গৌতম সরকার
যে গোরু দুধ দেয়…।
সত্যটা বলেই ফেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তুলনায় দলের খারাপ ফলাফলের পর। প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে। ছবিটা ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদের ঝড়ে একমাত্র তাঁর সংখ্যালঘু নৌকাটা দড়ি ছিঁড়ে ভেসে যায়নি। কাট টু ২০২৪। সেই ঝড় ফিকে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট।
২০১৯-এ ভেসে যাওয়া সমর্থনের কিছুটা ফিরে এসেছে ঘাসফুলের ইভিএমে। শুধু মালদাতেই তৃণমূলের বিকল্প খুঁজে পেয়েছে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক। মার্জনা করবেন, ভোটব্যাংক শব্দটিতে আমার বেজায় আপত্তি। কিন্তু এককাট্টা জমাটবদ্ধ সমর্থন বোঝাতে বিকল্প কোনও জুতসই শব্দ মনে এল না। একমাত্রিক ‘গণতন্ত্রে’র রক্তচোখে বিপন্ন বোধ করেছে সংখ্যালঘু সমাজ। মালদা ছাড়া অন্যত্র তাই ঘাসফুলের ঝোপে নিরাপদ আশ্রয়।
গোরুর দুধ প্রসঙ্গটি আবার মনে করিয়ে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বশেষ উত্তরবঙ্গ সফর। তাঁর মতো এতবার কোনও মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ ঘোরেননি।
আবার তাঁর মতো ক্ষমতাসীন কোনও মুখ্যমন্ত্রী এতবার উত্তরবঙ্গে প্রত্যাখ্যাতও হননি। যদিও চেষ্টার কসুর কখনও করেননি তিনি। ২০২৪-এর ভোটের আগে ময়নাগুড়ির পাশে ঝড়বিধ্বস্ত বার্নিশ দেখতে এসে চালসায় থেকে গেলেন প্রায় দিন পনেরো।
বসে থাকার মানুষ তিনি নন। বছর, মাস, দিনের কথা ছেড়েই দিলাম, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মিনিটে, এমনকি প্রতি সেকেন্ডে দলীয় রাজনীতির জাল বুনে চলা মমতার বৈশিষ্ট্য। লোকসভা নির্বাচন যখন দোরগোড়ায়, তখন চালসায় বসে তিনি যে কোনও না কোনও ছক কষেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। যদিও কোচবিহার ছাড়া উত্তরবঙ্গের আর কোথাও সেই ছক পুরোটা কাজে আসেনি। তবে আংশিক কাজে লেগেছে বলেই অধিকাংশ আসনে ভোটের ব্যবধান কমেছে। ডুয়ার্সে খ্রিস্টান ভোটের কিছুটা নিজের ঝোলায় ভরেছেন তিনি।
উপলক্ষ্য ট্রেন দুর্ঘটনা হলেও ভোটের পর প্রথম উত্তরবঙ্গ সফরে এসে রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই করলেন মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে দুর্ঘটনায় আহতদের সঙ্গে দেখা ও রেলমন্ত্রকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে সেদিনই চলে গিয়েছিলেন কোচবিহারে। সাফল্যটা আঁকড়ে রাখতে জেলার নেতাদের পাঠ দিলেন। সেটা তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক রুটিনের মধ্যে পড়ে। মদনমোহন মন্দিরে পুজো প্রায় প্রতি কোচবিহার সফরে তাঁর ঔপচারিকতা।
কিন্তু অনন্ত মহারাজ থুড়ি বিজেপি সাংসদ নগেন রায়ের বাড়িতে চলে যাওয়ার পিছনে সেই ‘যে গোরু দুধ দেয়’… তত্ত্ব। সেই দুধ কাজ দিয়েছে বলেই না কোচবিহার জয় সম্ভব হয়েছে। হোন না তিনি বিজেপি সাংসদ, পদ্মের ইভিএম ভরাতে অনন্তের তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। বরং কথার জালে বারবার বিজেপি নেতৃত্বের প্রতি তাঁর উষ্মা প্রকাশ পেয়েছে। অনুগামীদের প্রতি সেটাই তাঁর পরোক্ষ সংকেত।
কে না জানে, ‘সমঝদার কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়।’ প্রত্যক্ষ সংকেতও নিশ্চয় ছিল। আর কেউ না বুঝুক, সেই সংকেত ধরে ফেলেছেন বহু উত্থানপতনের সাক্ষী, দুঃসময় কাটিয়ে ওঠা ঝানু রাজনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুধেল গাইয়ের সবসময় কদর। তাই দলীয় নেতাদের এককাট্টা হয়ে চলার পরামর্শ, মদনমোহনের কাছে মা-মাটি-মানুষের জন্য প্রার্থনার পাশাপাশি কোচবিহার রাজবাড়ির আদলে তৈরি নগেনের প্রাসাদের এত প্রশংসা।
মনে করিয়ে দিই, কোচবিহার রাজবাড়ির অনুকরণে প্রাসাদ নির্মাণের খবর সামনে আসার পর তৃণমূল সরকারই একসময় তদন্ত শুরু করেছিল। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তখন কিছুদিন প্রাসাদ ছেড়ে অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মার আশ্রয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন নগেন। রাজনীতিতে স্মৃতি বড় দুর্বল। না হলে কী আর নীতীশ কুমারের জন্য খোদ অমিত শা ঘোষিত বিজেপির বন্ধ দরজাটা আবার খুলে যায়!
