Wednesday, April 24, 2024
HomeMust-Read News৮৭'র রক্তাক্ত দীপাবলি আজও ভুলতে পারেনি চিত্তরঞ্জন পার্ক

৮৭’র রক্তাক্ত দীপাবলি আজও ভুলতে পারেনি চিত্তরঞ্জন পার্ক

নয়াদিল্লি: তখন রাত ৯টা। দীপাবলির আলোয় ঝলমল করছে দক্ষিণ দিল্লির ‘মিনি কলকাতা’ চিত্তরঞ্জন পার্ক। ই, এফ, জি ব্লক, মার্কেট টু, মেলা গ্রাউন্ডে মানুষের ভিড়। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বসে গেছে মাতৃ প্রতিমা, চলছে শ্যামা পুজোর আয়োজন, এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে খেলছে বাচ্চারা, উৎসবের আমেজে মগ্ন আট থেকে আশি, সি আর পার্কের প্রবাসী বাঙালিরা।

ঠিক সেইসময় দেখা যায়, রাতের অন্ধকার চিড়ে রাস্তা দিয়ে সজোরে ছুটে আসছে একটা বাইক। তাতে বসে তিনজন, যাদের মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে, শুধু চোখদুটি খোলা। কিছু বোঝার আগেই গর্জে ওঠে স্টেনগান, রিভলবার। চলল গুলি নির্বিচারে, বলা ভালো; গুলির ফোয়ারা। মুহূর্তের মধ্যে সি আর পার্কের প্রকাশ্য রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন অসংখ্য মানুষ৷ আর্তনাদ, মারণ চিৎকারে ভরে ওঠে গোটা অঞ্চল। কিন্তু গুলির শব্দ থামেনি।

কিছুক্ষণের মধ্যে সব শান্ত, গোটা অঞ্চলজুড়ে নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা। শ্মশানই বটে, রাস্তাজুড়ে তখন রক্তের স্রোত, এদিক-ওদিক পড়ে আছে অসংখ্য মৃতদেহ, অধিকাংশ বাঙালি, আর্তনাদ হাহাকার করছেন গুলিবিদ্ধ আহতরা। স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙে পড়েন বহু মানুষ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গুলির দাগ এমনকি বহু স্থানে মাতৃ প্রতিমার গায়ে ছিটকে এসে লেগেছে রক্ত। সে এক নারকীয় পরিস্থিতি। পুলিশের মতে, মৃতের সংখ্যা ১১, আহত আরও বেশি। মায়ের কোলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল কয়েক মাসের এক শিশু। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। দিনটি ২০ অক্টোবর, ১৯৮৭ সাল। সে বছর দীপাবলির রাতে নরমেধ যজ্ঞ হয়েছিল সিআর পার্কে৷ সৌজন্যে, ভিন্দ্রানওয়ালা টাইগার ফোর্সের তিন জঙ্গী – অমৃতপাল সিং, পরমজিত সিং ও সুবেদার সিং৷ দীপাবলির রাতে সেই বছর মিনি জালিয়ানওয়ালাবাগে পরিণত হয় দক্ষিণ দিল্লির এই বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল।

দেখতে দেখতে কেটেছে ৩৬ বছর। ১৯৮৭ সালের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আঁকড়ে ফের মাতৃবন্দনায় মেতে উঠেছে চিত্তরঞ্জন পার্ক। কিন্তু আজও বহু মানুষ আছেন, সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে বার বার শিউরে ওঠেন। অঞ্চলের প্রবীণ নাগরিক, ৭৮ বর্ষীয় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিনোদ বিহারী সান্যাল বলেন, ‘কালীপুজোর রাত এলেই সেই ভয়াবহ দিন মনে পড়ে। তিনজন বন্ধুকে হারাই সে রাতে। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেরতে পারিনি, প্রাণে বেঁচে যাই।’ সরকারি কর্মী মণীন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘তখন এক অস্থির সময়, মাত্র ৩ বছর আগেই নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে ‘অপারেশন ব্লু স্টারে’র মূল্য চোকাতে হয় তাকে। এরপর গোটা দিল্লি জুড়ে ভয়াবহ শিখ গণহত্যার আগুন, রাজীব গান্ধি বলছেন, মহীরুহ পতন হলে মাটি এভাবেই কেঁপে ওঠে, খলিস্তানি শিখ আন্দোলনে পুড়ছে পঞ্জাব, চণ্ডীগড়, হরিয়ানা…’ মণীন্দ্রবাবুর প্রশ্ন, ‘কিন্তু এতে দিল্লির শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা কী অপরাধ করল? কেন এভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হল তাদের?’

