শংকর
বিবেকানন্দ ২৪ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। শঙ্করাচার্য গৃহত্যাগী হয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার আগে তাঁরা সংসারেই পরম আদরে লালিতপালিত হয়েছেন। আসলে, সন্ন্যাসী হয়ে তো কেউ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন না।
নরেন্দ্রনাথের সংসারে আমরা একটু চোখ রাখি। বিলে ওরফে নরেন্দ্রনাথের জন্ম প্রকৃত অর্থে সোনার সংসারে। বিলে নামটি নিয়ে একটি ঘটনা বলি। একবার বিবেকানন্দর গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দেবী বেলুড় মঠে এসেছেন। এসেই একতলা থেকে উঁচু গলায় বিশ্ববিজয়ী ছেলেকে ডাক দিলেন, বিলু-উ-উ। মায়ের গলা শুনে বিবেকানন্দ তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। এবং নীচু গলায় মায়ের সঙ্গে কথাবার্তায় ডুবে গেলেন।
বিলের ছেলেবেলার কথায় ফিরি। ভুবনেশ্বরী দেবী ছেলের দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে বলেছিলেন, ‘চেয়েছিলাম শিবকে, পেলাম এক ভূতকে।’ সত্যি বলতে, এমন কথা সব দেশের সব মায়েরাই বোধহয় তাঁদের দস্যি ছেলেদের বলে থাকেন। ছোটবেলায় বিলের মতো বোম্বেটে ছেলেকে সামলানোর জন্য একজন নয়, দুজন পরিচারিকা রাখা হয়েছিল। তাঁদের দুজনকেই হিমসিম খাইয়ে ছাড়তেন বিলে। মায়ের কাছে চিরকালের বিলু হয়েই ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তবে কীভাবে বিলে অথবা বীরেশ্বর নরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন, সেই রহস্য জানা নেই।
এখানে বলে রাখি, বিলু ভুবনেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন না। যদিও পরবর্তী সময়ে বীরেশ্বরকেই বড়ছেলের সমস্ত দায়িত্ব মাথাপেতে নিতে হয়েছিল। সংসারত্যাগী হয়েও সেই বিরাট মানসিক দায়িত্বকে তিনি কোনও দিন স্বার্থপরের মতো দূরে সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেননি। বিশ্বজগতে অনেকেই সন্ন্যাসী হয়েছেন, কিন্তু পরিবার ও বৈরাগ্যের উভয়সংকট এবং তার বিস্ময়কর সমাধানই বিবেকানন্দকে বিবেকানন্দ করে তুলেছিল।
বিলুর যে বীরেশ্বর নাম, তা ভগিনী নিবেদিতাই বোধকরি প্রথম সেই অর্থে সর্বসমক্ষে এনেছিলেন। বিলুর আরেকটি ডাকনাম ছিল। যে মানুষটি দীর্ঘদেহী, পৌনে ছ-ফুট লম্বা, তাকে তাঁর ন’ঠাকুরদা গোপাল দত্ত বেশ মিঠে একটা ডাকে ডাকতেন। ডাকতেন ‘বেঁটে শালা’ বলে। এই বিশেষণ ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়, দত্ত পরিবারের পূর্বসূরিরা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কতটা ছিলেন! সবমিলিয়ে বিবেকানন্দরা ছিলেন দশ ভাইবোন। ভুবনেশ্বরীর প্রথম সন্তানটি ছিল পুত্র। তার অকালে মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। এই সন্তানের অভাবনীয় সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন ভুবনেশ্বরী দেবী। সে ছেলে ছিল নাকি পিতামহের মতো দেখতে। একটি সূত্রে জানা যায়, ভুবনেশ্বরীর প্রথম সন্তানটি মাত্র আট মাস বয়সে মারা যায়। পরের সন্তানটি কন্যা। তারও মৃত্যু হয় শৈশবে। নাম পর্যন্ত জানা যায় না। এই কন্যাটি আড়াই বছর বেঁচেছিল। তৃতীয় সন্তান হারামণি মাত্র ২২ বছর বেঁচেছিলেন। এঁর সম্বন্ধেও তেমন কিছু তথ্য মেলে না। চতুর্থ সন্তান স্বর্ণময়ী। তিনি অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। স্বামীজির ভিটেতেই বসবাস করেছেন দীর্ঘদিন। এই দিদিটি ভাই নরেনের প্রতি বেশ স্নেহশীলা ছিলেন। নরেনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রতি বছর স্বর্ণময়ী বেলুড় মঠে দশ টাকা পাঠাতেন। এমন কথা উল্লেখ করেছেন বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ। রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যরা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন দিদি এই টাকা পাঠিয়ে গিয়েছেন। টাকা পাঠানো বা চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি শুরু করেছিলেন বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী। হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, নচেৎ স্বামী প্রেমানন্দ বাড়ি থেকে এই টাকা নিয়ে যেতেন।
