দীপ সাহা, শিলিগুড়ি : মনে অদম্য জেদ আর চোখে আত্মবিশ্বাস। সমাজের জন্য ভাবনা প্রতিনিয়ত কুরে-কুরে খেত তাকে। কীভাবে ভাঙে গঙ্গার পাড়, কেনই বা বিড়ি বাঁধেন ওই মহিলারা, কেন বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটার এত অল্প বয়সে! অসংখ্য প্রশ্ন, কৌতূহল ভিড় করত বছর পনেরোর ছেলেটার মনে। সমাজটা যে দিন-দিন বদলে যাচ্ছে, উপলব্ধি করত সে। বোঝানোর চেষ্টা করত বাকিদের। কিন্তু যা হারিয়ে যায়, তা তো আর দেখানো যায় না। তাই বছরের পর বছর ছবি তুলে গল্প বুনতে শুরু করল সে। সেই গল্প বুনতে বুনতেই যে একদিন বিশ্বের অন্যতম সেরা ম্যাগাজিন ফোর্বসের বিশ্বসেরার তালিকায় ঠাঁই পাবেন, তা কল্পনাও করেননি ফরাক্কার নজরুলপল্লির মহম্মদ মাসুদ সারওয়ার।
যে ফোর্বস ম্যাগাজিনে ঔজ্জ্বল্য বাড়ান শাহরুখ খান কিংবা মুকেশ আম্বানিরা, সেই ফোর্বসেই কি না এক মফস্বলের ছেলে! তাও ফোটোগ্রাফির সৌজন্যে! চমক তো বটেই। বিশ্বজুড়ে ৩০ বছরের নীচে তরুণ, প্রতিভাবানদের স্বীকৃতি দেয় এই পরিচিত পত্রিকা। সেই সেগমেন্টটির নাম থার্টি আন্ডার থার্টি। এশিয়ার জন্য সেখানে আলাদা ১০টি ক্যাটিগোরি। সেখানেই দ্য আর্টস ক্যাটিগোরিতে মনোনীত হয়েছেন মাসুদ। বাংলার আরও দুই তরুণ মৈনাক সরকার ও প্রীতম খানও রয়েছেন তালিকায়। এন্টারপ্রাইজ টেকনোলজি বিভাগে।
বর্তমানে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর জন্য লন্ডনে রয়েছেন মাসুদ। সেখানে ফোনে ধরা হলে একরাশ উচ্ছ্বাস তাঁর গলায়, ফোর্বসে জায়গা করে নেব, এটা ভেবে কোনও কাজই করিনি। শুধু প্যাশন নিয়ে লড়ে গিয়েছি। চেয়েছিলাম, নিজের এলাকাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে। সেটা পেরেছি। এটাই আমার কাছে অনেক। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বহু পুরস্কারও। রাষ্ট্রসংঘ আয়োজিত ফোটোগ্রাফি ফর হিউম্যানিটি গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে পুরস্কার জিতেছেন তিনি। তালিকাটা অবশ্য বেশ লম্বা।
মাসুদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত চিকিত্সক, মা গৃহবধূ। বড় তিন বোনও রয়েছে। ছোট থেকেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান নজর কাড়ত তাঁর। কীভাবে গল্প বলা যায়, সেখান থেকে শেখা। মাসুদের কথায়, স্কুলে পড়াকালীন ক্যামেরা কিনবে বলে জেদ চাপল মাথায়। বাবা দিতে নারাজ। বললেন, টাকা জমাতে। উপায়ান্তর না পেয়ে টিফিনের টাকা জমানো শুরু হল। হাজার কুড়ি জমতেই বাবার কাছে আবদার। ঘরে এল ক্যামেরা। ব্যাস, শুরু হল দৌড়ঝাঁপ। এ গলি থেকে সে গলি, গঙ্গার পাড় থেকে গাঁ-গঞ্জ।
টুয়েলভ পাশ করার পর দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান মাসুদ। কিন্তু মন পড়ে ছিল ফোটোগ্রাফিতেই। মাস তিনেক পর পড়া ছেড়ে ফিরে আসেন ফরাক্কায়। বাবার কাছে আবদার করে ভর্তি হন ফোটোগ্রাফি কোর্সে। সেটা শেষ হওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
পুরোনো কথা স্মৃতিতে টাটকা মাসুদের। শুক্রবার বলছিলেন, গোটা মুর্শিদাবাদে বিড়ি একটা শিল্প। খুব জানতে ইচ্ছে হত, হাজার হাজার লোক কেন বিড়ি বাঁধেন। শুরু করলাম তাঁদের গল্প ক্যামেরায় ধরে রাখার কাজ। আমার ইচ্ছে ছিল, নিজের জায়গার মানুষের কথা বলব। তাঁদের গল্প তুলে ধরব বিশ্বের দরবারে।
টানা ৪ বছর ধরে ফরাক্কা ব্যারেজ নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। প্রতিবার বর্ষায় এখানে গঙ্গার পাড়ে তলিয়ে যায় শয়েশয়ে বাড়ি। আবার নতুন জায়গায় ঘর বাঁধেন সবাই। আবার ভেঙে যায়। তাঁদের জীবনচক্র যেন মাসুদের ছবিতে স্পষ্ট। তিনি চান, তাঁর এই কাজগুলো নিয়ে গবেষণা হোক। সমস্যার শেষ হোক এখানেই। তাঁর কথায়, ভাঙনটা একটা জলজ্যান্ত সমস্যা। এর সমাধান হুট করে সম্ভব নয়। এর জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা। আমি ছবিগুলো দিয়ে একটা গ্রাউন্ড রিপোর্ট তৈরি করছি। আশা করি, সেটা কারও কাজে লাগবে। কথা বলার ফাঁকে জানা গেল, বিভিন্ন বিষয়ে ছবি তোলার আগে গবেষণা, পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। সেক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ সংবাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনও তাঁকে সাহায্য করেছে।
আপাতত দিল্লিতে থাকলেও নিজের ছোট শহরটাকে ভুলে যাননি। লন্ডন থেকে ফিরে ইচ্ছে রয়েছে আরও কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করার। নারী পাচার, ধর্ষণের মতো নানা ঘটনা তাঁকে পীড়া দেয়। তাই মহিলাদের লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হওয়ার কাহিনী তুলে ধরতে চান নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে বলছেন, আমার কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজটা দ্রুত বদলে যাবে না জানি। কিন্তু বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে। সবাই বুঝবে। সেটাই আমার প্রাপ্তি।
ফরাক্কা এবং বাংলা গর্ব করতে পারে প্রবাসী ছেলেটির জন্য।