্ড শহরের বসবাসে তার জীবন সত্যেন রায় রোডের থেকে বদলে গেছে আমূল।
সুচেতনা পৃথিবীর একটুকরো জমি আগলে ছিলেন এতদিন। তাঁর জীবিতকালে কারও খুব একটা যাতায়াত ছিল না। ফোন ও ভিডিও কল করেই কাজ সেরে নিত দুজনেই।
প্রোমোটার প্রতাপ লোকটি দেখতে সাদাসিধে, মাথায় পাকা চুল, গায়ের রং কালো, একটি চোখ ছোট। চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় সে হালকা ট্যারা। মুখে ঝোলানো মাটির মানুষ মার্কা নিরামিষ হাসি।
বৈঠকখানার ঘরে লিপি ও অনুপমের সামনে বসে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা ছাড়া আর কোনও দাবিদার আছে? লিপি বলল, না। আমরা দুজন। প্রতাপ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দলিলটা একবার দেখি? লিপি দলিল এগিয়ে দিলে প্রতাপের গুলি গুলি চোখ দ্রুত দলিলের আনাচে-কানাচে বনবন করে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
অনুপমের মনে হল, প্রতাপ শুধু দলিলটি দেখছে না, গন্ধ নিচ্ছে। যেভাবে সে মুখের কাছে ধরে দেখছে, তাতে পারলে দলিলটা চেটে দিতেও পারে। তা দেবে নাই বা কেন? কর্নার প্লট, সাড়ে পাঁচ কাঠা জায়গা। মেইন রাস্তা থেকে দু’মিনিটের পথ।
প্রতাপ হাসতে হাসতে বলল, বুঝলেন, আসতে আসতে দেখছিলাম, বাড়িটা পিছনে অনেকটাই ড্যামেজ।
লিপি বলল, ভালোই তো, আপনি তো ফ্ল্যাট তুলবেন, নতুন করে ভাঙতে হবে না।
আসলে মার অত দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না। বয়স হয়েছিল তো।
প্রতাপ বলল, সেটা তো একশোবার সত্যি। বলে সে উঠে পড়ল। বাড়ির চারপাশ নতুন করে দেখল যেন সে এই প্রথম দেখছে। আসলে সে অনেকবার দেখে গেছে আগেই। দেখার শেষে সে একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘনঘন টান দিল তিনবার।
তারপর অনুপমের সামনে এসে বলল, আমি কাল ফাইনাল অফার নিয়ে আসব। আপনাদের সব ডকুমেন্টের একটা ফোটোকপি করে রাখবেন। আমার লাগবে। কোনও পিছনের লিটিগেশন থাকলে আমাকে জানান। না হলে ভবিষ্যতে আমি বিপদে পড়ব।
অনুপম বলল, না। কোনও লিটিগেশন নেই।
২
লিপিকে বলা দামের থেকে অনেক কম প্রস্তাব দিল প্রতাপ। অনুপম অবাক হয়ে বলল, এ তো অনেক কম বলছেন? লিপির কথার সঙ্গে মিলছে না তো?
কারণ হিসেবে উল্লেখ করল প্রতাপ, একদিকটা ভাঙা, জমিতে টারমাইটও করা নেই। দোতলার ভিত ভেঙে চারতলার ভিত তুলতে হবে। আর বাইরে থেকে দেখা আর ভিতর থেকে দেখার ফারাক আছে বৈকি। এ সব অনুপম ও লিপির ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুজনে হাঁ করে কিছুক্ষণ শুনল।
তারপর অনুপম বলল, ঠিক আছে আমরা আলোচনা করেই জানাব।
প্রতাপ তির্যক চোখে অনুপমের দিকে তাকিযে রহস্যময় হাসি হাসল। যাবার সময় বলল, একবার যখন আমাকে ডেকেছেন, অন্য কাউকে তো আর বিক্রি করতে পারবেন না। সেটা মাথায় রেখে মতামত জানাবেন।
লিপি বলল, কেন আপনাকেই বিক্রি করতে হবে কেন?
প্রতাপ শান্ত গলায় উত্তর দিল, এই এলাকায় অন্য কেউ প্রোমোটিং করতে ঢুকবে না। খোঁজ করে দেখতে পারেন।
প্রতাপ চলে গেলে লিপি অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলি কিছু? দেখলি, ঠান্ডা মাথায় আমাদের কী স্মার্টলি চমকে গেল।
অনুপম বলল, দেখলাম। কিন্তু করবি কী? কথা শুনে মনে হচ্ছে ওকেই দিতে হবে, উনি যা দাম বলবেন তাতেই দিতে হবে, ওঁর কথামতো আমাদের নাচতে হবে!
