প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ মেলালেন তিনি মেলালেন। সংসদীয় অধিবেশন শুরু হতে এখনও পাক্কা ৪৮ ঘন্টা। তার আগেই শনিবার কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকা প্রথামাফিক সর্বদলীয় বৈঠকে একসুরে মহুয়া ইস্যুতে সরব হল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের মতো প্রধান বিরোধী দলগুলি। শুধু কংগ্রেস বা তৃণমূল-ই নয়, মহুয়ার ইস্যুতে নজিরবিহীনভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছে পঞ্জাবের আকালি দল (মান) এবং হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাও (জেএমএম)। সংসদীয় অধিবেশন শুরু হওয়ার প্রাক মুহূর্তে মহুয়া ইস্যুতে এভাবেই আবারও একজোট হতে চলা বিরোধী শিবিরের এই সম্মিলিত পদক্ষেপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ।
সোমবার শীতকালীন অধিবেশনের প্রথমদিনেই ‘টাকার বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন’ করার অভিযোগে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র’র সাংসদ পদ খারিজ করার দাবি সংক্রান্ত রিপোর্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে লোকসভায় অধ্যক্ষ ওম বিড়লার উপস্থিতিতে জমা দিতে চলেছে বিজেপি সাংসদ বিনোদ কুমার সোনকারের নেতৃত্বাধীন এথিক্স কমিটি। ভোটাভুটির মাধ্যমে গৃহীত এই রিপোর্ট, যেখানে মহুয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেন ৫ জন বিজেপি এবং ১ জন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস সাংসদ প্রীনিত কউর (মহুয়ার সমর্থনে ভোট পড়ে ৪ টি) তা সংসদের নিম্নকক্ষে মঞ্জুর হলে সাংসদ পদ হারাতে পারেন কৃষ্ণনগর সাংসদ মহুয়া মৈত্র। কিন্তু তার আগেই সর্বদল বৈঠকে মহুয়ার পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একপ্রস্ত লড়াইয়ের মহড়া রচে ফেলল বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের একাংশ।
এদিন সংসদের লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সর্বদল বৈঠকে অংশ নেন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই শীর্ষ প্রতিনিধি-সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডেরেক ও’ব্রায়েন। বৈঠকে উপস্থিত রাজনাথ সিং, প্রহ্লাদ জোশী, অর্জুনরাম মেঘোয়াল সহ কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতিনিধিদের প্রতি কটাক্ষ করে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন, ‘এথিক্স কমিটি সংসদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিচালন কমিটিগুলির অন্যতম। অথচ সেই কমিটির তৈরী মহুয়া মৈত্র বিষয়ক রিপোর্ট সংসদে পেশ হওয়ার আগে মিডিয়ার হাতে পৌঁছে যায় কী ভাবে?’ সুদীপবাবু এও জানান, কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মহুয়ার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার যে অভিযোগ রয়েছে তা প্রমাণিত হয়নি আজও৷ কমিটিতে তলব করা হয়নি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে। এর পরেও কমিটির রিপোর্ট লোকসভায় জমা পড়ার আগেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে যায়! এর দায় কে নেবে? সুদীপের দাবি, ভবিষ্যতে আর যেন সংসদের কোনও কমিটির রিপোর্ট এভাবে ফাঁস না হয়৷ মহুয়ার ক্ষেত্রে যে ভাবে রিপোর্ট ফাঁস করা হয়েছে তার তীব্র নিন্দা করেন সুদীপ ও ডেরেক উভয়েই, দাবি সংসদীয় সূত্রে।
শুধু তৃণমূলই নয়, মহুয়া ইস্যুতে সুর চড়িয়েছে কংগ্রেসও। শনিবার সর্বদল বৈঠকে হাজির না হলেও, কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের পাশে দাঁড়িয়ে প্রিভিলেজ কমিটি এবং এথিক্স কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লাকে চিঠি দিলেন লোকসভার কংগ্রেসের দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনি চার পাতার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন স্পিকারকে। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, স্বাধিকারভঙ্গ বা প্রিভিলেজ কমিটি এবং এথিক্স কমিটির ভূমিকা কী তা স্পষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট চিঠিতে কমিটির রিপোর্টে বর্ণিত কোনটি ‘আনএথিক্যাল কনডাক্ট’ বা অনৈতিক আচরণ আর কোনটি ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আদর্শ আচরণবিধি তারও কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই কেন; তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস সাংসদ। পাশাপশি টাকা নিয়ে প্রশ্নের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে যখন তদন্ত চলছে, সেটি গোপন না রেখে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং সদস্যেরা প্রকাশ্যে এনেছেন এমন নিজেদের মতো মতামতও দিচ্ছেন কীভাবে সেটা নিয়ে নিজের কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সর্বদল বৈঠকে মহুয়ার ইস্যুতে সরব হন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এবং প্রমোদ তিওয়ারির মতো নেতারা৷ বিষয়টি নিয়ে সংবেদনশীল ভাবে পর্যালোচনার দাবি জানান তাঁরা, দাবি কেন্দ্রীয় সুত্রে। একইসাথে কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে চলে আসার বিষয়েও তাঁরা তীব্র সমালোচনা করেন। সংসদীয় সূত্রের দাবি, মহুয়ার বিরুদ্ধে কমিটির বৈঠকে অনৈতিক এবং ব্যক্তিগত প্রশ্ন তোলা নিয়ে সর্বদল বৈঠকে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন পঞ্জাবের আকালি দলের (মান) বর্ষীয়ান সাংসদ সিমরন জিৎ সিং মান। এক মহিলার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আপত্তি জানান জেএমএম সাংসদ মহুয়া মাঝিও, দাবি কেন্দ্রীয় সূত্রে৷
সোমবার, অধিবেশনের প্রথমদনেই যে মহুয়াকে গিলোটিনে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র সরকার, তার আভাস পাওয়া গিয়েছে মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও। গোড্ডা ঝাড়খন্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত তাঁর নিজস্ব এক্স হ্যান্ডেলে ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য করে বলেন, ‘আগামী ৪ ডিসেম্বর লোকসভা সংসদীয় ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত দুর্নীতিকান্ডের বিরুদ্ধে বড় সিদ্ধান্ত নেবে যা দেশের লোকতান্ত্রিক মর্যাদা রক্ষা করবে এবং দেশের মানুষকে গণতন্ত্রে আস্থাশীল হতে শেখাবে।’ এক্ষেত্রে সরাসরি নাম না নিলেও, সোমবার মহুয়ার আসন্ন বহিষ্কার পর্বকে ইঙ্গিত করেই নিশিকান্তের এই মন্তব্য বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহল। মহুয়া বিতর্কের ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে সংসদেও, শনিবার এমনটি আঁচ করে কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী জানিয়েছেন, ‘এঁদের (বিরোধী শিবির) কাজই সংসদের কার্যনির্বাহকরণে বাধা সৃষ্টি করা। মহুয়াজির বিষয়টি কমিটি এবং মাননীয় স্পিকারের এক্তিয়ারাধীন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন। কিন্তু সেটি কেন্দ্র করে অধিবেশন পণ্ড করার চক্রান্ত কেউ করে থাকলে তা নিন্দনীয়। আমরা চাই অধিবেশন সুষ্ঠ এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে চলুক। বিরোধীদেরও রাজনৈতিক দর কষাকষি এবং ব্যক্তিপ্রাধান্যের ঊর্ধ্বে উঠে দেশহিতের কথা ভাবা উচিৎ।’