ভুবনেশ্বরীর পঞ্চম সন্তানটিও ছিল কন্যা। তার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ছ-বছর বয়সে। নরেন্দ্রনাথ আসলে ভুবনেশ্বরীর ষষ্ঠ সন্তান। বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। সপ্তম সন্তান কিরণবালা আনুমানিক ১৮-১৯ বছর বেঁচেছিলেন। গর্ভের অষ্টম সন্তান বেঁচেছিলেন আনুমানিক ২৫ বছর। নবম সন্তান মহেন্দ্রনাথ ও দশম ভূপেন্দ্রনাথ। বংশের এই দুই কনিষ্ঠ সন্তান বেঁচেছিলেন যথাক্রমে ৮৮ বছর ও ৮১ বছর। ভুবনেশ্বরীর কন্যাদের পরিবারের খবরও তেমন বিস্তারিত পাওয়া যায় না।
বিবেকানন্দের জন্মভিটে অধিগ্রহণের জন্য একসময় বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল মঠ-মিশনকে। মহারাজদের সে এক প্রাণান্তকর পরিশ্রম। পার্থ মহারাজ অর্থাৎ স্বামী বিশোকানন্দ ছিলেন মূল দায়িত্বে। তাঁর সূত্রেই জানা যায়, গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের জমি অধিগ্রহণের সময় বেশ কয়েকজনকে পুনর্বাসিত করতে হয়েছিল। তাঁদের দেওয়া হয়েছিল নতুন ফ্ল্যাট। এঁরা প্রত্যেকেই বিবেকানন্দের বোনের দিক থেকে বংশধর। কারণ, ভুবনেশ্বরীর তিন পুত্রসন্তানের কেউই বিয়ে করেননি। একটি সূত্রের খবর, যোগীন্দ্রবালা নামে যে বোন স্বামীজির পরিব্রাজককালে সিমলা পাহাড়ে শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করে নিজের জ্বালা জুড়িয়েছিলেন, তাঁর দুটি নাবালিকা কন্যার দায়িত্বও একসময় নিতে হয়েছিল নিঃসম্বল ভুবনেশ্বরী দেবীকে। আরেকটি খবর, ভুবনেশ্বরীর এই জামাই পুনরায় বিয়ে করেন। ভুবনেশ্বরী সেই জামাই এবং নতুন বৌকে নিজের বাড়িতে এনে আপ্যায়িত করেছিলেন। এর থেকে বোঝা যায়, বঙ্গদেশে ভুবনেশ্বরী দেবীর মতো মায়েদের মন কতটা বড়! আবার কতটা বেদনাদায়ক ঘটনা মায়েরা মুখ বুজে সহ্য করে নিজের কর্তব্য পালন করতে পারেন।
স্বামীজির দিদি ও বোনেদের সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— বড় দুই দিদি ইংরেজি শিক্ষার আলোকলাভ করেছিলেন। তাঁরা বেথুনে পড়ার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ছোট দুই বোনও মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদুষী হয়েছিলেন। বলে রাখি, বাবার মৃত্যুর সময় বিবেকানন্দের বয়স ছিল ২১ বছর। মেজো ভাই মহেন্দ্র তখন ১৫ এবং ভূপেন্দ্রনাথ নিতান্তই কম বয়সের, মাত্র তিন।
দশ সন্তানের মা ভুবনেশ্বরী দেবী। অকালবৈধব্যে জর্জরিত হয়েও কী বিপুল দুঃখের বোঝা আমৃত্যু তিনি নিঃশব্দে বহন করেছিলেন! স্বামীজিও যে ঘরের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য উতলা হতেন না, তা নয়। বিভিন্ন চিঠিতে তার উল্লেখ আছে। মহাবৈরাগ্য অবস্থায় একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি অতি অকৃতী সন্তান, মাতার কিছু করিতে পারিলাম না, কোথায় তাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলিয়া আসিলাম।’ এই চিঠি যেন মায়ের কাছে স্বামীজির ক্ষমা চাওয়ার শামিল।