লিপি বলল, একদম তাই। আমার সঙ্গে কথা বলল এক। এখন কেমন পালটি খেয়ে গেল। ও বুঝে গেছে আমরা কেউ থাকি না। থাকবও না। পড়শিরা কেউ আমাদের সাহায্য করতে আসবে না। আর ওর তো সব চেনাজানা। ইশারায়
সব কাজ করিয়ে দেবে। খবর নেবে। ওকে না দিলে ঝামেলা করবে। আমাদের কি ঝামেলা সামলানোর সময় আছে? কত দিন আগে এই পাড়া ছেড়ে গেছি, বন্ধুবান্ধব কেউ কাছেপিঠে নেই। আমাদের পাশে কে আছে বল?
-তাছাড়া আবার কে আসবে? অনুপম বলল।
৩
আলোচনা শেষ। দিন দশেকের মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে হবে।
অনুপম বলল, বড্ড অল্প সময় প্রতাপবাবু। সময়টা একটু বাড়ান। অনেক দিনের জমা জিনিস। বুঝতেই পারছেন, বাবার আমলের জিনিস। মায়ের ফেলে যাওয়া কত জিনিস। আমরা তো সব নিয়ে যেতে পারব না। আমাদের লোক ঠিক
করতে হবে।
প্রতাপ বলল, বিক্রি করলে বলবেন। আশ্রমে দান করলেও বলবেন। আমাদের কাছে সব ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছেটা খালি আপনাদের। কাজের জন্য চিন্তা করবেন না।
প্রতাপ চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ঠিক আছে আর পাঁচদিন এক্সট্রা নিন, তবে তার বেশি নয়।
বাইরে মোটর সাইকেলের স্টার্ট করার শব্দ। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল।
আসবাবগুলোর একটা লিস্ট করল অনুপম। পুরোনো ফার্নিচারের দোকানের সঙ্গে কথা বলে তাদের দেখিয়ে দিল একদিন। কত দিনের পুরোনো সব আসবাব এখন নতুনের মতো। কাঠের আলমারি শুধু পালিশ করলে নতুন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
ডাইনিং টেবিলটা মা’র বিয়ের। সেটাও সুচেতনা শেষ দিন অব্দি নতুনের মতো রেখেছিলেন। বিজনের সব কিছু মুল্যবান স্মৃতি ভেবে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন। দেখতে এসে ফার্নিচারের দোকানের লোক দুটো যেভাবে টানাটানি করল যেন তারা বিজন ও সুচেতনাকেই হিঁচড়ে এক দিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মার ফেলে যাওয়া জিনিসের মধ্যে কোথায় যেন মায়া লুকিয়ে আছে। পানের বাটা স্পর্শ করলে সুচেতনার পান চিবানো মুখটির কথা মনে পড়ল অনুপমের। দু’হাত দিয়ে গাল ধরে আছে মা। আর সে বলছে, বাইরের অফারটা এসে গেছে, তোমাকে খুব মিস করব মা। বুকের মধ্যে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলেন সুচেতনা। তখনই সুচেতনার মুখ থেকে মিষ্টি বাংলাপাতা পানের গন্ধ এসেছিল নাকে আর গাল গড়িয়ে চোখের জল টপটপ করে পড়েছিল অনুপমের কপালের উপর।
পুরোনো বাসনকোসনের দোকানের লোকটির কথাবার্তাই আলাদা।
-ফেলে দিলেও কেউ নেবে না দাদা। এইসব বাসনকোসন কেউ আর ব্যবহার করে না। কিছু কিছু জিনিস কাজে লাগতে পারে, বাকি সব কাবাড়।
এ যেন জোর করে গছিয়ে দিচ্ছে অনুপম।
বাইরের নার্সারি থেকে লোক আনিয়ে বাড়ির সব গাছের টবগুলো দিয়ে দিল লিপি।
কাঠের মিস্ত্রি ডেকে এনে লিপি দেওয়ালজোড়া কাঠের আলমারি খুলে ফেলল। আলমারির ভিতর বছরের পর বছরের জমা শাড়ি, জামা, বাবার প্যান্ট-শার্ট। উপহার পাওয়া শাড়ি সব একে একে ঘরের একপাশে নামাল। অনুপম বলল, দেখ এ সব শাড়ি পরেনি কোনওদিন মা।
লিপি বলল, পরবে কখন? বাবা চলে যাবার পর বাড়ির থেকে বেরোত না।
সমস্ত জামাকাপড় চলে যাবে এক সমাজসেবী সংস্থার আস্তানায়।
রান্নাঘরের অনেক জিনিস নিয়ে গেছে শান্তামাসি। সুচেতনার দীর্ঘদিনের সঙ্গী। সুচেতনার যে স্টিলের আলমারি, তার ভিতর থেকে কিছু গয়না লিপি রাখল নিজের কাছে। বাকি অনুপমকে দিয়ে দিল।
বাড়ির মধ্যে এইসব কাণ্ডকারখানা চলছে বলেই মনে হয় টিকটিকিটি আগে দেওয়ালে ঘুরে ঘুরে চোখ তুলে বারবার দেখছিল। এখন আর তাকে ত্রিসীমানায় চোখে পড়ছে না। ও বোধহয় বর্তমানের ছক বদল বুঝতে পেরেছে!
