মেখলিগঞ্জ: বছর দুই আগেও শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই শহরে নাট্যগোষ্ঠীগুলো যেন জেগে উঠত কোনও এক নতুন উদ্যমে। তাদের প্রযোজনায় একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হত মেখলিগঞ্জে। এখানকার কথা ও গান সাংস্কৃতিক ভবনে শহরের নাট্যগোষ্ঠীগুলি তো বটেই, এমনকি হলদিবাড়ি সহ দূরদূরান্ত থেকেও নাট্যগোষ্ঠীরা ছুটে আসত নিজেদের সেরাটা দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে।
কিন্তু বর্তমানে এই সবকিছুই কার্যত অতীত। এর কারণ হিসেবে একদিকে যেমন পরিকাঠামোগত কিছু কারণকে চিহ্নিত করছেন অনেকে, তেমনি উঠে আসছে নতুন প্রজন্মের নাটকের প্রতি অনীহার প্রসঙ্গও। নতুন প্রজন্ম হাল না ধরলে আগামীতে এই শহরের নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এখানকার সংস্কৃতিপ্রেমীরা। নাট্যব্যক্তিত্ব সমীরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘নতুন প্রজন্ম নাটক করার থেকে অন্য কাজে বেশি স্বচ্ছন্দ। আমাদের রিহার্সাল করার নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই। তারপরেও একটা নাটক মঞ্চস্থ করব ভেবেছিলাম।’ কিন্তু তার অভিনেতাদের একসঙ্গে কোনওদিন রিহার্সালে না পাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বলে তিনি জানান। আর এভাবেই চললে শহরের নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্ধিহান তিনি।
আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব রানা সরকারের কথায়, ‘মেখলিগঞ্জে আগে যাঁরা নাট্যচর্চা করতেন কর্মসূত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই এখন শহরের বাইরে। অন্যদিকে, মহিলা চরিত্রে অভিনয় করার মতো শিল্পী পাওয়া যায় না।’ তাঁদের বয়স বাড়ছে, এখনও তিনি আশা করেন নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই নাট্যচর্চার হাল ঠিক ধরবে। এছাড়া, তাদের উৎসাহী করতে নাট্য উৎসব আয়োজন করার কথা ভাবছেন বলে তিনি জানান।
মেখলিগঞ্জে নাট্যচর্চার ইতিহাস স্বাধীনতারও আগের। সে সময়ে স্থানীয় মদনমোহনবাড়ি প্রাঙ্গণে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে বিভিন্ন নাটক এবং সামাজিক যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হত। এরপর দেশভাগের পর এখানকার সিংহপাড়া নিবাসী মনোমোহন সিংহ স্থানীয় নৃপেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল ক্লাবে তৈরি করেন স্থায়ী নাট্যমঞ্চ। সে সময়ের বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায় তখন মহানগরী কলকাতায় যেসব নামকরা নাটক মঞ্চস্থ হত। তিনি কলকাতা গিয়ে সে সমস্ত দেখে বইপত্র সংগ্রহ করে এখানে এনে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে মঞ্চস্থ করাতেন। হ্যাজাক কিংবা গ্যাসবাতির আলোয় প্রতি মাসে এখানে মঞ্চস্থ হত বিভিন্ন সামাজিক নাটক। যদিও নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে এখানকার নাট্যচর্চায়। পরবর্তীতে অনুরণন নাট্যদল, নর্থবেঙ্গল সায়েন্স অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটি, প্রয়াস নাট্য সংস্থা, প্রজন্ম নাট্যগোষ্ঠী ও অদ্বিতীয়া শিল্পীগোষ্ঠীর মতো একাধিক সংগঠনের ক্রমাগত প্রয়াসে নাট্যচর্চা আবার পুরোনো মাত্রা ফিরে পায় মেখলিগঞ্জে। কিন্তু বর্তমানে সেই উৎসাহে পুনরায় ভাটার টান।