- আশিস ঘোষ
চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে যাঁরা চিলের পিছনে দৌড়োন, তাঁদের মধ্যে সাংবাদিকরা থাকেন না। অন্তত থাকার কথা নয় তাঁদের। তাঁদের কাজই হল কথাটা আদৌ সত্যি কি না, সত্যি হতে পারে কি না তা আগে যাচাই করা। তারপর তা নিয়ে কথা বলা। তার আগে নয়।
এভাবেই সিনিয়ার সাংবাদিকদের কাছে শিখেছিলাম আমরা। ভুল লেখার থেকে না লেখা ভালো, পইপই করে বলতেন তাঁরা। সেভাবেই আমরা সাংবাদিক তৈরি হতাম। সেভাবেই কাটিয়ে দিলাম চার দশকেরও বেশি সময়। এখন দিনকাল বদলেছে। এখন সার্কুলেশন আর টিআরপি-র মারকাটারি প্রতিযোগিতা। এই দৌড়ে আর সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে হবে। তাই সময় নেই খতিয়ে দেখার। তাই চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে দৌড়োতে হবে। একবার কানে হাত দিয়ে দেখার সময় তাঁদের নেই।
না, সাংবাদিকতার ক্লাস নিতে বসিনি। কথাগুলো মনে ভিড় করল গত মাসখানেক খবরের কাগজ পড়ে আর চ্যানেলে খবর দেখে। প্রসঙ্গ আরজি কর। এই ক’দিন নানারকম মুচমুচে খবরের বন্যা আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছে। বৈঠকখানা থেকে পাড়ার চায়ের ঠেক, অফিসকাছারি থেকে ট্রামে-বাসে কান পাতলেই শুনতে পাবেন নানারকম রোমহষর্ক কাহিনী। সবাই গোয়েন্দা। সবাই ষোলোআনা নিশ্চিত তাদের গল্পটাই ঠিক। আর গন্ডায় গন্ডায় সামাজিক মাধ্যম তো আরও এক কাঠি সরেস। কোথায় লাগে সিবিআই, কোথায় লাগে ইডি। সবাই সেসব দেখেশুনেই যে যার মতো তৈরি করছে তাদের মতামত।
গোয়েন্দারা যখন তদন্ত করেন তা করেন অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে। আসল অপরাধী যেন কোনওভাবে পালিয়ে যেতে না পারে, যেন কোনও প্রমাণ লোপাট না করতে পারে সেদিকে নজর থাকে তাঁদের। আমি কখনও দেখিনি সিবিআই বা অন্য কোনও তদন্ত সংস্থা রোজ সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তদন্ত কতদূর এগোল তা ঘটা করে জানাচ্ছে। যদি কেউ ভিতর থেকে গোপন খবর বের করে আনতে পারে সেটা একান্ত তার কৃতিত্ব। কিন্তু এখনকার সময়ের মুড়িমুড়কির মতো খবর বের হওয়া সম্ভব নয়। এখানে একটা সুবিধা আছে। লিখে দাও ‘সূত্রের খবর।’ তারপর যা মনে হয় লিখতে থাকো। সাংবাদিকরা সূত্র জানাতে বাধ্য নয়। তাই ধরা পড়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু খটকা লাগে না যখন দেখি সিবিআইয়ের এক এক ‘সূত্র’ এক একরকম খবর দিচ্ছে? একই বিষয়ে সত্য তো নানারকম হতে পারে না। সত্য তো একটাই। কোনটা ঠিক? খুন একজন করেছে না অনেকে মিলে, ঠিক কোথায় খুনটা হল, খুনের আগে না পরে ধর্ষণ হয়েছে, দেখবেন সিবিআইয়ের এক এক সূত্র এক এক কথা বলছে। কোনওটার সঙ্গে কোনওটার মিল নেই। কিন্তু তার ভিত্তিতেই খবর লেখা হচ্ছে। সন্ধ্যায় তা নিয়ে টিভির আলোচনায় বক্তারা নানারকম বিশ্লেষণ করছেন।
সিবিআই বা ইডি নিয়ে সাধারণ লোকজনের তেমন ধারণা থাকার কথা নয়। আগে হত না, এখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাদের ওয়েবসাইটে যে কোনও অপরাধ নিয়ে খবর আপলোড করে। তবে তা কেবল গ্রেপ্তারি বা বিপুল পরিমাণ টাকা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার খবর। আগে প্রেস নোট দিয়ে জানানো হত। কিন্তু তদন্ত নিয়ে একটা কথাও স্বাভাবিকভাবেই বলে না তারা। অনেকে আবদার জুড়েছেন, সিবিআই রোজ খানিকটা করে জানাতে পারে। তা হলে আমরা জানতে পারতাম। আবার কারও দাবি, খামবন্দি তদন্ত রিপোর্ট জানানো হোক। তা সম্ভব নয়। তাই সর্বত্র মনগড়া মিথ্যের চাষ অবাধে।
আর আছে খবরকে রোমাঞ্চকর করে তোলা যাতে লোকের মুখে মুখে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর বিক্রি বাড়ে। কী নেই সেসব কাহিনীতে। বীর্যের ওজন থেকে সন্দীপ ঘোষের নানারকম রোমহর্ষক কীর্তিকাহিনী, ঘরের দেওয়াল ভাঙা হল কেন থেকে মর্গের দেহ পাচার কী নেই। সবই জানা যাচ্ছে সিবিআইয়ের ‘সূত্র’ মারফত। এতে তদন্ত কতদূর এগোল কে বলতে পারে! কিন্তু বাজারে তা বিলক্ষণ চলছে। খবরের দুনিয়ায় ওয়াকিবহাল মহল বলে একটা কথা হরহামেশা শুনতে পাবেন। যারা সবকিছু জানেন, বোঝেন। বিশ্বাস করুন, আমি এই এতদিনের সাংবাদিকতায় সেই ওয়াকিবহাল মহল খুঁজে পাইনি।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নানারকম অডিও-ভিডিও দেখানো। তাতে অবশ্য ঝুঁকি খানিকটা কম। তলায় লিখে দিলেই হল, এই ভিডিও বা অডিওর সত্যতা যাচাই করা হয়নি। সাতখুন মাফ। যাচাই না করে ব্যবহার করা হল কেন কে জানতে চাইবে!