৪
দোতলার ঘরটি অনুপমের। এই ঘর তার শৈশব, কৈশোর ও বড় হয়ে ওঠার একমাত্র সাক্ষী। ভিতরে সোঁদা গন্ধ। প্রবল বৃষ্টির দিনে জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে জল ঢুকেছে, মেঝেতে তার দাগ। এই ঘরে তার জীবনের অনেক বছর কেটেছে। দু’দিকের দেওয়ালজুড়ে দুটো কাঠের আলমারি। ভর্তি বই।
কোথায় দান করা যায়?
ঘরের একদিকে তার গিটার। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় চেহারা বেশ ফুলে উঠেছে। ধুলো ঝেড়ে একবার দেখল অনুপম। টেবিলের উপর ছিল নেতাজির ছবি, সেটাও ধুলো জমে ধূসর, বর্ণহীন। ঘরের কোণের টেবিলে নিজস্ব একটি ড্রয়ার। চাবিটা ঝুলছে। জং ধরে গেছে। কিছুতেই খুলছে না। অনেক টানাটানি করতে তালা সমেত সামনের অংশটি ভেঙে বেরিয়ে এল।
অনুপম দেখল একটি সবুজ খাম। খামটির ভিতর পারমিতার দশটি চিঠি।
পকেটে পুরে নিল অনুপম। আজ কোথায় আছে পারমিতা? তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই দীর্ঘ এক দশক। তবু কেন তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করল তার!
লিপি এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে। বলল, দাদা, চল প্রতাপ এসেছে। রেজিস্ট্রেশন ডেট নিয়ে কথা বলবে।
নীচে নেমে এল দুজনে। একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে প্রতাপ। সিগারেটটা সবে ধরিয়েছে। ওরা আসতেই টেবিলের একটা কাগজে দু্টো তারিখ লিখে প্রতাপ বলল, দেখুন দুটো ভালো দিন আছে। আমি পাঁজি দেখে খবর নিয়ে বলতে এলাম।
যে কোনও একটাতে করতে পারেন। আমার উকিলকে সেইমতো টাইম দিতে বলতে হবে।
দিন দুটো প্রায় কাছাকাছি।
অনুপম চুপ করে শুনছিল। তাকিয়ে ছিল তারিখ দুটোর দিকে। লিপি কোনও কথা বলছে না। দাদার উত্তরের আশায় তাকিয়ে দেখছে।
প্রতাপ বলল, কী হল, কিছু বলছেন না যে। মন খারাপ লাগছে?
এবার অনুপম বলল, ঠিক ধরেছেন। অনেক দিনের স্মৃতি, ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবন সব এই বাড়িটা ঘিরে। মনটা খুব খারাপ লাগছে।
প্রতাপ একটু মোলায়েম গলায় বলল, হবারই কথা। বাড়িটা না হয় লোক ডেকে খালি করে দিলেন। কিন্তু স্মৃতিগুলো কী করবেন? ওটাই তো সমস্যা। স্মৃতিগুলো তো আর হস্তান্তর করা যায় না!
– কী যে ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছে কী বলব? লিপি বলল।
-হবেই তো। বলে প্রায় একশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে দূরের দিক দেখিয়ে প্রতাপ বলল, ওই যে, দেখছেন, চারদিকে বাড়ি। আমি ভেঙে প্রোমোটিং করেছি। নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে, পুরোনো বাড়িগুলোর পিছনে অনেক স্মৃতি জমা ছিল। কত ছেলেমেয়ে বাইরে চলে গেছে। দেশের বাইরেও চলে গেছে। আপনাদের মতো বাবা-মা মারা গেছে। দেখভাল করার কেউ নেই।
ঘাড় নাড়ল অনুপম। আমি সবাইকে একটা কথাই বলেছি, খুব কষ্ট হলে এক বছর পরে একবার এসে দেখে যাবেন। দেখবেন, আপনাদের বাড়ির জায়গায় একটা ঝাঁ চকচক করছে ব্র্যান্ড নিউ বাড়ি। বাড়ির নাম বদলে গেছে, নতুন নাম হয়েছে। কোথাও তো রাস্তার নামও বদলে গেছে। দেখবেন, তখন সব স্মৃতি ধুয়েমুছে সাফ। কিছুই মেলাতে পারবেন না। বলে বিজ্ঞের হাসি হাসল প্রতাপ। একটু পরে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তারিখটা এবার তো ফাইনাল বলুন?
৫
প্রতাপ চলে গেল। লিপি হতাশ গলায় বলল, দাদা, কী বুঝলি? ভবিষ্যতে আমাদের স্থায়ী ঠিকানাটাও থাকবে না। ভেবে দেখেছিস? অনুপম শান্ত গলায় বলল, থাকবে, থাকবে, কেবল পাসপোর্টে থাকবে।