শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: এটিএম লুট, গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, সোনার দোকানে ডাকাতির পর শিলিগুড়ির (Siliguri) ‘ক্রাইম সিরিজ’-এ নয়া সংযোজন একের পর এক ছিনতাই। গত ৪৮ ঘণ্টায় একাধিক এমন ঘটনা ঘটেছে শহর শিলিগুড়িতে। দুটি ঘটনার ভিডিও আবার ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায় (যদিও তার সত্যতা যাচাই করেনি উত্তরবঙ্গ সংবাদ)। শুধু ছিনতাই করেই ক্ষান্ত হয়নি দুষ্কৃতীরা, রীতিমতো মারধর করা হয়েছে মহিলাকে। কিন্তু একটি ঘটনাতেও পুলিশ দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আর তাতেই তেতে উঠছেন শহরবাসী।
এসবের মাঝে শুক্রবারও রবীন্দ্রনগরে ছিনতাইয়ের অভিযোগকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্য ছড়ায়। এক মহিলা দাবি করেন, টোটোয় চেপে তিনি যাচ্ছিলেন। পাশেই দুই মহিলা বসে ছিলেন। হঠাৎ টের পান, গলার হারটা নেই। এরপর চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করলে স্থানীয়রা টোটোটি দাঁড় করান। এরপর এক মহিলার হাত থেকে ওই সোনা উদ্ধার হয়। যদিও রাত পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।
প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের নজরদারি কতটা খারাপ হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। লাগাতার অপরাধের ঘটনা সামনে এনে অনেকেই শিলিগুড়িকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘অপরাধ নগরী’ হিসেবে। সোনার গয়না পরে রাস্তায় বেরোতেও রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন শহরবাসী। স্বামীজি সরণির বাসিন্দা কাকলি পাল পেশায় বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। পেশার তাগিদেই টোটোয় চেপে যাতায়াত করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক পোস্ট দেখে তিনি আতঙ্কিত। কাকলি বলছেন, ‘আর পাঁচটা মধ্যবিত্তের মতোই গায়ে সামান্য কিছু সোনার গয়না পরি। যা সব শুনছি আর দেখছি, তাতে সোনা আর পরা যাবে না। কারণ একবার কিছু খোয়া গেলে দ্বিতীয়বার বানানোর সাধ্যি নেই আর।’
কাকলির মতো ভাবনা যে অনেকেরই তা স্পষ্ট হয়েছে একাধিক মিম-এও। একটি পোস্টে যেমন লেখা হয়েছে, ‘আমি কি তবে গয়না পরব না? পরব না গয়না?’ নিমেষের মধ্যেই ভাইরাল সেই পোস্ট।
শহরে যে ক’টি ছিনতাইয়ের ঘটনা এখনও পর্যন্ত সামনে এসেছে, তাতে দুষ্কৃতীরা স্থানীয় নয় বলেই মত পুলিশের একাংশের। অভিযুক্তদের জুতো, পোশাকের ধরন থেকে টুপি পরার স্টাইল খতিয়ে দেখে তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, তারা প্রত্যেকেই ভিনরাজ্যের। সবক’টি ঘটনাতেই ছিনতাইয়ের ধরন একেবারে এক। ফলে এটি যে কোনও ছিঁচকে ছিনতাইবাজের কাজ নয়, তা একপ্রকার স্পষ্ট। পুলিশের এমন সন্দেহের পেছনে আরও একটি কারণ রয়েছে। ছিনতাইকারী হিসেবে পুলিশের খাতায় যারা দাগি দুষ্কৃতী, তারা প্রত্যেকেই নাকি এখন সংশোধনাগারে। তাহলে হয় শহরে নতুন গ্যাং তৈরি হয়েছে নতুবা বাইরের গ্যাং এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে।
প্রধাননগর থানা এলাকার, অন্যটি সম্ভবত মেডিকেল মোড় বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের। প্রথমে কোনও অভিযোগ দায়ের না হওয়ায় ভিডিও দুটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, দুটি ঘটনাই বাস্তবে ঘটেছে। প্রধাননগর থানার আইসি বাসুদেব সরকার বলছেন, ‘প্রধাননগর থানা এলাকার ছিনতাইয়ের যে ভিডিও পাওয়া গিয়েছিল, সেটার তদন্ত করে আমরা ড্রেনে পড়ে যাওয়া মহিলার খোঁজ পেয়েছি। তিনি ভয় কিংবা অন্য কোনও কারণে থানায় আসতে পারেননি। তবে উনি আজকে এসে অভিযোগ দায়ের করেছেন।’
ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল। পুলিশ অভিযোগও পেল। তারপরও কেন এখনও দুষ্কৃতীকে ধরতে পারল না পুলিশ, সেই প্রশ্ন ঘুরছে শহরে। প্রধাননগরের বাসিন্দা প্রদীপ শর্মা বলছেন, ‘শিলিগুড়ি শহরে দিন-দিন অপরাধ বাড়ছে। পুলিশের কোনও ভূমিকা দেখছি না। সবদিক থেকে পুলিশ ব্যর্থ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু’-একজনকে ধরে বাহবা পেতে চাইছে পুলিশ। কিন্তু তাতে জনগণের সুরক্ষা কোথায়?’
হাকিমপাড়ার ভাস্বতী সেনগুপ্তর খোঁচা, ‘আজকাল শহরে পুলিশের টহলদারি ভ্যান আর চোখে পড়ে না। শুধু ট্রাফিকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি পুলিশকে। ফলে শহরে অপরাধ বাড়বে না তো, কমবে!’
শুধু ছিনতাই নয়, পাড়ায় পাড়ায় চুরিও বেড়েছে গত কয়েক মাসে। এদিনও শান্তিনগর বৌবাজার এলাকার একটি বাড়িতে অভিনব কায়দায় সাইকেল চুরি যায়। দুপুরে ওই বাড়িতে আসে অপরিচিত এক তরুণ। বাড়ির মালকিন মমতা বিশ্বাস বলছেন, ‘ছেলেটি এসে আমার কাছ থেকে জল চায়। আমি গ্লাসে করে জল এনে দিই। সেটা খায়, চলেও যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি উঠোনে থাকা সাইকেলটা নেই।’ এরপর সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা যায়, মহিলার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সাইকেলটি নিয়ে উধাও হয় তরুণ। ঘটনায় আশিঘর ফাঁড়িতে অভিযোগ দায়ের করেছেন মমতা।
শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিসিপি (ওয়েস্ট) বিশ্বচাঁদ ঠাকুর অবশ্য চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগের কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘কারও কাছে কোনও তথ্য থাকলে আপনারা আমাদের এসে জানান। অযথা বিভ্রান্তিকর পোস্ট করে শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াবেন না। ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করে পাকড়াওয়ের ব্যবস্থা করছে পুলিশ (Police)।’