- শুভঙ্কর ঘোষ
সম্প্রতি রাজ্যের উচ্চশিক্ষা বিভাগের তথ্য প্রকাশে গভীর উদ্বেগের কথা জানা গিয়েছে- স্নাতক স্তরে অনেক আসন ফাঁকা। পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ৪৬১টি মহাবিদ্যালয়ে ৭২৩০ বিষয়ভিত্তিক কোর্সে পড়াশোনার জন্য নির্ধারিত আছে প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ আসন। প্রথম পর্যায়ে প্রথম রাউন্ডে পাঁচ লক্ষ আটাশ হাজারের মতো আবেদনপত্রের উপর ভিত্তি করে মেধাতালিকা প্রকাশিত হয়। পছন্দের কলেজ ও বিষয়ের জন্য নাম নথিভুক্ত হলে দেখা গেল ২৭ শতাংশ আসন ফাঁকা রয়েছে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রায় ৭৩ হাজার ছাত্রছাত্রী নাম নথিভুক্ত করলেও ৫৬ হাজারের উপর আসন ফাঁকা থেকে গিয়েছে। এখন চলছে আপগ্রেড করার পালা- পরের সপ্তাহে সশরীরে উপস্থিত থেকে যাচাই পর্ব। অগত্যা আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে- মপ আপ শুরু হবে পরের সপ্তাহ থেকে। যেভাবেই ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক, এটি নির্মম সত্য যে, আমাদের রাজ্যে স্নাতক স্তরে পড়ুয়াদের থেকে আসনসংখ্যা অনেক বেশি। প্রশ্ন উঠবেই, এটি কি এখানে হঠাৎ করে প্রকট হল, নাকি অনেক রাজ্যেও এমন? এটি নিয়ে কি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা হয়নি, নাকি আমাদের শিক্ষা জগতের ম্রিয়মাণ আলোর পাশে ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকারের আরও একটি দিক এই ঘটনা?
ভর্তি সমস্যা বিশ্বজনীন
আসন ভর্তি নিয়ে সমস্যা উচ্চশিক্ষায় নতুন কিছু নয়। শুধু ভারতবর্ষে কেন, বিশ্বের উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া থেকে পড়শি চিনেও সমস্যাটি কমবেশি অনুভূত হচ্ছে। উন্মুক্ত অর্থনৈতিক পরিবেশে কোনও শিক্ষাকোর্সের বাজার দর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত করছে পড়ুয়াদের সংখ্যাতত্ত্ব। তাই টাইমস বা অন্যান্য উচ্চশিক্ষা র্যাংকিং-এ প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ুয়া পাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে শুধু সর্বদা সচেতন নয়, পর্যালোচনা ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনী সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে নিয়মিত।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে (করোনার সময় ঊহ্য রেখেই) বলা যায়, কারিগরি শিক্ষা বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলিতে কয়েকটি উচ্চ র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বাদে অনেক আসন ফাঁকা থাকছে। এই ট্রেন্ড এখন সাধারণ বিষয়ে স্নাতক স্তরে এসে পড়েছে। শুধু আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষায় আসন ভর্তিতে এই ক্রমবর্ধমান অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার বেশ কয়েকটি নামী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পড়ুয়াদের ভর্তি ও তাঁদের বহমানতা বেশ উদ্বেগের। পদার্থবিদ্যা, অর্থনীতি, গণিত এমন সব বিষয়ে আসন তো পূর্ণ হচ্ছে না, তার উপর ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা খুব বেড়ে গিয়েছে। মেদিনীপুরের একটি নামী কলেজে দেখা গেল, একটি বিভাগে তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়াদের থেকে অধ্যাপকদের সংখ্যা বেশি।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এমন হচ্ছে কেন? কলা বিভাগ যেমন ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই সব বিষয়ে ছাত্রছাত্রী পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানের বিভাগগুলিতে এত সমস্যা হচ্ছে কেন? গেল গেল রব উঠছে- পিসিএমবি (ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথম্যাটিক্স ও বায়োলজি)-র দিন কি শেষ? সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে যেগুলি উঠে আসছে তা হল, শিক্ষা-জীবিকার সম্পর্কে উদ্ভূত নতুন রসায়ন, পড়ুয়া-অভিভাবকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার আবহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ বিমুখতা।
জাতীয় শিক্ষানীতি
২০২০ সালে গৃহীত নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে অনেক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বহুবছর ধরে অনুসৃত তিন বছরের স্নাতক পাঠক্রমের জায়গায় চার বছরের পাঠক্রম চালু হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স- এমনকি স্নাতকোত্তর না করেও সরাসরি ডক্টরেট করার সুযোগ। কোভিডের দুটি বছর বাদ দিয়ে ২০২৩ থেকে দেশজুড়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। ইন্টার্নশিপ নিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জটিলতা ও ধোঁয়াশা অব্যাহত।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, নতুন শিক্ষানীতিতে উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনার মূল উৎস হল উন্নত বিশ্বের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের পদ্ধতি ও সাফল্য। আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার মাঝে সেগুলি যথাযথভাবে রূপায়িত করা এক ধরনের হারকিউলিস তুল্য কর্মকাণ্ড। সুতরাং আশানিরাশার দোলাচলে পড়ুয়ারা যে বিদ্ধ হবে তা আগেই অনুমিত ছিল। যেমন কিছুদিন আগেও ভাবা যেতে না, অঙ্কের সঙ্গে ইংরেজি বা ইতিহাস নিয়ে উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। এই আন্তর্বিষয় নিয়ে শিক্ষার অভিঘাত এমনকি স্নাতকোত্তর স্তরেও লক্ষণীয়। আবার পড়ুয়ারা বর্ষ মধ্যে ছেদ নিতে পারেন। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়ুয়া-অভিভাবকরাও চিন্তিত তিন অথবা চার বছরের অপশন নেওয়ার ব্যাপারে- চাকরির দুনিয়ায় কোনটি বেশি উপযোগী এসব মাথায় রেখে।
আসন সংখ্যা কি অতিরিক্ত?