গাইয়ের কদর দুধের পরিমাণে। অতীতে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের সেনানীদের এক ভাগ এখন নগেনের নেতৃত্বে। আরেক ভাগের নেতা বংশীবদন বর্মন। তিনি বহুদিন তৃণমূল সরকারের নানা পদের অধিকারী। সেই তিনি নগেনের প্রাসাদে মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রায় ভীষণ ক্ষুব্ধ। ভাবটা এমন, জেতালাম আমরা আর ধন্যবাদ নগেনকে! হায় রে! এ কেমন বিচার হে দিদি, এ কেমন বিচার! বংশীবদন ভুলে গেলেন, তাঁর সমর্থন ২০১৯, ২০২১-এ সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেনি দিদিকে। অতঃপর যেখানে দুধের জোগান বেশি, সেখানে যত্নআত্তিটা বেশি হবেই।
শিক্ষাটা ভালো বুঝেছেন দমদমের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহরা। গ্রামীণ ‘দুধে’ সমর্থনের পুষ্টি নিয়ে প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন। শহর তাই আপাতত বঞ্চিতের দলে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, শহরের তুলনায় গ্রাম তাঁর দপ্তরের অধিক দাক্ষিণ্য পাবে এখন। যতই পুরসভা থাকুক তৃণমূলের হাতে, ভোটে পুষ্টিকর দুধের জোগান নেই শহর থেকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলার ১৩১টি পুরসভার মধ্যে ৬১টিতে ঘাসফুল চাষের জমি অনুর্বর।
মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে এজন্য পুরসভার চেয়ারম্যানদের মুখ্যমন্ত্রীর বকাঝকা হয়েছে। গাই যদি দুধেল না হয়, তাহলে লাথি-ঝাঁটাই তো জোটে। সৌগত রায় মহিলাদের মধ্যে গ্রাম-শহরের বিভাজন এঁকেছেন। লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার গ্রামীণ মহিলাদের সমর্থনের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছে। সৌগতের আক্ষেপ, শহরে সেই ধারা শুকিয়ে কাঠ। তৃণমূল নেত্রী এজন্য দুষেছেন পুরসভার চেয়ারম্যানদের, দলের স্থানীয় নেতাদের। আবার চর্চায় এসেছে শহরে নানা অনৈতিক কাজ, জমি মাফিয়াদের দাপাদাপি।
এ সব কথা তিনি গত ৬-৭ বছরে কমবার বলেননি। সতর্ক করেছেন, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু ভবি ভোলার নয়। আসলে শহরেও ‘সেই যে গোরু দুধ দেয়’… তত্ত্ব। জমি মাফিয়াদের জোগান দেওয়া দুধে নেতারা এতটাই পুষ্ট যে, তুচ্ছ হয়ে যায় ভোটে জেতার তাগিদ। পুরসভার প্রশাসনে কিছু রদবদলের ইঙ্গিত মিলেছে মমতার কথায়। কিন্তু মাফিয়ারাজের দুধে পুষ্টদের চরিত্রের বদল তাতে সম্ভব বলে বোধ হয় না।
আরেকটা কথা বলে শেষ করি। জাতিভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক সমর্থনটা অতি ভঙ্গুর। সহজে চিড় ধরে। স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে সমর্থনের ভিত আলগা হয়ে যায়। আদর্শহীন, মূল্যবোধহীন ভোটের তাগিদে কখনও কেউ দুধেল হয়ে ওঠে, কখনও কারও কপালে বরাদ্দ হয় তুচ্ছতাচ্ছিল্য।