কলাম

অন্তর্ঘাতের কটু গন্ধে ক্রমশ ভারী বসন্ত বাতাস

  • গৌতম সরকার

ঝরাপাতা কোথাও দেখছি না। চৈত্রের শেষ দিনে তাকিয়ে দেখুন, গাছে সবুজ পাতা এসে গিয়েছে। টের পেতে না পেতে বসন্ত যেন মিলিয়ে গেল। প্রকৃতিতে বসন্তের সাজ বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী ঠেকছে। বরং গা গুলিয়ে যাচ্ছে ভোটের সব কিম্ভূতকিমাকার ছবিতে। কে যে কার সখা, দুশমনটাই বা কে, বড় বিভ্রান্তি চারদিকে। আমার অনুজপ্রতিম এক সাংবাদিককে জনৈক প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ শুনিয়ে রেখেছেন, ‘বুঝলি তো, বিজেপি’র না অনেক টাকা। সেই টাকার সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না।’

বিজেপি সাংসদ জন বারলা সদ্য গোসাঘরের খিল ভেঙেছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে। বারলা প্রচারে নেমেছেন মানে যেন হাতের মুঠোয় আকাশের চাঁদ। যাঁর কানভাঙানিতে তাঁর টিকিট জোটেনি বলে ক’দিন আগে আক্রোশে লাল হয়ে গিয়েছিলেন লক্ষ্মীপাড়া চা বাগানের প্রাক্তন শ্রমিক, সেই মনোজ টিগ্গা হঠাৎ তাঁর প্রাণের ভাই হয়ে গিয়েছেন।

তাঁর ঝকঝকে দাঁতের মতোই অধিকাংশ সময় পরনে সাদা পোশাক। হাসি সর্বক্ষণ। প্রশ্ন করলে জবাব মিলছে, তিনিই জিতবেন। কী মুশকিল, প্রার্থীর নাম মনোজ টিগ্গা। জন বারলা জেতেন কীভাবে! বড় বিভ্রান্ত লাগে। আবার অর্থবহও মনে হয়। তিন ঘাটের জল খেয়ে কালিয়াগঞ্জ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান কার্তিক পাল এবার পদ্মছাপে রায়গঞ্জে টিকিট পেয়েছেন। তাতে আবার দলের পুরোনো কিছু কর্মীর যেন পাকা ধানে মই পড়েছে।

সেই কর্মীবৃন্দ বেঁকে বসেছেন, বুথ, অঞ্চল, মণ্ডল, জেলা ইত্যাদি সব নির্বাচন কমিটিতে বিক্ষুব্ধদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব চাই। নাহলে কেস জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিস কেস তো দিকে দিকে। রাজ্যসভা সাংসদ প্রকাশ চিকবড়াইক লোকসভা নির্বাচনেও ঘাসফুলের টিকিট পেয়েছেন। মন ভার আলিপুরদুয়ারে তাঁর অনেক দলীয় সতীর্থের। ভাবটা এমন, কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না।

দলের প্রথম দিন থেকে যাঁরা আছেন, তাঁদের আক্ষেপ, প্রকাশ ছাড়া কি আর কাউকে চোখে পড়ে না দিদির। কেউ কেউ নাকি দৈববাণী শুনেছেন, প্রকাশ জিতলে সেই শূন্যপদে তাঁর রাজ্যসভায় যাত্রা নাকি সময়ের অপেক্ষা। মুশকিল হল, টিকিটের দাবিদার তো অনেক। রাজ্যসভার টিকিটের বর হয়তো বর্ষিত হবে একজনের ওপর। বাকিরা অসন্তুষ্ট হবেন। কথা হলে প্রশ্ন করছেন, দাদা আপনি তো আমাদের অনেকদিন থেকে চেনেন। আমাদের কি দলে কোনও অবদান নেই? সুযোগ পেলে ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন, ১৯৯৮-এ দল গঠনের পর কী কী করেছেন।

প্রচারে যাবেন কখন? মনের ক্ষোভ জানাতে যে বেলা যায় বহিয়া। অমনি মনের যত রাগ, ক্ষোভ ঠিকরে বেরিয়ে আসে, ধুত্তোরি দাদা প্রচার। আপনি বাঁচলে প্রচারের নাম। ভোটের বাজারে তৃণমূলের প্রতিপক্ষের তালিকায় কোথাও কোথাও তৃণমূলই। কোথাও কোথাও বিজেপিতেও তাই। মালদার এক কেন্দ্রে টিকিটের বর পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষাদীক্ষায় ঝকঝকে স্মার্ট, নিজস্ব ভাবনাচিন্তার অধিকারী শাহনওয়াজ রায়হান।

