রণবীর দেব অধিকারী, রায়গঞ্জ: রায়গঞ্জ (Raiganj) শহরের মহাত্মা গান্ধি রোড ধরে শিলিগুড়ি মোড়ের দিকে এগোলে বন্ধ সিনেমা হল আশা টকিজ। একটু আগেই ডান হাতে বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণীর প্রাসাদোপম বাড়ি। আরেকটু এগিয়ে জাতীয় সড়ক পেরিয়ে কর্ণজোড়ার দিকে কয়েকশো মিটার গেলে বাঁ-দিকে একটি পাঁচতলা আবাসন। ভালো করে তাকালে চোখে পড়বে, আবাসনের তিনতলার ব্যালকনির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সাংসদ। ফ্লেক্সের গায়ে লেখা- সাংসদ কার্যালয়, দেবশ্রী চৌধুরী (Debasree Chaudhuri)।
সময়ের নিয়মে ফ্লেক্সবোর্ডের রংও খানিকটা ফ্যাকাসে হয়েছে। রায়গঞ্জে এলে এই ভাড়া ফ্ল্যাটেই থাকেন দেবশ্রী। গত পাঁচ বছর ধরে এটাই তাঁর অফিস কাম অস্থায়ী ঠিকানা। তবে, পথচলতি মানুষের নজর পড়ে না সাংসদের কার্যালয়ের দিকে।
প্রশ্ন হল, সাংসদের কাজের দিকেও কি নজর পড়ে সাধারণ মানুষের? এই ঠিকানায় সাধারণ মানুষ কতটা পান সাংসদকে? বেশ কিছুদিন ধরে প্রশ্নটা উঠেছে বিজেপির (BJP) অন্দরেও। দলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী বলে পরিচিত সেই পদ্মপ্রেমীরাই আওয়াজ তুলেছেন, রায়গঞ্জে এবার ভূমিপুত্র প্রার্থী চাই। এই দাবিতে রাস্তায় দণ্ডি কেটে আন্দোলনেও নেমেছেন গেরুয়া শিবিরের দেবশ্রী বিরোধী কিছু মানুষ। তঁাদের অভিযোগ, সাংসদ কদাচিৎ রায়গঞ্জে থাকেন। কাছে পাওয়া তো দূরস্থান, রাজনৈতিক বা বিশেষ কোনও কর্মসূচি ছাড়া তঁাকে নাকি দেখতেও পায় না সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ জনসংযোগ নেই বিদায়ি সাংসদের। শুধু তাই নয়, এলাকার উন্নয়ন করার ক্ষেত্রেও তিনি নাকি মানুষের মনে তেমন দাগ কাটতে পারেননি।
প্রশ্ন শুনে সাংসদের ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতা একটি তালিকা দিলেন। সেই তালিকায় চোখ বুলিয়ে বোঝা গেল, গত পাঁচ বছরে রায়গঞ্জ তথা উত্তর দিনাজপুরের মানুষের জন্য রেল ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে তার পুরোটাই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর কৃতিত্ব বলে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া এমপি ল্যাডের টাকায় লাইট, পানীয় জল, কমিউনিটি হল, ইন্ডোর স্টেডিয়াম, শ্মশানঘাটের উন্নয়ন সহ যা যা কাজ করেছেন তারও ফিরিস্তি রয়েছে সেই তালিকায়।
রায়গঞ্জ শহর ঘেঁষা গ্রাম গোয়ালপাড়া। এই গ্রামেরই তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিমাংশু শীল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘নিজের এলাকার কেউ এখানকার মানুষের সুখ-দুঃখ যতটা বুঝবেন, একজন বহিরাগত নিশ্চয়ই ততটা অনুভব করতে পারবেন না। বর্তমান সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী কলকাতা যাওয়ার জন্য দিনের ট্রেন সহ রেল ও সড়ক যোগাযোগের অনেক উন্নয়ন করেছেন। তবে রায়গঞ্জ থেকে বারসই যাওয়ার রাস্তাটা আজও হল না। রায়গঞ্জে একটা এয়ারপোর্ট হতে পারত। এইমসের ধাঁচে হাসপাতালটাও হল না। সাংসদ ভূমিপুত্র হন বা বহিরাগত, সেটা বড় কথা নয়। আমরা কাজের মানুষ চাই।’
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর নিহত দুই ছাত্র রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মনের সমাধির মাটি কপালে ঠেকিয়ে প্রথম প্রচার শুরু করেছিলেন দেবশ্রী। সেদিন শপথ নিয়ে জানিয়েছিলেন, যতদিন রাজেশ-তাপসের পরিবার বিচার না পাবে ততদিন তিনি তাঁদের পাশে ও প্রতিবাদের পথে থাকবেন। মন উজাড় করে দেবশ্রীকে ভোট দিয়েছিলেন দাড়িভিটের মানুষ। পাঁচ বছর পর বিচারের আশায় আকাশের দিকেই চেয়ে আছে রাজেশ-তাপসের সমাধি। তাঁদের পরিবারের দাবি ছিল সিবিআই তদন্তের। সেই দাবি পূরণ হয়নি। আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সি এনআইএ তদন্তভার হাতে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দাড়িভিট আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন গ্রামেরই তরুণ নরেন্দ্রনাথ শিকারি। তিনি বললেন, ‘সাংসদের আচরণ ও ব্যবহারে আমরা যারপরনাই অসন্তুষ্ট। তিনি দাড়িভিটে এলে তঁাকে ঘিরে বিক্ষোভও হতে পারে।’
কেন এত ক্ষোভ? নরেন্দ্রনাথের কথায়, ‘রাজেশ-তাপসের জন্য ছিটেফোঁটাও করেননি সাংসদ। রাজেশ-তাপসের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি মোমবাতি জ্বালাতেও আসেননি। আসার জন্য তাঁকে ফোন করে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
এবার কি রায়গঞ্জের মানুষের মন জয় করতে পারবেন বালুরঘাটের মেয়ে? রায়গঞ্জ আসনে এখনও কোনও প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি বিজেপি। তার আগেই প্রশ্নটা ভেসে বেড়াচ্ছে রায়গঞ্জ কেন্দ্রের সাত বিধানসভাতেই।