মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

শুভেন্দু নতুন কথা বলেননি, মেরুকরণের বীজ মজুতই

শেষ আপডেট:

গৌতম সরকার

চারপাশে কত ঘটনা। বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় যেন নিশ্চিত। তাতে আবার আমেরিকানদের উল্লেখযোগ্য অংশের হতাশা স্পষ্ট। সেদিন এক মার্কিন নাগরিক বলছিলেন, প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইটা দাঁড়িয়েছে অথর্ব বনাম বাটপাড়ের। তাঁর ভাষায়, তবুও ভোট দিতে হবে। ট্রাম্প বলেছেন, জিতলে গণতান্ত্রিক আমেরিকায় তিনি একদিনের জন্য হলেও ‘ডিক্টেটর’ হবেন। কী ভয়ানক! গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরাচারের বীজ। অভিবাসী বিরোধিতার পিছনে মৌলবাদ।

দেশে দেশে তাই। ফ্রান্সের সদ্য নির্বাচনে মধ্যপন্থী ও বামেরা নির্বাচনি সমঝোতা করে আসনের হিসেবে এগিয়ে আছে শুধু। প্রাপ্ত ভোটের হারে এগিয়ে অতি দক্ষিণপন্থীরাই (৩৫ শতাংশ)। যাদের কাছে গণতন্ত্র শুধুই মোড়ক। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের মূল সুরের যথার্থতা অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সংরক্ষণ নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু তাঁদের বংশধরদের জন্য কেন? কিন্তু সেই দাবি আদায়ের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এখন অরাজকতা।

লাশের পর লাশ। বাংলাদেশ কার্যত স্তব্ধ। আইনশৃঙ্খলা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। শেখ হাসিনার সরকার আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে বৈকি। কিন্তু গণতন্ত্রের খোলসটার পিছনে একনায়তন্ত্রী মনোভাব দেশের তরুণ প্রজন্মকে জেদি করে তোলায় সুযোগ পেয়ে গিয়েছে জামাত সহ বিভিন্ন মৌলবাদী শক্তি। আন্দোলনে ঢুকে পড়ে পিছন থেকে রাশ এখন কিছুটা তারাই ধরে নিয়েছে। সরকারের আলোচনা প্রস্তাবে তাই সাড়া মিলল না এখনও।

মৌলবাদ মানেই ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচারের আঁতুড়। যে আঁতুড় বরাবরই বাংলাদেশে ছিল। শেখ হাসিনার জমানায় গণতান্ত্রিক বাতাবরণের অভাব থাকায় সেই বীজ কখনও উৎখাত হয়নি। ছাত্র বিক্ষোভের জল, সার পেয়ে সেই আঁতুড় আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। হাসিনার এখন উভয়সংকট। কড়া পদক্ষেপ করলে দেশের আমজনতা বিরুদ্ধে চলে যাবে। আন্দোলন চলতে দিলে মৌলবাদ, স্বৈরাচারের বীজ ফুলেফলে বিকশিত হবে।

ক’দিন ধরে শুভেন্দু অধিকারীর ধর্ম সংক্রান্ত মন্তব্যে বাংলা তোলপাড়। অথচ শুভেন্দু সংঘ পরিবারের মনের কথাই বলেছেন। এখন সমালোচনা এড়াতে সুকান্ত মজুমদার বলছেন, শুভেন্দুর কথা দলের সায় নেই। কিন্তু হিন্দুত্ব যে সংঘ পরিবারের চাবিকাঠি, তা কি অস্বীকার করতে পারেন তিনি? লোকসভায় রাহুল গান্ধির হিন্দুত্বে হিংসার স্থান নেই মন্তব্যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর রে-রে করে ওঠার নজির তো সামনেই। অমিত শা কতবার ‘ঘুসপেটিয়া’ বলে মুসলিমদের নিশানা করেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসা এবং সরকারে টিকে থাকার পিছনে আবার বিপরীত ধর্মীয় অবস্থান। সেই অবস্থানের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুরো মুসলিম সমাজকে সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে বিজেপিই। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি বিরোধীরা জিতলে দেশটা তো বটেই, মা-বোনদের মঙ্গলসূত্র মুসলিমদের হাতে তুলে দেবে বলে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। বিজেপি যত এই প্রচার করেছে, তত মুসলিম সমর্থন বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী বিরোধী দলের দিকে ঝুঁকেছে।