ভারত সরকারের ২০২১-’২২-এ আইএসএইচই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১৮-২৩ বছরের মধ্যে আছেন প্রায় এক কোটি তিন লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ছেলেমেয়ে। ছেলেরা সংখায় সামান্য বেশি- তিপ্পান্ন লক্ষ। সেদিক দিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ মেয়ের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা বেশ আশাব্যঞ্জক। স্নাতক স্তরে পড়তে আসার গড় বয়স ১৮ ধরলে মোটামুটি ২০ লক্ষ ছেলেমেয়ের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগের কম উচ্চমাধ্যমিক পেরোন। এটির অনুকূলে আরও একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। এবছর মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় নয় লক্ষ ত্রিশ হাজার- তার মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশ পাশ করেছেন। অন্যদিকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সেই সংখ্যা সাড়ে সাত লক্ষের সামান্য একটু বেশি। এখানে পাশের হার প্রায় ৯০ শতাংশ। মজার ব্যাপার, বিষয় নির্বাচনে এখন নতুন ট্রেন্ড- কলা বিভাগে তুলনামূলকভাবে সাফল্য বেশি। মেধাতালিকায় প্রথম দশে কিংবা বিশে বিজ্ঞানের একছত্র আধিপত্য শেষ। যদিও পাশের হার এখনও বিজ্ঞানে বেশি (৯৭ শতাংশ) কলা বিভাগের তুলনায় (৮৮ শতাংশ)। কারণ খুব সহজেই অনুমেয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কথা ভেবে অনেকেই বিজ্ঞান বিষয় নেয়- ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ইত্যাদি মাথায় রেখে। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ মেধার (মার্কস) ছাত্রছাত্রীরাই বিজ্ঞানে আসেন। এমনটা অন্যান্য বোর্ড যেমন সিবিএসই, আইএসসি প্রভৃতির ফলাফলেও লক্ষ করা যায়। সুতরাং উপরের সংখ্যাতত্ত্ব বলে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের স্নাতক স্তরে নির্দিষ্ট আসন সংখ্যা অতিরঞ্জিত।
পিসিএমবি
উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক স্তরে আসা পড়ুয়াদের মধ্যে একটি প্রামাণ্য অংশ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যেমন জয়েন্ট এনট্রান্স, নিট প্রভৃতিতে অসফল থাকে (কিছু ব্যতিক্রম সর্বকালে আছে)। স্নাতকে বিষয় নির্বাচন এক্ষেত্রে কেরিয়ার তৈরির তুলনামূলক পরিবেশ, স্কোপ এবং প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে। বায়োলজির ক্ষেত্রে প্রাণীবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় এবং রসায়নে পড়ুয়ারা আসছেন কারণ এগুলোর থেকে কেরিয়ার সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিজেদের আরও সময়োপযোগী ও কেরিয়ারমুখী করে তুলতে না পারলে একটা সময় আসবে যখন বিজ্ঞানভিত্তিক মানব সম্পদে টান পড়বে। এই অসাম্য দেশের বিকাশের অন্তরায়।
মূলত দশটি জরুরি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, পরিচালক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। ১. কোর্সে ভর্তির জন্য আধুনিক ম্যানেজমেন্টের সঠিক প্রয়োগ। ২. প্রতিযোগিতা সর্বত্র- প্রতিষ্ঠান বনাম প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। ৩. ডিগ্রি ছাপিয়ে অভিজ্ঞতা- এটি চান আধুনিক ছাত্রছাত্রীরা। ৪. পড়ুয়াদের মান এখন অনেক উন্নত। তাই, চাওয়া-পাওয়া চিত্র অনেক পরিণত। ৫. উন্নত প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া। ৬. পড়ুয়া ও শিক্ষকদের নিবিড় সম্পর্ক একান্তভাবে দরকার। ৭. সকলকে নিয়ে ঐক্যের পরিবেশ তৈরি। ৮. ক্রমহ্রাসমান সরকারি সহায়তার বাস্তবতা। ৯. ক্রমবর্ধমান শিক্ষা ফি বারবার পর্যালোচনা করা। ১০. পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের কার্যভার লাঘব। এইসব সামনে রেখে লড়তে হবে যাতে ভর্তি প্রক্রিয়া আরও সুসংহত থেকে পড়ুয়াদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ে। সেক্ষেত্রে আসন সংখ্যা কম ফাঁকা হবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
(লেখক কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক)