- সম্বিত পাল
প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল তাঁর কথা! মহারাষ্ট্র নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন বেলা গড়াতেই ছবিটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন মহায্যুতি জোটের সমর্থকরা বিজয় উল্লাসে মেতে উঠছিলেন। কোথাও বিজেপির পতাকা, কোথাও শিবসেনা বা এনসিপি’র পতাকা বাইকে গুঁজে সমর্থকেরা তীব্রগতিতে রাজপথজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আবিরে আবিরে রাস্তা ঢেকে যাচ্ছিল।
আর তিনি তখনও পরাজয় মেনে উঠতে পারছিলেন না। তিনি উদ্ধব ঠাকরে। মাতোশ্রীতে বসে তিনি তখনও বলছিলেন, মহায্যুতির এই জয় মানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন নয়। সরকার বিরোধী এত ক্ষোভ কোথায় গেল?
বালাসাহেব ঠাকরের ছেলে উদ্ধব আগেই শিবসেনার মূল দলের কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। ২০২২ সালে একনাথ শিন্ডে ৪০ জন বিধায়ককে নিয়ে শিবসেনাকে দুই টুকরো করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। মহারাষ্ট্র বিধানসভার স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনের বিচারে শিন্ডের শিবসেনা মূল দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবু সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এবং গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে একটি আশার আলো উদ্ধব ঠাকরের মনে ছিল বটে। লোকসভায় ১৩টি আসনে মুখোমুখি লড়ে িশন্ডে সেনা ৭টি ও উদ্ধব সেনা ৬টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এর মধ্যে শিন্ডে সেনার প্রার্থী একটি আসনে মাত্র ৪৮টি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু সেই আশার আলো ছয় মাস পরে বিধানসভা নির্বাচনে নিভে গেল। বরং আড়াই বছর পরে মানুষের দরবারে একনাথ শিন্ডে শিবসেনার পাকাপাকি দখল পেয়েছেন।
এই ফলের নিরিখে মনে করা হচ্ছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে ঠাকরে যুগের অবসান হল। ষাটের দশকে কার্টুনিস্ট থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা বালাসাহেব ঠাকরে মারাঠি অস্মিতার কথা বলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। বিশেষত, দক্ষিণ ভারতীয়দের চাপে কীভাবে নিজভূমে মারাঠিরা কোণঠাসা, এটাই ছিল বালাসাহেবের ভাষ্য। ১৯৬৬-তে তৈরি হয় শিবসেনা। বালাসাহেবের বাবা কেশব সীতারাম ঠাকরের অনুপ্রেরণাতেই দলের জন্ম। শুরু থেকেই উগ্র এবং হিংসা-নির্ভর রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বালাসাহেব। শিবসৈনিকরা পরিচিতই ছিলেন মারপিট, ভাঙচুর করার জন্য। দশক ঘুরতে না ঘুরতেই শিবসেনা মারাঠি অস্মিতার পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্ববাদকেই তাদের রাজনীতির মূল স্তম্ভ করে ফেলে। নয়ের দশক জুড়ে দাঙ্গা হোক বা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বাতিল বা মুম্বই থেকে বাংলাদেশি বিতাড়ন- সবকিছুতেই জড়িয়ে যায় শিবসেনার নাম। বালাসাহেবের দল বিজেপির স্বাভাবিক শরিক হয়ে উঠে।
এহেন শিবসেনা বারবার ভাঙন দেখেছে। অতীতে ছগন ভুজবল ১০ জন বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ২০০৫-এ বালাসাহেবের ভাইপো রাজ ঠাকরে দল ছেড়েছেন। এর পরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রানেও ১০ জন বিধায়ক নিয়ে দল ছাড়েন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনি রাজনীতিতে ভালো ফল করলেও মূল শিবসেনার কর্তৃত্ব বরাবর ঠাকরে পরিবারের হাতে থেকেছে। বরং এই সব নেতারা পিছিয়েই পড়েছেন। যেমন এবারের নির্বাচনে রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা একটি আসনেও জিততে পারেনি। এমনকি রাজের ছেলে অমিত ঠাকরেও এই নির্বাচনে মাহিম কেন্দ্র থেকে হেরে গিয়েছেন।
