বর্ধমানঃ বালেশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর নেতা মন্ত্রীরা সেখানে পৌছে গিয়ে প্রতিশ্রতির বন্য বইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেন নি। তাই গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য তুলে তা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া মিটিয়ে স্বামী আরমান খাঁ-র মৃতদেহ বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হয়েছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করলেন মৃতের স্ত্রী মমতাজ বিবি। স্বামীর মৃতদেহের পাশে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে মমতাজ বিবি বলেন, স্বজনকে হারালাম, সম্পদও গেল, তবুও নেতা মন্ত্রীরা কেউ কথা রাখলেন না। আমদের পরিবারটা অথৈ জলে পড়ে গেল!
বছর ৩৬ বয়সী আরমান খাঁর বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানার অধীন দেউলিয়া গ্রামে। পরিবারের সবার অন্ন সংস্থানের জন্য আরমান দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ ভারতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই নাবালক সন্তানকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ১৫ দিন আগে চেন্নাই থেকে বাড়ি ফিরছিলেন আরমান। ফের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আরমান শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে রওনা হয়েছিলেন চেন্নাইয়ের উদ্দেশে। ওই দিনই ওডিশার বালেশ্বরে হওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পায় পরিবারের লোকেরা। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই পরিযায়ী শ্রমিক। অভিশপ্ত ট্রেনেই টিকিট ছিল আরমান খাঁর। তাই দুর্ঘটনাস্থলে তাকে খুঁজে পেতে পর দিন প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে পরিবারের লোকজন সেখানে পৌছান। সেখানে গিয়ে দু’তিনটে ঘর খুঁজে লাশের গাদার মধ্যে থেকে আরমানের দেহ সনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।
মৃতের আত্মীয় রহিম শেখ এদিন বলেন, লাশের গাদায় অনেক খোঁজ চালিয়ে তাঁরা আরমানের মৃতদেহ খুঁজে পান। কিন্তু মৃতদেহ বাড়ি ফেরাতে সরকারি সাহায্য না পেয়ে সমস্যায় পড়ে যান পরিবারের লোকেরা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে আরমানের দেহ আনা হয় মঙ্গলকোটের বাড়িতে। দেহ বাড়িতে ফিরলে পাড়া পড়শিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মেটানো হয় অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া।
মৃতের স্ত্রী মমতাজ বিবি এদিন বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পাবার পর থেকে আমি আমার স্বামীর মোবাইলে বারে বারে ফোন করি। কিন্তু ফোন বেজে গেলেও কোন সাড়া পাইনি। স্বামীর কি হল তা ভেবেই দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। সেই থেকে টিভির খবরের দিকে প্রতিনিয়ত নজর রাখছিলাম। শনিবার বেলা গড়াতে জানতে পারেন তাঁর স্বামী প্রাণ হারিয়েছেন’।
এদিন স্বামীর মৃতদেহ বাড়িতে পৌছানোর পর আক্ষেপ প্রকাশ করে মমতাজ বিবি বলেন, ট্রেন, দুর্ঘটনার পর থেকে টিভির খবরে দেখতে পাই ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত ও জখমদের পরিবারের পাশে থাকবেন বলে কত প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন নেতা মন্ত্রীরা। কিন্তু সেই সেইসব প্রতিশ্রুতি যে ফাঁকা আওয়াজ হবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারিনি। শেষে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য তুলে তা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া মিটিয়ে তাঁর স্বামী আরমান খাঁ এর মৃতদেহ ফিরিয়ে আনাতে হল। না পেলাম রেল দপ্তরের কাছ থেকে কোনও সাহায্য, না পেলাম নেতা মন্ত্রীদের সাহায্য। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে স্বজন কে হারিয়ে আমাদের গোটা পরিবারটাই এখন অথৈ জলে পড়ে গেল বলে মমতাজ বেগম আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
এদিকে পুলিশ সূত্রেও যা জানা গিয়েছে সেটাও বড় চাঞ্চল্যকর। ট্রেন দুর্ঘটনার মৃত আরমান খাঁর দেহের ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়ি নিয়ে আসতে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে এদিন কাটোয়া মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ও মঙ্গলকোট ব্লকের বি ডি ও-র তত্ত্বাবধানে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে আরমান খাঁ-র মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়।
একই রকম আরও একটি ঘটনা ঘটল করমণ্ডল দুর্ঘটনায় মৃত আরও এক পরিযায়ী শ্রমিকের ক্ষেত্রেও। মৃত শ্রমিকের নাম সাদ্দাম শেখ। বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ায়। বালেশ্বর থেকে মৃত শ্রমিকের দেহ ফিরল অ্যাম্বুল্যান্সে। অ্যাম্বুল্যান্সে কাটোয়ায় দেহ আনতে পরিবারের খরচ হল ২০হাজার টাকা। মৃতের স্ত্রীর হাতের আংটি, গলার চেন বন্ধক রেখে মেটানো হল অ্যাম্বুল্যান্সের খরচ। রেল দপ্তর বা রাজ্যের তরফে দেহ আনতে কোনও রকম সাহায্য না মেলায় ক্ষুব্ধ মৃতের পরিবার।