সৌরভ দেব ও অনসূয়া চৌধুরী, জলপাইগুড়ি: কসবা আইন কলেজের ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। এরই মধ্যে এবার জলপাইগুড়ি শহর (Jalpaiguri) সংলগ্ন একটি বেসরকারি ইংরাজিমাধ্যম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে ক্লাস চলাকালীন শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠল সহপাঠীর বিরুদ্ধে (Molestation)। ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও। ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, স্কুল কর্তৃপক্ষ সমস্ত ঘটনা জানার পরেও অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। উলটে ঘটনা ধামাচাপা দিতে কার্যত ছাত্রীর পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া ও ভয় দেখানো হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে কার্যত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে ছাত্রীটি। পরিবারের তরফে জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি) এবং মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সিডব্লিউসির চেয়ারম্যান মান্না মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ছাত্রীর অভিভাবকদের তরফে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমরা ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি।’ পুলিশ সুপার খান্ডবাহালে উমেশ গণপত বলেন, ‘ছাত্রীর পরিবারের তরফে আমাকে একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে।’
স্কুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে অধ্যক্ষকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ করা হলে তার উত্তরও দেননি। স্কুলের ক্লাস টিচার, যঁাকে ওই ছাত্রী প্রথমে ঘটনার কথা জানিয়েছিল, তাঁকে ফোন করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনেই ভুল নম্বর বলে ফোন কেটে দেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত মাসের ২৩ তারিখে। সেদিন স্কুলের প্রথম পিরিয়ডে নির্যাতিতা ছাত্রীর ঠিক পেছনের বেঞ্চেই বসেছিল তারই অভিযুক্ত সহপাঠী। ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, ক্লাস শুরুর সময় থেকে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে ওই ছাত্র অশালীন কথা বলছিল। প্রথমে সহ্য করলেও একসময় ছাত্রটি মেয়েটির গায়ে হাত দেয়। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় সে ক্লাস টিচারকে সহপাঠীর অভব্য আচরণের কথা জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াতে গেলে অভিযুক্ত তার হাত মচকে দেয়। সেইসঙ্গে হুমকি দিয়ে বলে, এই ঘটনা শিক্ষিকাকে জানালে স্কুল ছুটির পর সে দেখে নেবে।
ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, ক্লাস শেষের পর ছাত্রীটি ঘটনার কথা ক্লাস টিচারকে বলতে গেলে তিনি প্রমাণ দাবি করেন। নির্যাতিতা তখন তার দুই বান্ধবী, যারা এই ঘটনাটি ঘটতে দেখেছে, তাদের ওই শিক্ষিকার কাছে নিয়ে যায়। সেই শিক্ষিকা দুই বান্ধবী এই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট নয় বলে জানিয়ে দেন। মেয়েটির সঙ্গে ঘটা এই অভব্য আচরণ নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিতেও নির্দেশ দেন। এরপর নির্যাতিতা ছাত্রী সরাসরি স্কুলের অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানায়। অভিযোগ, অধ্যক্ষও সব শুনে একইভাবে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর ওই ছাত্রী বাড়ি ফিরে এসে বিষয়টি তাঁর মাকে জানায়। পরদিন ছাত্রীর মা অধ্যক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্কুলে যান। নির্যাতিতার মায়ের অভিযোগ, প্রথমে অধ্যক্ষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি। একাধিকবার আবেদন জানানোর পর যখন অধ্যক্ষ দেখা করলেও ঘটনাটি নিয়ে যাতে পরিবারের তরফে মিটিয়ে নেওয়া হয় সেই বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করেন। এরপর নির্যাতিতার মা তাঁর মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে লিখিতভাবে সিডব্লিউসিকে জানান। সিডব্লিউসির তরফে নির্যাতিতার পরিবারকে জানানো হয়, ঘটনার তদন্ত হবে। মেয়েকে নিয়মিত স্কুল পাঠানোর জন্য ওই পরিবারকে বলা হয়।
নির্যাতিতার মা জানান, পরবর্তীতে মেয়েকে স্কুলে পাঠালে শুরু হয় তার ওপর মানসিক অত্যাচার। অভিযুক্ত ছাত্র এবং তার বন্ধুরা মিলে মেয়েকে ওই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এখানেই শেষ নয়। ওই দিনই পঞ্চম পিরিয়ডে এক শিক্ষক ক্লাস চলাকলীন কথা বলার অভিযোেগ নির্যাতিতাকে তার নিজের জায়গা থেকে উঠিয়ে অভিযুক্ত সহপাঠী ছাত্রের পাশে বসতে বলেন। তার সাক্ষী থাকে পুরো ক্লাস। এই ঘটনায় আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নির্যাতিতা। প্রশ্ন ওঠে, ওই শিক্ষকের ভূমিকা নিয়েও। সমস্ত ঘটনা জানার পরেও কেন তিনি নির্যাতিতাকে অভিযুক্ত ছাত্রের পাশে বসতে বাধ্য করলেন? এমন প্রশ্নও ওঠে।
ছাত্রীর মা বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে স্কুলের তরফে বিভিন্ন সময় ফোন করে আমাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমরা খুবই আতঙ্কে রয়েছি। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যাতে আইনি পদক্ষেপ করা হয় তার জন্য পুরো ঘটনা মহিলা থানায় জানানোর পাশাপাশি পুলিশ সুপারকেও জানিয়েছি। আমরা মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার চাই।’