শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: বাস্তবে হচ্ছে না কোনও পণ্য কেনাবেচা। কারবার হচ্ছে শুধুমাত্র কাগজ-কলমেই। এভাবেই ‘ভুয়ো ব্যবসা’ দেখিয়ে জিএসটির ইনপুট ট্যাক্স হিসাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারণাচক্র। শিলিগুড়িকে (Siliguri) কেন্দ্র করে গোটা উত্তরবঙ্গে (North Bengal) সক্রিয় হয়েছে চক্রটি। একশ্রেণির অসাধু আমদানি-রপ্তানিকারক ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ সেই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে। চক্রটিকে ধরতে তদন্তে নেমে বৃহস্পতিবার আলিপুরদুয়ারের জয়গাঁর ব্যবসায়ী রণজিৎ প্রসাদকে গ্রেপ্তার করেছেন সেন্ট্রাল জিএসটি আধিকারিকরা। তাঁর বিরুদ্ধে ‘ভুয়ো ব্যবসা’ দেখিয়ে ১৩ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ইনপুট ট্যাক্স হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এদিন অভিযুক্তকে শিলিগুড়ি আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।
সিজিএসটি’র আইনজীবী রতন বণিকের বক্তব্য, ‘রণজিৎ দীর্ঘদিন থেকে ভুয়ো ব্যবসা দেখিয়ে সিজিএসটি আধিকারিকদের ফাঁকি দিয়ে ইনপুট ট্যাক্স বাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ধরা পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সিজিএসটি আইনের ১৩২ ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। ভুটানে পণ্য কেনাবেচা দেখালেও বাস্তবে কোনও পণ্যই ভুটানে যেত না। গোটা কারবারটাই হত শুধু কাগজে-কলমে।’ সিজিএসটি’র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিকের কথায়, ‘একটা বড় চক্র রয়েছে। উত্তরবঙ্গের জনা পনেরো এক্সপোর্টার সম্পর্কে অভিযোগ এসেছে। প্রত্যেকের বিষয়ে আলাদা করে তদন্ত শুরু হয়েছে। ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের নামে উত্তরবঙ্গেই সরকারি কোষাগার থেকে কয়েকশো কোটি টাকা লোপাট হওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।’
রণজিতের বাড়ি জয়গাঁর বিবেকানন্দপল্লিতে। এদিন বাড়ি থেকেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় জিএসটি’র আধিকারিকরা জানিয়েছেন, রণজিৎ নিজের এবং তাঁর স্ত্রীর নামে সিজিএসটি-তে দুটি আলাদা ফার্মের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলেন। নথিপত্রে পানমশলা, তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবসার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কাগজে-কলমে সেইসব পণ্য ভুটানে রপ্তানি করতেন রণজিৎ। নিয়মানুসারে সিজিএসটি পোর্টালে ব্যবসার যাবতীয় নথি আপলোড করলে তবেই ইনপুট ট্যাক্স বাবদ অর্থ পেতে পারেন কোনও ব্যবসায়ী। রণজিতের ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট পাঁচ কোটি টাকা ছাড়াতেই সন্দেহ হয় জিএসটি কর্তাদের। বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিজিএসটি’র অ্যান্টি ইভেশন ইউনিটকে। অভিযুক্তের বাড়ি ও অফিসে দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহু নথিপত্র উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা। তাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পদ্ধতি মেনে সিজিএসটি কমিশনারের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয় ওই ব্যবসায়ীকে।
সিজিএসটি সূত্রের খবর, রণজিতের তদন্তের সূত্রেই জয়গাঁ ও শিলিগুড়ির তিনজন ব্যবসায়ীর নাম পেয়েছেন অ্যান্টি ইভেশন ইউনিটের সদস্যরা। শিলিগুড়ির নয়াবাজার ও সেবক রোডের ওই ব্যবসায়ীদের অফিস রয়েছে। দুটি অফিসে ইতিমধ্যেই তল্লাশি চালানো হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি এলাকায় হানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট দুর্নীতির শিকড় এতটাই গভীর যে সিজিএসটি ডিরেক্টর জেনারেলের তরফে শিলিগুড়িতে সিজিএসটি’র বিশেষ তদন্ত ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে সেই বিশেষ দল উত্তরবঙ্গজুড়ে ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। সম্প্রতি বিশেষ দলটি চ্যাংরাবান্ধা, ফুলবাড়ি, হিলি এবং মহদিপুর- চার স্থলবন্দর এলাকায় গিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী সম্পর্কে খোঁজখবর করেছে। সবমিলিয়ে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট প্রতারণায় উত্তরবঙ্গের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর ফাঁসার আশঙ্কা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।