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী এন কে ভার্মা বলছেন, ‘৮৭-র দিওয়ালির অভিশপ্ত রাতে কেন বাঙালি অধ্যুষিত সিআর পার্কে হামলা চালাল খলিস্তানি জঙ্গীরা তা নিয়ে বহু মতভেদ আছে। তবে একটি অংশ মনে করেন, পঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের একাধিক সিদ্ধান্তে বেজায় খাপ্পা ছিল খলিস্তানিরা, বিশেষ করে খলিস্তানির ‘মাথা’ জার্নাল সিং ভিন্দ্রানওয়ালা সিদ্ধার্থবাবুকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লাগে। সেই আক্রোশ থেকেই চিত্তরঞ্জন পার্কের বাঙালীদের উপর এই হামলা, মনে করেন অনেকেই।’ এন কে ভার্মার দাবি, ‘এই আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড কুখ্যাত বিটিএফকে (ভিন্দ্রানওয়ালা টাইগার ফোর্স)-র জঙ্গি নেতা সুরজিত সিং পেন্টা। তারই নির্দেশে চিত্তরঞ্জন পার্কে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় তিন জঙ্গি। নরসংহারের পরেই তারা অঞ্চল ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলে দিল্লি পুলিশের বিশাল বাহিনি তাদের ধাওয়া করে৷ গ্রেটার কৈলাশের কাছে একটি প্যাসেঞ্জার বাসে উঠে পড়ে তারা। কিন্তু পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে। শুরু হয় গুলির লড়াই। এক জঙ্গি সুবেদার সিং’র পায়ে গুলি লাগলে, অন্য জঙ্গিরাই তাকে গুলি করে মেরে দেয়, এতটাই নৃশংস এরা।’ পরে অবশিষ্ট দুই জঙ্গিকেও খতম করা হয় দিল্লির উপকণ্ঠে। পরের বছর এসটিএফ-র হাতে নিকেশ হয় সুরজিত সিং পেন্টা।

পুলিশি তথ্যে জানা যায়, সে রাতেই চিত্তরঞ্জন পার্কে ছুটে আসেন অটলবিহারি বাজপেয়ী, এল কে আদবানি সহ অসংখ্য প্রথমসারির নেতারা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নির্দেশে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি সহ আরও অনেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বুটা সিং দিল্লি পুলিশ কমিশনার বেদ মারওয়ার সঙ্গে ‘সি আর পার্ক ম্যাসাকার’ নিয়ে জরুরি আলোচনায় বসেন গভীর রাতে। নিহত ও আহতদের দেওয়া হয় সরকারি সাহায্য, ক্ষতিপূরণও। সে বছর দিল্লিতে ১৫০, পঞ্জাবে প্রায় ৭০০ মানুষ প্রাণ হারান এই খলিস্তানি সন্ত্রাসে। ৩৬ বছর পেরিয়ে আবারও যখন খলিস্তানি আগ্রাসন নিয়ে ভারত-কানাডা সম্পর্ক নিম্নমুখী, ভিন্দ্রানওয়ালার জায়গা দখল করেছেন নিষিদ্ধ সংগঠন শিখস ফর জাস্টিসের প্রধান গুরপতবন্ত পান্নু; সেই আবহে চিত্তরঞ্জন পার্কে আলো ঝলমলে কালী মন্দির প্রাঙ্গনে বসে অশীতিপর নির্মলেন্দু সেন বলেন, ‘সেই রাত আজও দু:স্বপ্নের মতো তাড়া করে। শিখ দাঙ্গার সময় এই অঞ্চলের বাঙালিরাই বহু মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়৷ অথচ কালীপুজোর রাতে সেই অসহায়, নির্দোষ মানুষদের উপরেই চলেছিল গুলি৷’ কালীমন্দিরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে নির্মলেন্দু বাবুর দাবি, ‘মায়ের কাছে প্রার্থনা, সেই রাত যেন আর না ফেরে। শান্তি আসুক সবার জন্য।’

Sucharita Chanda
Sucharita Chandahttps://uttarbangasambad.com/
Sucharita Chanda is working as Sub Editor Since 2020. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Anubrata Mandal | মমতার মুখে কেষ্ট স্তুতি, ‘মাটির ছেলে’ বলে দরাজ সার্টিফিকেট তৃণমূল সুপ্রিমোর

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে ‘কেষ্ট স্তুতি’।বুধবার প্রার্থী অসিত মালের প্রচারে গিয়ে জনসভা থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো একের পর এক শব্দবন্ধ ব্যবহার...

Ramdev | ফের সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে ক্ষমাপ্রার্থনা রামদেবের, সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পরই পদক্ষেপ

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মঙ্গলবারের পর ফের বুধবার সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন রামদেব (Ramdev)। পতঞ্জলির (Patanjali) বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন মামলায় বারবার সুপ্রিম কোর্টের...

Vivek Agnihotri | বড় ঘোষণা বিবেক অগ্নিহোত্রীর, ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর পর এবার আসছে ‘দ্য দিল্লি...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ (The Kashmir Files) এর পর এবার বড় ধামাকা দিতে চলেছে পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী (Vivek Agnihotri)। শীঘ্রই বড়...

Cooch Behar | সময় লেগে যায় এক বছর, কোচবিহারে আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা

0
শিবশংকর সূত্রধর, কোচবিহার: গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। কাঠফাটা রোদে স্বস্তি পেতে অনেকেই রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া আখের রসে গলা ভেজাচ্ছেন। চাহিদার তুলনায় কম হলেও কিছু...

Nandigram | নন্দীগ্রামে দেবাংশুকে দেখেই ‘চোর-চোর’ স্লোগান, প্রচারে বাধা পেয়ে এলাকা ছাড়লেন তৃণমূল প্রার্থী...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশুকে লক্ষ্য করে 'চোর চোর' স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠল নন্দীগ্রাম। অভিযোগ, এদিন সকালে নন্দীগ্রামে প্রচারে গেলে দেবাংশু ও...

Most Popular