মালদার আদি নেতারা বলছেন, অত গুণ নিয়ে তিনি থাকুন, তাতে আমাদের কী মশাই! আমরা যে এতকাল খেটেখুটে দলটা করলাম, তার কি কোনও মূল্য নেই। এখন মূল্য চাই সকলের। আদি, নব্য সকলের। সবেতেই হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। প্রথমত আমি টিকিট চাই, দ্বিতীয়ত আমি টিকিট চাই, তৃতীয়ত আমি টিকিট চাই…। হ্যাঁ টিকিট। লটারির টিকিটের মতো অনেকটা। তবে সবটা নয়। বাংলার যে কোনও রাস্তায় যান বা যে কোনও মোড়ে, আপনার চোখে পড়বেই পড়বে বিশেষ কোম্পানির লটারির টিকিট কাউন্টার।

লটারির টিকিট যেন কোটিপতি হওয়ার গন্তব্যে যাওয়ার ছাড়পত্র। কোটিপতি না হলেও ১০০, ২০০ টাকার পুরস্কার জোটে আকছার। পুরস্কার না পেলেও সই। অনেকে আবার টিকিট কাটেন। একবারে না পারিলে দ্যাখো শতবার। কেউ ভগবান তাঁর দিকে তাকান না বলে আক্ষেপ করেন। বড়জোর ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। তার চেয়ে বেশিকিছু নয়। ভোটের টিকিটে কিন্তু না জিতলেই নয়।

টিকিট না পেলে দলের গুষ্টি উদ্ধার। নেতার নামে গালাগাল। সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গের ছক কষা ইত্যাদি। এছাড়াও আছে ভিন্ন ছক্কা-পাঞ্জা। শিলিগুড়ি জেলায় পাপিয়া ঘোষকে সভাপতি করেছিল তৃণমূল। রদবদলেও তাঁকে সরায়নি। কিছু কিছু নেতার তাতে ভীষণ গাত্রদাহ। পাপিয়া শিলিগুড়ির বাসিন্দা হয়েছেন বিয়ের সূত্রে। কোনও কোনও নেতার কাছে তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসা পাখি। দার্জিলিং আসনে ফল খারাপ হলে প্রমাণ করা যাবে, নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ পাপিয়া। অতএব প্রচারের ফাঁকে অন্য ছক, অপারেশন পাপিয়া।

তাতে দলীয় প্রার্থী হারলে বয়েই গেল। হতবাক হই ভাষা শুনলে। আমাকে জিততেই হবে। আমাদের না জিতলে চলবে না। দল জিতবেই… ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে মশাই, ভোটে কি কেউ নিজে জেতে। প্রার্থীকে, দলকে জেতানো হয়। কে জেতায়? জনগণ। সেই জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে সবাই নিজে নিজে জিততে চায়। একে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় ছাড়া কী-ই বা বলা যায় বলুন তো!

যদি বলেন, একবারে না পারিলে দ্যাখো শতবার। মুখ দেখলে বুঝবেন, কথাটা পছন্দ নয়। পরেরবারের তর কারও সয় না। হাত ঘোরালে মোয়া দেব’র অপেক্ষায় কেউ থাকেন না। হাত ঘুরিয়ে মুঠোয় চাঁদ চাই। যে কোনও মূল্যে। যার জন্য এত অশান্তি, এত হিংসা, এত দলাদলি। দলের মধ্যে এত অন্তর্ঘাত। এই অন্তর্ঘাত এখন কোথাও কোথাও ‘ডিসাইডিং ফ্যাক্টর।’ কোচবিহারে আদি-নব্য সাত নেতার ছবি ফ্লেক্সে টাঙিয়ে ঐক্যের প্রদর্শনী চলছে। বাস্তব? কোটি টাকার প্রশ্ন সেখানেই।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…

18 mins ago

Mamata Banerjee | সিপিএমের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন শুভেন্দু-শিশির! নাম না করেই বিস্ফোরক ইঙ্গিত মমতার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে…

34 mins ago

Malda news | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া…

43 mins ago

Abhijit Ganguli | মমতাকে নিয়ে ফের ‘কুকথা’ অভিজিতের! নির্বাচন কমিশনে তৃণমূল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিচারপতির চেয়ার ছেড়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Bjp candidate…

1 hour ago

Harishchandrapur | প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হরিশ্চন্দ্রপুরে বজ্রপাতে মৃত্যু নব দম্পতি’র

হরিশ্চন্দ্রপুর: প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারালেন এক নব দম্পতি। হরিশ্চন্দ্রপুরের (Harishchandrapur) তুলসিহাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের কুর্সাডাঙ্গি এলাকার…

1 hour ago

Malda lightning | মালদাজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি অন্তত ১১ জনের, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মালদায় বজ্রপাতে (Malda lightning) মৃত্যু হল ১১ জনের। মৃতের সংখ্যা আরও…

2 hours ago

This website uses cookies.