- ভাস্কর বাগচী
শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার বাসিন্দা সৌম্যপ্রতীক সরকার। বুধবার সকালে শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে তিনি স্ত্রীকে চিকিৎসক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন হাকিমপাড়ার একটি নার্সিংহোমে। সেখানে অনুসন্ধানকেন্দ্রে জিজ্ঞাসা করে যা শুনলেন, তাতে হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন কাউন্টারের সামনে। অনুসন্ধানকেন্দ্র থেকে তাঁর হাতে একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলা হল, আপনি এই নম্বরে বিকেল ৪টা নাগাদ টেলিফোন করে নাম লেখাবেন।
সৌম্য ভাবলেন, যাক, বিকেলেই তাহলে চিকিৎসককে দেখাতে পারবেন। তিনি কাউন্টারের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ফোন করার কতক্ষণ পর রোগীকে নিয়ে আসতে হতে পারে? এরপর যা উত্তর পেলেন, তাতে তিনি হতবাক। ভদ্রলোকের বক্তব্যের নির্যাস, আজ শুধুমাত্র টেলিফোনে নাম লেখাতে হবে। কবে চিকিৎসককে দেখাতে পারবেন, সেটা টেলিফোনের পর জানা যাবে। সেটা দু’দিন পরে হতে পারে, চারদিন পরেও হতে পারে।
এটা শুধুমাত্র শিলিগুড়ি শহরের ঘটনা নয়। গোটা উত্তরবঙ্গের চিকিৎসা পরিষেবার অবস্থা এখন এরকম। আর ডাক্তারবাবুর যদি একটু নামডাক হয়ে যায়, ব্যাস। তিনি প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই চিকিৎসককেও আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না। সপরিবারে গাড়ি, বাড়ি, বিদেশভ্রমণ, কিছুই বাদ থাকবে না। এরপর আবার দু’-একজন নেতা বা মন্ত্রীর হাউস ফিজিশিয়ান হতে পারলে আর কথাই নেই। ঝুলিতে চলে আসতে পারে কিছু সরকারি পুরস্কার।
কিন্তু সাধারণ মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরেও বহু চিকিৎসকের দেখাটা পর্যন্ত পান না, তাঁর কাছে রোগের কথা বলা তো দূরের কথা। এমন অনেক ডাক্তারবাবু রয়েছেন, যাঁদের দেখাতে চাইলে মাস দুই-তিনেক আগে নাম লেখাতে হবে। না হলে অনামী ডাক্তারকে দেখিয়ে কাজ চালানো ছাড়া উপায় নেই। অর্থাৎ হঠাৎ কারও কোনও সমস্যা হলে ভালো ডাক্তার দেখানো প্রায় অসম্ভব। কেউ ভালো সুপারিশ আদায় করতে পারলে সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু ক’জনের সেই ক্ষমতা থাকে বলুন!
বহুদিন থেকে তাই এ রাজ্যের রোগীদের অধিকাংশ দক্ষিণমুখী। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ সহ দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় চিকিৎসা করিয়ে সন্তুষ্টি আসে সিংহভাগ মানুষের। সেখানকার চিকিৎসাপদ্ধতি, চিকিৎসক-নার্সদের ব্যবহার, চিকিৎসা পরিষেবা ইত্যাদি বাংলার সঙ্গে আকাশপাতাল তফাত। দক্ষিণে শুধুমাত্র বেসরকারি ক্ষেত্রে নয়, সরকারি ব্যবস্থাতেও এত সুন্দর চিকিৎসা করা হয়, যা বাংলায় আনার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
দক্ষিণে চিকিৎসা করাতে গেলে চোখে পড়ে, সেখানকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলার। কেন তাঁরা সেখান ছুটে যান? কী নেই এই বাংলায়? বিশেষ করে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর তো বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে বিস্তর উদ্যোগ নিয়েছেন। তবু কেন এখানকার রোগীরা ছুটে যান উত্তর কিংবা দক্ষিণ ভারতে? কেনই বা বড় বড় নেতা বা মন্ত্রীদের কিছু হলে, তাঁরাও ছোটেন বাংলার বাইরে?
বাস্তবে দক্ষিণের সঙ্গে পরিকাঠামোর যেমন বড় ফারাক রয়েছে, তেমনই আছে চিকিৎসকদের মানসিকতার পার্থক্য। উত্তরবঙ্গে কোনও নামী চিকিৎসক ৩০ মিনিট ধরে একজন রোগীর কথা শোনার ধৈর্য দেখাতে পারবেন? না, একদম না। বরং ওই সময়ে তিনি ৪-৫ জন রোগী দেখে ফেলবেন। এখানকার চিকিৎসকরা ছুটে চলেন একটার পর একটা নার্সিংহোম, নিজস্ব চেম্বার, ওষুধের দোকানের চেম্বারে। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে অনেক ডাক্তারবাবু রাত ১১-১২টা পর্যন্ত শুধু ছুটে চলেন।
শুধু কি পরিষেবা দেওয়ার লক্ষ্যে? নাকি যত বেশি জায়গায় পৌঁছানো যায়, তত বেশি…। যাক, পরিষ্কার করে আর নাই বা বলা হল। দক্ষিণের চিকিৎসকদের সিংহভাগও কোনও না কোনও নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তবে সেখানেই সকাল থেকে রোগী দেখেন। তাই রোগীকে সময় দিতে পারেন অনেকক্ষণ। এখানকার চিকিৎসকদের অত সময় কোথায়?
উত্তরবঙ্গে কোনও নার্সিংহোম কিংবা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর শারীরিক অবস্থা জানতে কালঘাম ছোটে তাঁর পরিজনের। কারণ, ডাক্তারবাবু রাত ১০টায় আসবেন না ১২টায়, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তাই ডাক্তারবাবুর জন্য রাত জাগতে জাগতে অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন রোগীর পরিজনও। দক্ষিণের বেসরকারি তো বটেই, সরকারি হাসপাতালের রোগীর পরিজনের সঙ্গে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন ডাক্তারবাবু। তাই রোগী খুশি, তার পরিজনও খুশি।
এখানকার ডাক্তারবাবুদের সবচেয়ে বড় সমস্যা, রোগী রোগের কথা বললে প্রথমে কোনও পরীক্ষা না করিয়ে স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে ৪-৫ রকম ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন। কিন্তু উত্তর কিংবা দক্ষিণ ভারতের চিকিৎসকরা আগে রোগীর সবরকম পরীক্ষা করে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ওষুধ লিখে থাকেন। অথচ উত্তরবঙ্গে একবার রোগীকে নার্সিংহোমের দরজা অবধি নিয়ে যাওয়া হলে তো কথাই নেই। একদিনে একজন সাধারণ রোগীকে ২০-২৫ হাজার টাকার ওষুধ দেওয়ার রেকর্ডও কম নেই।
যদিও সবাই একরকম নয়। এই বাংলায় এখনও অনেক চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা চিকিৎসাকে শুধু পেশা নয়, সেবার চোখে দেখেন। সব চিকিৎসক যদি সেই একই উপলব্ধি থেকে কাজটা করতেন, তাহলে হয়তো ঘটিবাটি বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য আর কাউকে ছুটতে হত না চেন্নাই কিংবা বেঙ্গালুরুর দিকে।