- সাহানা নাগ চৌধুরী
তপন সিংহের শতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার একটা কথা মনে হয়। এমন সিনেমা তিনি সারাজীবন বানিয়ে গেলেন যা বাঙালির অন্দরমহলে সরাসরি প্রবেশ করে বাড়ির কর্তা থেকে গিন্নি, এমনকি সপরিবারকেই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাঁর ছবি নির্বাচন, ছবির পরিবেশনায় এমনই মুনশিয়ানার স্পর্শ ছিল, যা এই বাংলার সর্বস্তরের দর্শককেই টেনে রাখত।
উত্তরবঙ্গের মানুষ তাঁকে আজীবন মনে রাখবে সাগিনা মাহাতোর মতো ছবি তৈরির জন্য। তিনধারিয়া টয়ট্রেনের লোকোশেডের প্রেক্ষাপটে সাগিনা মাহাতো হয়েছিল ১৯৭০ সালে। এতটাই সাড়া ফেলেছিল বাংলা ছবি যে, চার বছর হয় ওই ছবি হিন্দিতে হল। নাম সাগিনা। এবার তাঁর অর্ধশতাব্দী হল।
সাগিনা মাহাতো ছিল আমার বাবা গৌরকিশোর ঘোষের লেখা। আসলে তপনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সাহিত্যিকদের। সন্তোষকুমার ঘোষ ও আমার বাবাকে তিনি একেবারে নিজের বৃত্তের মধ্যেই রেখেছিলেন। এর একটা কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এঁরা দুজনেই বাংলা ছবিকে খুবই ভালোবাসে।’ এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী দেবীর প্রসঙ্গ। তপন-অরুন্ধতীর সঙ্গে এঁদের আড্ডা এতই মূল্যবান ও উচ্চপর্যায়ের ছিল, তা এখনকার কোনও ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারবেন না। ঘটনাচক্রে অরুন্ধতী দেবীরও এইবার শতবর্ষ।
সাগিনা মাহাতোয় তিনধারিয়া রেলওয়ের লোকোশেড ছিল অন্যতম শুটিং স্পট। সাগিনা চরিত্রে অভিনয় করছেন দিলীপকুমার আর তাঁর সঙ্গিনী সায়রাবানু। মনে আছে, বাবা নিজেই শুটিং স্পটগুলো বাছার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে। দিলীপকুমার-সায়রার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলেন চা বাগানে পালচৌধুরীদের বাংলোয়।
সেই সময় উত্তরবঙ্গে তখন নানা ঝামেলা, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ওই অঞ্চলের সমস্ত লোকদের সহযোগিতায় চমৎকারভাবে শুটিং উতরে গিয়েছিল। স্থানীয় মানুষের আবেদনে স্কুল তৈরির জন্য তখনকার দিনে ভালো টাকা দিয়েছিলেন দিলীপকুমার। ওই ছবির গান এখনও লোকদের মুখে মুখে ফেরে। তপনের এরকম বহু ছবির গান এবং ছবিকে বাঙালি মনে রেখেছে। ছবির নামগুলো বললে আর একবার স্পষ্ট হবে তাঁর বৈচিত্র্য।
সৃষ্টিশীলদের যা হয়ে থাকে, তিনি নিজে তাঁর ছবি নিয়ে আদৌ খুশি ছিলেন না। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাঁর নির্মিত কোন ছবি তাঁর সবচেয়ে সেরা মনে হয়। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে জীবনে এরকম অনেক ইচ্ছেই অপূর্ণই থেকে যায়। সত্যি বলতে কী আসলে যেটা অপূর্ণই থেকে গেছে, তা হচ্ছে একটা ভালো ছবি করা। যা সত্যিই করে উঠতে পারিনি।’
এমনিতে তিনি যে ছবি তৈরি করবেন বা পরিচালক হবেন, তা কৈশোরে বা যৌবনে একেবারেই চিন্তা করেননি। তবে ছোট থেকে বহু সিনেমা তিনি দেখতেন।
তাঁর শৈশব ভাগলপুরে কেটেছিল। সেখানেই তিনি স্কুলে পড়তে পড়তে সিনেমা দেখেন। ওই ভাগলপুরের একটি হলে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হত। সেখানে টারজান বা কিংকং-এর মতো ছবি দেখতে দেখতে একটু উঁচু ক্লাসে ইংরেজি ক্লাসিক ছবি দেখতে শুরু করেন তপন। স্কুলের মাস্টারমশাই যখন ‘টেল অফ টু সিটিজ’ উপন্যাসটা পড়াচ্ছিলেন, তখন ওই ছবিটা ভাগলপুরেরই সিনেমা হলে চলছিল। মাস্টারমশাইয়ের কথায় সিনেমাটি দেখতে যান। ওই ছবিটিই তাঁকে এমন মোহিত করে, যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
তপন নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইংরেজি ছবিটি তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকেই তাঁকে চলচ্চিত্র আকর্ষণ করতে থাকে। তিনি ইংরেজি সিনেমা দেখতে দেখতে ছবির ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। প্রথম প্রথম তাঁর অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে ছিল। গ্যারি কুপার, ক্লার্ক কেবল, বেটি ডেভিসের মতো হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় তাঁকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু এই শখ তাঁর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঁকে ধীরে ধীরে আকর্ষণ করছিলেন জন ফোর্ড, উইলিয়াম ওয়াইলার, ক্যারল লিড, ফ্রেড জিনোমান, বিলি ওয়াইলডারের মতো বড় বড় পরিচালকরা।
