মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ব্রিটিশ জেলের দরজায় বোমা ছুড়ে মেরেছিলেন তিনি, তাতে পালিয়ে গিয়েছিল বন্দিরা। সেই কারণে জেল খাটতে হয়েছে। রেহাই পেয়েও থেমে থাকেননি। দেশসেবার কাজে আরও বেশি করে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। একসময় সাহচর্য পান মহাত্মা গান্ধির (Mahatma Gandhi)। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী টিকেন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়। এ বছরের প্রথম দিনে একশো বছরে পা দিলেন।
শিলিগুড়ির (Siliguri) ঘোগোমালির ‘মায়াভিলা’ নামের দোতলা বাড়িটিতে কথা হচ্ছিল সেই বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর সঙ্গে। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল খুলনা জেলায়। বর্তমানে শতবর্ষে পা দিয়ে বয়সের ভারে স্মৃতি সব সময় সহযোগিতা করে না। তবে মনের জোর যে এতটুকু কমেনি সেটা আড্ডা দিয়েই বেশ বোঝা গিয়েছে।
রবিবার সন্ধ্যায় তখন নিজের ঘর থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে সামনের বসার ঘরে আসছেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করতে চাইতেই দৃঢ়ভাবে ‘দরকার নেই’ বললেন তিনি। এরপর হাসিমুখেই শুরু করলেন কিশোর বয়সে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার গল্প। বললেন, ‘খুলনায় তখন বিলিতিদের খুব অত্যাচার বেড়েছে। বিপ্লবী নেতাদের পরামর্শে একজনকে সঙ্গী করে ট্রেনে চেপে গেলাম কলকাতা। বিশেষ জায়গা থেকে আটখানা বোমা নিয়ে ফের ট্রেনে চেপে খুলনায় ফিরলাম।’ এরপর দিন দেখে সেই বোমা নিয়ে গিয়ে ছুড়লেন বাগেরহাট জেলের দরজায়। ধরা পড়ে আড়াই বছরের জন্য জেলে যেতে হল। ফিরে এসে নতুনভাবে শুরু করলেন স্বাধীনতার লড়াই। সেদিন সন্ধ্যায় নিজের মুখেই বললেন, ‘তখন আমরা সকলেই কংগ্রেস করি।’ কথার মাঝে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন, ‘কিন্তু আমি একটু গরম দলেই ছিলাম।’
কথা বলে জানা গিয়েছে, কংগ্রেসের ভেতরে তখন চরমপন্থীদের প্রভাব খুব। বাংলা, দিল্লি, পঞ্জাব প্রদেশে তখন হাজার হাজার তরুণ সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছে। চোদ্দো বছর বয়সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই টিকেন্দ্রজিৎও সেই পথে চলতে শুরু করেন। এরপর দেশে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হলে নোয়াখালি শরণার্থী শিবির দেখভালের দায়িত্ব পান তিনি। তখনই আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা হয়।
ক্যাম্পের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবার স্বাধীন দেশের হয়ে পতাকা উত্তোলন করতে হয় তাঁকে। যদিও এই নিয়ে দীর্ঘ আক্ষেপ গেঁথে রয়েছে তাঁর মনে। স্মৃতি আউড়ে আবার বললেন, ‘দেশ তখন ভাগ হয়ে গিয়েছে। খুলনা-নোয়াখালি তখন পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অংশ। আমাকে পাকিস্তানের পতাকা তুলতে হয়েছিল।’ বলতে গিয়ে যেন চোখ ভিজে এল একটু। সামলে নিয়ে শুরু করলেন, ‘এরপর পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে আসি। চাকরি করেছি। অবসরের পর স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাঁদের পরিবারের হয়ে কাজ করেছি।’
ভারতে এসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। সরকারের তরফে উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন দপ্তরে চাকরি দেওয়া হয়। চাকরিতে যোগ দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই সেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর তৎকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য কালীপদ মুখোপাধ্যায় একপ্রকার জোর করে একটি নামী জুতো তৈরির কোম্পানিতে কাজে যোগ দেওয়ান। পদবির সঙ্গে মিল থাকায় অনেকেই মন্ত্রীর আত্মীয় ভাবতেন টিকেন্দ্রজিৎকে। তাতেও আপত্তি তাঁর। সেই চাকরিও ছেড়ে চলে আসেন শিলিগুড়িতে। কালিম্পংয়ে থাকা এক আত্মীয়ের চেষ্টায় রেলে চাকরি হয় তাঁর। কয়েক দশক রেলের গার্ড হিসেবে চাকরি করার পর ১৯৮৩ সালে অবসর নেন তিনি। মালবাহী ট্রেন, বিভিন্ন যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি এনজেপি থেকে দার্জিলিং (Darjeeling) যাওয়ার খেলনা ট্রেনেও ডিউটি করেছেন তিনি। এখনকার নেতাদের কেমন দেখছেন? জবাবে, ‘এখন আর নেতা কোথায়!’ বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের থেকে বিশেষ সম্মান পাওয়া এই স্বাধীনতা সংগ্রামী। পাশে বসে ছেলে বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘গত ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনের তরফে সম্মান জানানো হয় বাবাকে। তার আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরের তরফেও বাবাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে। সেই সময় তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধি, সিদ্ধার্থশংকর রায় সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।’ গত ১৯৮৮ সালে সরকারের তরফে মিলেছে তাম্রপত্র বা মানপত্রও। কয়েক বছর আগে একটি দুর্ঘটনার পর থেকে চলতে একটু অসুবিধা হয় এই শতায়ু স্বাধীনতা সংগ্রামীর। তবে তাতে মনের জোর যে একবিন্দু কমেনি পুনরায় নিজেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সেই কথা।