শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: ৩০ হাজার দিলেই ঘরে বসে মিলবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ সার্টিফিকেট। টাকার পরিমাণ বাড়ালেই পাওয়া যাবে চাহিদা অনুসারে নম্বর। দেড় লাখে দেওয়া হবে ডি ফার্মা, আড়াই লাখে নার্সিং সার্টিফিকেট। কোনও কিছুর জন্যই পড়াশোনা করতে হবে না। যেতে হবে না স্কুল, কলেজ কোথাওই। কড়কড়ে নোট ফেললেই মিলবে পছন্দসই ডিগ্রি। শিলিগুড়িতে (Siliguri news) থেকে এভাবেই ডিগ্রি বিক্রির (Degrees selling) জাল বিছিয়েছে একটি আন্তঃরাজ্য প্রতারণাচক্র। মাটিগাড়ার (Matigara) একটি নামকরা শপিং মলে ঝাঁ চকচকে অফিস খুলে দীর্ঘদিন থেকেই কারবার চালাচ্ছেন প্রতারকরা।
এরাজ্য ছাড়াও তাদের ফাঁদে পা গলাচ্ছেন অসম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, বিহার, সিকিমের বহু পড়ুয়া ও অভিভাবক। বেআইনি কারবারে লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেন হচ্ছে। চক্রের পান্ডারা তাদের অফিস পরিচালনার জন্য সম্প্রতি একজন ম্যানেজার সহ বেশ কয়েকজন মহিলা কর্মী নিযুক্ত করেছিল। প্রতারণার কথা আন্দাজ করতে পেরে একসঙ্গে চাকরি ছেড়েছেন মহিলা কর্মীরা। গোটা ঘটনা জানিয়ে ইতিমধ্যেই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন ম্যানেজার সৌরেন্দ্রকুমার দাস। তারপরই প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। আর এই সংক্রান্ত খবর যাতে কোনওভাবেই প্রকাশ না করা হয় তার জন্য লাগাতার ফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রতিবেদককে। লালবাজারের পুলিশ আধিকারিক পরিচয়েও এসেছে হুমকি ফোন।
চক্রের খপ্পরে পড়ে মেয়েকে নার্সিং কলেজে ভর্তি করানোর জন্য এক বছর আগে কারবারিদের দু’লাখ টাকা দিয়েছিলেন দার্জিলিং (Darjeeling) শহরের বাসিন্দা রাজেন সেইলি। এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন তিনি। রাজেনের কথায়, ‘মাটিগাড়ার শপিং মলে থাকা অফিস থেকে এমন কাজ হতে পারে ভাবিনি। এক-এক সময় এক-এক কলেজে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও ভর্তি হয়নি। ওরা দীর্ঘদিন মেয়ের আসল সার্টিফিকেট আটকে রেখেছিল।’ অনেক চেষ্টায় ৫০ হাজার টাকা এবং সার্টিফিকেট ফেরত পেয়েছেন রাজেন। কিন্তু এখনও বাকি ১,৫২,০০০ টাকা পাননি। তাঁর কথায়, ‘এখন ফোন করলে ওরা ফোন তুলছে না। আমাদের মতন আরও অনেকেই প্রতারিত হয়েছে। আমরা আইনি পদক্ষেপ করব।’
কীভাবে চলছে কারবার তা বুঝতে ডি ফার্মায় ভর্তির সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে ছাত্র সেজে আমরা গিয়েছিলাম প্রতারকদের ডেরায়। ঘরে বসে ডি ফার্মার সার্টিফিকেটের জন্য দেড় লাখ টাকা দাবি করেন কারবারিরা। জানান, মাটিগাড়ার খাপরাইল মোড় লাগোয়া এলাকা, কালিম্পং, সিকিমে তাদের বেশ কয়েকটি কলেজ আছে। সেগুলোর কোনও একটি থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। তার জন্য কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। বছরে একবার পরীক্ষার জন্য যেতে হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এমনকি পরীক্ষার যাবতীয় বন্দোবস্ত, খাতায় উত্তর লিখে দেওয়া সব ব্যবস্থাই তাঁরা করে দেবেন।
ডি ফার্মার জন্য উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া আবশ্যিক। কিন্তু সেটাও নাকি ম্যানেজ করা যায়। মুশকিল আসান করে দেন প্রতারণাচক্রের মাস্টারমাইন্ড এক অবাঙালি ব্যক্তি। জানান, ৩০ হাজার টাকা দিলেই উচ্চমাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ নম্বর সহ সার্টিফিকেট পাইয়ে দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি।
কিন্তু কীভাবে? প্রশ্ন করতেও ওই ব্যক্তি মোবাইল খুলে নানা প্রভাবশালীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন, ছবি ইত্যাদি দেখিয়ে তাঁর হাত কত লম্বা তার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কোন কোন বিশেষ ব্যক্তির ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করেছেন, তারও ফিরিস্তি দেন। তারপর জানান, সিকিম, বিহার ও আলিগড় তিনটি উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড থেকেই তিনি উচ্চমাধ্যমিকের সার্টিফিকেট এনে দিতে পারবেন। তবে এই মুহূর্তে আলিগড় বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট পাওয়া সবথেকে সুবিধাজনক। কয়েকদিনের মধ্যে অনলাইনে ওই বোর্ডের পরীক্ষা হবে৷ টাকা দিলেই তারা লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড সব দিয়ে দেবেন। তারপর তারাই অনলাইনে পরীক্ষাও দিয়ে দেবেন।
একই পদ্ধতিতে নার্সিং সার্টিফিকেট পাইয়ে দেওয়া এবং মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিও দেন চক্রের মাস্টারমাইন্ড। নামকরা শপিং মলের পাঁচতলায় রয়েছে প্রতারণাচক্রের অফিস। একটি জব কনসালটেন্সির মাধ্যমে সেই অফিসেই ম্যানেজারের কাজ পেয়েছিলেন মাটিগাড়ার তুম্বাজোতের তরুণ সৌরেন্দ্র। কিছুদিনের মধ্যেই চক্রের কাজকর্মে সন্দেহ হয় তাঁর।
সৌরেন্দ্রর বক্তব্য, ‘পুরোপুরি জাল কারবার চলছিল। খাপরাইল মোড়ের যে কলেজের ঠিকানা বলা হত বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। আমাকে দিয়ে নানা অনৈতিক কাজ করিয়ে নিতে চাইছিল। না করায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তাই সবটা ইডিকে জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। অনেক প্রমাণপত্র আছে। সেগুলো ইডি’র হাতে তুলে দেব৷’