সিমলে পাড়া। সিমলার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়ি। এঁরা ছিলেন দক্ষিণরাঢ়ি কাশ্যপগোত্রীয়। এঁদের বিপুল বিত্তসম্পদের পিছনে ছিল বংশানুক্রমে আইন ব্যবসায় সাফল্য। সেই সূত্রেই বিবেকানন্দও আইন পড়েছিলেন। অ্যাটর্নি হিসাবে অফিসে শিক্ষানবিশি করেছিলেন। অথচ সেই তিনি মেজো ভাই মহেন্দ্রনাথ বিলেতে আইন পড়তে হাজির হয়েছেন শুনে বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। একদিকে নিজের আর্থিক টান, অন্যদিকে বিলেতে ভাইয়ের খরচ চালানোটা সহজ নয় বলেই হয়তো! যাইহোক, উকিল ও অ্যাটর্নিতে ভরা সিমলের দত্ত পরিবার। এই বংশের বিপুল সমৃদ্ধি যেমন ওকালতি থেকে, তেমনি পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্ব হারানোর দুর্ভাগ্যও এই পরিবারের কপালেই জুটেছে। কষ্ট হয় এই ভেবে যে, জাগ্রত বিবেক বিবেকানন্দের স্বল্পপরিসর জীবনকে সর্বক্ষেত্রেই বিষময় করে তুলেছিল এই জ্ঞাতি শত্রুতা। হয়তো বা, নিতান্ত স্বল্প বয়স থেকে দুর্বিষহ যন্ত্রণা না ভোগ করতে হলে তিনি আরও কিছুদিন এই ধরাধামে থাকতে পারতেন।
এই যে দত্ত বংশ, এঁদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটানা বা দেরেটনা গ্রাম। এই গ্রামেরই মানুষ রামমোহন দত্ত। নরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। সুপ্রিম কোর্টের ফারসি আইনজীবী ছিলেন। অভিজাত জীবনযাপন করেও তিনি বহুল পরিমাণে অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন। সালকিয়ায় তাঁর দুটো বাগানবাড়ি ছিল। খিদিরপুরেও ছিল প্রচুর জমিজমা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কলেরায় রামমোহনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে রেখে যান এক বিধবা কন্যা ও দুটি শিশুপুত্রকে। রামমোহন দত্তের বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদ। বিবেকানন্দের পিতামহ। তিনিও অ্যাটর্নি অফিসে যুক্ত ছিলেন। দুর্ঘটনায় তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তন হয়। যৌথ পরিবার। সেই পরিবারে তাঁর স্ত্রী অপমানিত হচ্ছেন, এই দুঃখে দুর্গাপ্রসাদ একবার বসতবাটী ত্যাগ করেছিলেন। পরে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেছিলেন। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার পরও দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসতেন। ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাস করতেন। একবার তাঁকে ঘরে আটকে রাখবার জন্য দরজায় তালা লাগানো হয়। তিনদিন পরে দেখা যায়, তাঁর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই যে ঘর ছাড়লেন দুর্গাপ্রসাদ, আর কখনও ফেরেননি।
বাবার এইরূপ অবস্থার কারণে, স্বামীজির বাবা বিশ্বনাথ দত্তকে তাঁর কাকার করুণায় প্রায় অনাথরূপে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বারকয়েক ব্যবসার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। পরে অবশ্য আইনি ব্যবসায় সাফল্যলাভ করেন। স্বামীজির বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবের কারণে সেই বইটি ঠাকুরদার খুড়তুতো ভাই, ডাক বিভাগের পদস্থ কর্মচারী গোপালচন্দ্র দত্তের নামে প্রকাশিত হয়। অন্যের নামে নিজের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের একই দুর্ভাগ্য পুত্র বিবেকানন্দের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। পূর্বাশ্রমে অপরের নামে, এমনকি প্রকাশকের নামে নরেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটা বই লিখেছিলেন। সেই লেখা থেকে অতি সামান্য অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল গানের বই, ইংরেজি কথোপকথনের বই এবং বাংলা অনুবাদের বই।
অন্যদিকে, গর্ভধারিণী জননী ভুবনেশ্বরী দেবীও কোনও অংশে কম ছিলেন না। মা-বাবার নয়নের মণি ছিলেন তিনি। তাঁদের একমাত্র সন্তান। অসামান্যা সুন্দরী, সুগায়িকা এবং শ্রুতিধর। একবার শুনে যে কোনও কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন। স্মৃতিশক্তির এই আশীর্বাদ পেয়েছিলেন তাঁর দুই সন্তান, বিবেকানন্দ ও মহেন্দ্রনাথ।