নানা পত্রপত্রিকায় তাঁদের সম্পর্কে পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল ‘ফিল্ম-মেকিংটা একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। আর আমি তো চিরকালই অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু।’
একদিকে যদি হলিউডের সিনেমা হয়, তা হলে অন্যদিকে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই অ্যাডভেঞ্চারের তৃষ্ণার জন্ম দেন রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলা থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর মা প্রমীলা সিংহ তাঁকে রবীন্দ্রনাথকে পরিচয় করান। মায়ের প্রভাব তাঁর জীবনে খুব বেশি ছিল। মা তাঁকে রবীন্দ্রসংগীত শেখান। ফলে ছাত্রজীবনেই রবীন্দ্রনাথ দ্বারা আকৃষ্ট হন।
এই রবীন্দ্রপ্রীতিই তাঁকে তাঁর নির্মিত সিনেমায় ব্যবহার হতে প্রভূত সাহায্য করে। তিনি চলচ্চিত্রে আসার আগেই বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেএল সায়গল বা কানন দেবী ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রসংগীত প্লে-ব্যাক করেছেন। তিনিও তাঁর বহু সিনেমায় অজস্র রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেছেন। শুধু যে ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, তিনি রবীন্দ্রনাথের বহু রচনাই চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন।
১৯৫০ সালে তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করতে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলেন বিদেশি শিক্ষা তাঁর ধাতে সইবে না। বিদেশ থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যে তিনি ছবি তৈরি করতে শুরু করলেন। ১৯৫৪ সালে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘অঙ্কুশ’ নিয়ে ছবি করলেন। অনেক পরিশ্রম করে এই ছবিটি তৈরি করলেও ছবিটি চলেনি। তিনি বেশ হতাশ হয়েছিলেন। সিনেমা প্রসঙ্গে বলার সময়, তিনি বলেছিলেন, ‘ছবি যদি দর্শক না দেখে, তা হলে কোনও দামই নেই।’
এরপরেও তিনি বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি করেন, যেগুলোর মধ্যে দিয়েই তিনি ধীরে ধীরে বাংলার সিনেমা জগতে পরিচালক হিসাবে স্বীকৃতি পান। তপনের সিনেমার পটভূমির ব্যাপ্তি ছিল বিশাল ক্যানভাসে বন্দি। ফলে নানা ধরনের বিষয় তাঁর সিনেমায় ফুটে উঠেছে। তিনি মূলত বাংলা সাহিত্যর স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের গল্প নিয়েই সিনেমা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে দিলে কে ছিলেন না তাঁর সিনেমার মধ্যে? শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বনফুল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষ, শঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তপন নিজে কত বাংলা সাহিত্যের লেখকের চরিত্রদের সিনেমার স্ক্রিনে অমর করে গেছেন, তা তাঁর ভক্তরাই জানেন।
বাংলা ছবিতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি নাম ওঠে তপন সিংহ ও তরুণ মজুমদারের। তপন সত্যজিৎদের সমকালীন হলেও, তাঁর ছবির ঘরানা ছিল একেবারে স্বতন্ত্র।
তপন ছিলেন সামাজিক সচেতন একজন মানুষ। শহর ছিল ছবির প্রাণকেন্দ্র। আর তার ফলেই নকশাল আমলের যুবসমাজের অবক্ষয় নিয়ে তৈরি করতে পেরেছিলেন ‘আপনজন’, কখনও বা ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘আতঙ্ক’, ‘অন্তর্ধান’। এই সব ছবি তিনি যে সমাজের দায়বদ্ধতার জন্যই বানিয়েছিলেন তা স্পষ্ট।
তপনের কাবুলিওয়ালা একরকম ছবি, আবার অতিথি অন্যরকম। দুটোই অনন্য সাধারণ বললে কম বলা হবে। অতিথির সঙ্গে কত ফারাক ক্ষণিকের অতিথির। লৌহকপাট একরকম স্বাদ, ঝিন্দের বন্দি বা ক্ষুধিত পাষাণ আবার অন্যরকম। গল্প হলেও সত্যি, হারমোনিয়াম এবং হাটেবাজারের মধ্যে আবার আকাশপাতাল ফারাক। এক ডক্টর কি মওত থেকে পুরোপুরি আলাদা হুইলচেয়ার। প্রতিটি ছবি মাইলস্টোন। দূরদর্শনে তিনি ডটার্স অফ দ্য সেঞ্চুরি করেছিলেন কাদের নিয়ে? শাবানা আজমি, জয়া বচ্চন, নন্দিতা দাস, দীপা শাহি, সুলতা দেশপান্ডে। আদালত ও একটি মেয়েতে নতুন করে ফিরিয়ে আনেন তনুজাকে। কিশোররা ভুলবে না সবুজ দ্বীপের রাজা বা সফেদ হাতিকে।
তপনের প্রতিটি ছবি নতুন করে ভাবায়, অন্য স্বাদের সন্ধান দেয়। এখানেই তপনের জাদু।
(লেখক সাংবাদিক)