শিবশঙ্কর সূত্রধর, কোচবিহার: কোচবিহারের কাটুমকুটুম শিল্পী উৎপলকুমার চক্রবর্তীর সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। ডুয়ার্স বা পাহাড়ের নানা জায়গা থেকে কুড়িয়ে আনা গাছের শিকড়ের অংশ ঘষে মেজে কখনও সেটি দিয়ে তৈরি করছেন পাখি, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। প্রায় ৪৫০টি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন তিনি। পেয়েছেন বেশকিছু অ্যাওয়ার্ডও। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক এখনও মজে রয়েছেন ভাস্কর্য তৈরিতেই। তবে এই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের শিল্পী হয়ে ওঠার কাহিনী একটু অন্যরকমই।
১৯৯৪ সালের কথা। কোচবিহারের শ্রী শ্রী করুণাময়ী হাইস্কুলে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে একটি আকাবাঁকা গাছের ডাল হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল রাজু দাস নামে এক ছাত্র। পড়াতে মনই নেই। ক্লাসে তখন ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন শিক্ষক উৎপলকুমার চক্রবর্তী। প্রচন্ড রেগে রাজুকে দিলেন বকুনি। তার হাতের সেই আকাবাঁকা ডাল কেড়ে উৎলবাবু ফেলে দিলেন জানলার ওপারে। শিক্ষকের উপর মনক্ষুহ্ন হল রাজুর। উৎলবাবুর মুখের উপর সেই ছাত্র সাফ বলে দিল, ‘ওই ডাল দিয়ে আমি কাটুমকুটুম বানাতাম। আপনি তো ওসব বুঝবেন না। আপনার দ্বারা ওসব হবে না।’ ছাত্রের কাছ থেকে এই কথা শুনে খানিকটা অপমানিতবোধ করলেন উৎলবাবু। সাধারণত দেখা যায় শিক্ষকের কথা শুনে ছাত্রদের মনে কিছু করার জন্য জেদ চলে আসে। এক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উলটো। রাজুর সেই কথা শুনে নিজের মনে জেদ চেপে বসে উৎলবাবুর। ক্লাস শেষে জানালার পাশ থেকে সেই গাছের ডাল কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিনের চেষ্টায় সেই ডাল দিয়ে তৈরি করেন একটি শিল্প। ফের সেটি বিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে রাজুকে দেখান তিনি।
শিক্ষকের হাত দিয়ে কাটুমকুটুম শিল্প তৈরি দেখে রাজুর মুখেও তখন একফালি হাসি। যে উৎপলবাবুর কাটুমকুটুম শিল্প সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না তিনিই এখন তার ছাত্রের অপমানের জবাব দিতে গিয়ে শিল্পকর্ম শুরু করেছিলেন। বর্তমানে রাজু এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কোচবিহারের হাজরাপাড়ার বাসিন্দা উৎপলবাবু দেশের নানা প্রান্তে তার কাটুমকুটুম শিল্পের প্রদর্শনী করে প্রশংসা পাচ্ছেন। উৎপলবাবু বললেন, ‘১৯৯৪ সালের আগে এই শিল্প নিয়ে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। রাজু নামে এক ছাত্রের কথায় জেদ চেপে বসে। তখন থেকেই শুরু। দেশের নানা জায়গায় প্রদর্শনী করেছি। ইচ্ছে রয়েছে বিদেশে কোথাও প্রদর্শনী করব।’
কাটুমকুটুম শিল্প ঠিক কী? জানা গেল, গাছের ডাল, শেকড়ের অংশ নিয়ে সেটি করাত, বাটালি সহ নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে কেটে, ঘষে নানা আকৃতি দেওয়া হয়। সেই ভাস্কর্যকেই বলা হয় কাটুমকুটুম। ১৯৯৪ সালে ছাত্রের সঙ্গে হওয়া সেই ঘটনার পর থেকেই নিয়মিত এই শিল্পচর্চা করেন উৎপলবাবু। ২০১৭ সালে অবসরের পর থেকে সেই চর্চা আরও বেড়েছে। কোচবিহার তো বটেই, শিলিগুড়ি, কলকাতা, দিল্লি, গোয়া, আমেদাবাদ সহ দেশের নানা জায়গায় প্রদর্শনী করেছেন। জয়ন্তী, রায়ডাক, দমনপুর, রায়মাটাং, হলং সহ ডুয়ার্স ও পাহাড়ের নানা জায়গার রিভার বেড থেকে গাছের ছোট ছোট শিকড়ের অংশ সংগ্রহ করেন। এরপর সেখান থেকেই তৈরি হয় নানা শিল্প। উৎপলবাবুর হাতের গুণে শিকড় কখনও রূপ নেয় বাজপাখি কখনও প্রকৃতি, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ। বর্তমানে তাঁর মেয়ে উপাসনা চক্রবর্তীও বাবার কাছ থেকে শিল্পের তালিম নিচ্ছেন।