কিন্তু হিন্দু ভোট পুরোপুরি পদ্মের প্রতীকে সংহত হয়নি বলেই গোটা দেশে বিরোধীদের আসন বেড়েছে। বাংলায় বিজেপি পিছিয়ে পড়ে। যে কারণে শুভেন্দু আক্ষেপ করছেন, মুসলিমদের দিয়ে ভোট লুঠ করিয়েছে তৃণমূল। কাঁথির অধিকারী পরিবারের মেজপুত্রর মুসলিম বিদ্বেষ হঠাৎ জন্ম নিয়েছে মনের করার কারণ নেই। মনের মধ্যে ছিলই। তৃণমূলে থাকাকালীন ভোটে জেতার তাগিদে মুসলিম সখ্য রেখে চলেছেন মাত্র। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলন তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে, সেই নন্দীগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তাদের নিয়ে তিনি তৃণমূলে পথ চলেছেন।

বিজেপিতে যোগ দিয়ে নিজেকে ‘সনাতনী’ বলতে শুরু করলেন বটে, কিন্তু সনাতনী তিনি মনে মনে বরাবরই। শুভেন্দুর ধারণা ছিল, এই বীজ ছড়িয়ে তিনি নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ারটার দখল নিতে পারবেন। না পারায় রাগে, ক্ষোভে, সর্বোপরি হতাশায় তাঁর মুখে খোদ নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগানের বিরোধিতা বেরিয়ে এসেছে। তিনি ‘যো হামারা সাথ হ্যায়, হাম উনকা সাথ রহেগা’ তত্ত্বের সওয়াল করলেন নিতান্ত অপারগ হয়ে।

শুভেন্দু জানেন, মেরুকরণের এই পুঁজি না থাকলে বিজেপি নিঃস্ব। তিনি এটাও বোঝেন, তাঁর দল ভোটে না জিতলেও মেরুকরণের বীজ বাংলায় ছড়িয়ে আছে। ভোটব্যাংকের রাজনীতির স্বার্থে মমতা কখনও কট্টরভাবে সেই বীজ উৎখাতের চেষ্টা করবেন না। বরং কখনও চণ্ডীমন্ত্র, কখনও শিবের স্তব আউড়ে ভারসাম্যের ‘খেলা হবে’ চালিয়ে যাবেন। মেরুকরণের বীজের ঐতিহাসিক উৎস তো লুকিয়ে আছে দেশভাগজনিত ক্ষতের মধ্যে। তার পূর্ণ নিরাময়ের চেষ্টা কখনও হয়নি। বাংলায় একসময় বামপন্থী পরিসর বেশি ছিল বলে সামান্য সহাবস্থানের প্রলেপ ছিল মাত্র। কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থে ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নেওয়ায় বামেরা মেরুকরণ নির্মূলে কট্টরভাবে গণসচেতনতা সৃষ্টির দিকে যায়নি। কলকাতায় সিপিএম সমর্থক আমার এক সহকর্মীকে সগর্বে বলতে শুনেছি, মার্কসবাদ পরে, আগে তো আমরা হিন্দু। বাংলায় ছড়িয়ে থাকা এই মানসিকতাকে শুভেন্দু উসকে তুলতে মরিয়া। বিজেপিও তাই চায়।

শুধু সরকারে থাকার বাধ্যবাধকতায় বিবৃতি দিয়ে, শুভেন্দুর বক্তব্য খারিজ করতে হল সুকান্ত মজুমদার, শমীক ভট্টাচার্যদের। বীজ কিন্তু থেকেই গিয়েছে। ভোটে হারজিতের সঙ্গে যে বীজের উৎপাটিত হওয়ার সম্পর্ক নেই। মেরুকরণ শেষপর্যন্ত মৌলবাদের জন্ম দেয়, তা সে হিন্দুত্ব হোক আর মুসলিম। যার পরিণতি কট্টরবাদ, একাধিপত্যের মানসিকতায়। বহুত্ববাদের যে ধারণার কথা বলা হয় ভারতে, তা আসলে তত্ত্বগত। বাস্তবের সঙ্গে মিল কম। মানসিকভাবে ভারত তাই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়ে উঠতে পারেনি, নিছক বহু ধর্মের দেশ হয়ে থেকে গেল।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

দিশাহীন শিক্ষায় জীবিকা মরীচিকা

ডঃ অঞ্জন চক্রবর্তী শিক্ষা আর জীবিকার সম্পর্ক বোঝার জন্য খুব...

Suicide | আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ছে পড়ুয়ারা, উদ্বেগ সমীক্ষায়

সুদীপ মৈত্র: প্রতি মিনিটে দুনিয়ার কোথাও না কোথাও, কেউ...

হিমন্তই রোল মডেল শুভেন্দু, শংকরদের

রূপায়ণ ভট্টাচার্য গাড়িটা তখন বিধানসভার কাছেই। অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে কলকাতার...

হিন্দির উগ্র আগ্রাসন রোধে যুদ্ধে দ্রাবিড়ভূমি

  আশিস ঘোষ ‘তামিলকে রক্ষা করতে আমি মৃত্যুর সিদ্ধান্ত...