শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: বিছানায় সাত বছরের শিশুর দেহ শুইয়ে রাখা। পাশেই তার মায়ের দেহ। দুজনের গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর দাগ স্পষ্ট। বিছানার পাশেই সিলিংয়ে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পরিবারের কর্তার দেহ ঝুলছে। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ির (Siliguri) সমরনগর বৌবাজারের ঘটনা। পুলিশ সূত্রে খবর, মৃতদের নাম পিন্টু রায় (৭), টুম্পা রায় (২৬) ও শ্যামল রায় (২৭)। আর্থিক অনটনের কারণেই এহেন মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে বলে তদন্তকারীদের অনুমান। শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিসিপি (ইস্ট) রাকেশ সিং বললেন, ‘ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। অর্থনৈতিক সমস্যা থাকায় স্ত্রী ও সন্তানকে খুন করে ওই তরুণ আত্মঘাতী হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে আমরা মনে করছি। যে অস্ত্র দিয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে সেটিকে ওই ঘর থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে।’
ওই পরিবারটি যে অর্থকষ্টে ডুবে ছিল সে বিষয়ে প্রাথমিক তদন্তে আভাস মিলেছে। পরিবারটি সমরনগর বৌবাজারে ভাড়া থাকত। পরিবার সূত্রে খবর, টুম্পা ওই ভাড়াবাড়ির কাছেই একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকান চালাচ্ছিলেন। ভাড়া দিতে না পারায় সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি ওই দোকানটি ছেড়ে দেন। শ্যামল পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। দু’দিন ধরে তিনি কাজে যাচ্ছিলেন না। টুম্পার মা শান্তি রায় বললেন, ‘ওরা বেশ ধারদেনা করেছিল। কিন্তু কী কারণে এই ধারদেনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে ওরা কিছুই বলত না।’
প্রথমিকভাবে পুলিশকে অনুমান, বুধবার রাতেই শ্যামল স্ত্রী ও সন্তানকে খুন করেন। সকাল ৯টায় পুলিশ যখন মৃতদেহগুলি উদ্ধার করে তখন সেগুলি বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেহের রক্তও শুকিয়ে গিয়েছিল। তবে শ্যামলের দেহ তখনও নরম ছিল। যেভাবে দুটি দেহ বিছানায় রাখা ছিল তা দেখে তদন্তকারীদের অনুমান টুম্পাকে মেঝেতে খুন করা হয়। তারপর মৃতদেহ বিছানায় তুলে দেওয়া হয়। স্ত্রী ও সন্তানকে খুনের পর শ্যামল নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন।
স্ত্রী ও সন্তানের মধ্যে টুম্পাকেই আগে খুন করা হয় বলেও মনে করা হচ্ছে। দুপুরের দিকে টুম্পা তাঁর বোন রুম্পার সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছিলেন। রুম্পার কথায়, ‘এটিএম কার্ড চালু করার জন্য দিদিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য দিদি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসেও গিয়েছিল। দুজনে একসঙ্গেই বাইরে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। তারপর ও বাড়ি ফিরে যায়।’ পিন্টু বুধবার সন্ধ্যায় ওই ভাড়াবাড়ি থেকে কয়েক হাত দূরে টুম্পার বাড়িতে ছিল। শান্তি বলেন, ‘পিন্টু সকাল থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকত। মাঝেমধ্যে রাতে আমাদের বাড়িতেই ঘুমোত। বুধবার রাতে শ্যামল এসে ওকে নিয়ে যায়। পিন্টুকে রাতে খাইয়ে দেওয়ার পর ওকে শ্যামলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।’ পরিবারের জন্য শান্তি কিছুটা মাংস ও সবজিভাতও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
পরিবার নিয়ে শ্যামল গত দেড় বছর ধরে ওই ভাড়াবাড়িতে ছিল। শ্যামল আদতে সাহুডাঙ্গির বাসিন্দা ছিলেন। রাজমিস্ত্রি হিসেবে তিনি টুম্পার দাদার সঙ্গে কাজ করতেন। কাজের সুবিধার জন্য তিনি টুম্পার বাড়ির কাছে এসে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মাঝেমধ্যে কথা কাটাকাটি হলেও কোনওদিনই বড় ধরনের কোনও গণ্ডগোল হয়নি বলে ওই ভাড়াবাড়ির কর্ত্রী পূর্ণিমা কর্মকার জানিয়েছেন। বাড়িতে এত বড় একটি ঘটনা যে ঘটে গিয়েছে তা বুধবার রাতে কেউই টের পাননি। তিনি বললেন, ‘শান্তি বৃহস্পতিবার ভোরবেলা ফোন করেছিলেন। কেউ সাড়া দেয়নি। তারপর ওঁরা এখানে আসেন।’ শান্তি বললেন, ‘বহু ডাকাডাকি করলেও টুম্পারা ঘরের দরজা খুলছিল না। শেষমেশ আমার আরেক নাতি ঘরের বাইরে রাখা সিলিন্ডারের ওপর উঠে দরজার ফাঁকা দিয়ে শ্যামলকে ভিতরে ঝুলে থাকতে দেখে। এরপরই আমরা পুলিশ ডাকি।’ পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভিডিওগ্রাফি করার পর ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহগুলি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (NBMCH) পাঠায়। ঘটনাটিকে ঘিরে এদিন এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়ায়।