বিজেপি শিবসেনাকে গ্রাস করে নিচ্ছে এই ভয়েই বিজেপির সঙ্গে জোট করে ২০১৯ বিধানসভা নির্বাচনে লড়লেও, ফল বেরোনোর পরে উদ্ধব কংগ্রেস ও শারদ পাওয়ারের এনসিপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বালাসাহেবের উগ্র হিন্দুত্ববাদ থেকেও শিবসেনাকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তাঁকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না বলেও শিবসেনার নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ ছিল তাঁর উপর। এই সবই হাতিয়ার করে এগিয়েছেন একনাথ। গত আড়াই বছরে জনদরদী ও জনগণের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একনাথ শিন্ডে। জনমোহিনী প্রকল্প ঘোষণার পাশাপাশি, দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে গিয়েছেন একনাথ। একজন সাধারণ নেতার মতো জনগণের সঙ্গে মিশেছেন। এখনও উগ্র হিন্দুত্ববাদের দিকে না দৌড়ালেও, অচিরেই শিবসেনাকে আবার সেই পথেই নিয়ে যাবেন একনাথ। লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত যে আবেগ উদ্ধবের সঙ্গে ছিল, গত ছয় মাসে তা অনেকটাই ম্লান। উদ্ধবও নতুনভাবে শিবসেনাকে মানুষের সামনে নিয়ে যেতে পারেননি। গতানুগতিকভাবে শিন্ডেকে বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করেছেন। জনগণের দরবারে এই নেতিবাচক রাজনীতি পরাজিত।
মারাঠা নেতা হিসেবে যখন শিন্ডে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে পরিচিত হয়ে উঠছেন, তখন আর এক মারাঠা অধিপতির পতনও দেখাল এবারের বিধানসভা নির্বাচন। ৮৭টি আসনে লড়ে মাত্র ১০টি আসনে নিজের প্রার্থীকে জেতাতে পারলেন শারদ পাওয়ার। তাঁকেও মাথা নোয়াতে হল ভাইপো অজিত পাওয়ারের কাছে।
পুরোপুরি শিবসেনার ঢঙেই এবং বিজেপির প্ররোচনায় সিংহভাগ বিধায়ককে নিয়ে ২০২৩-এর জুলাইয়ে শারদ পাওয়ারের এনসিপি ছেড়েছিলেন অজিত পাওয়ার। স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে মূল এনসিপি’র কর্তৃত্বও অজিতের হাতে আসে। তিনিও লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি দেখেছিলেন। মাত্র ১টি আসনে জিতেছিলেন তাঁর প্রার্থী। কাকা শারদ পাওয়ারকে ‘পিছন থেকে ছুরি মারার’ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। নিজের স্ত্রী সুনেত্রা পাওয়ারকে নিজেরই খাসতালুক বারামতি থেকে জেতাতে পারেননি তিনি। জিতেছিলেন শারদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলে। কিন্তু ছয় মাসের ব্যবধানে সেই বারামতি কেন্দ্র থেকেই কাকা শারদের বেছে নেওয়া এবং অজিতের ভাইপো যুগেন্দ্র পাওয়ারকে এক লাখেরও বেশি ভোটে হারালেন অজিত। শুধু তাই নয়, এনসিপি’র মূল প্রতীক ঘড়ি চিহ্নে ৪১ জন বিধায়ককেও জিতিয়ে আনলেন তিনি।
এক দিক থেকে দেখতে গেলে শারদ পাওয়ারের এনসিপি’র উত্তরাধিকার অজিতের হাতেই এল। যদিও শারদ পাওয়ার তাঁর কন্যা সুপ্রিয়া সুলেকেই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বারামতিতে অজিত পাওয়ার সেই ৯০-এর দশক থেকে বিধায়ক হিসেবে কাজ করছেন। এলাকার সমবায়, চিনিকল, ব্যাংকগুলিতে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। নিজের কেন্দ্রের জন্য জান দিয়ে কাজ করেছেন। উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বারামতি ও পুনে জেলাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
অজিত বিজেপির সঙ্গে দরকষাকষি করে প্রায় সারা মহারাষ্ট্রজুড়ে প্রার্থী দিয়েছিলেন। এনসিপি’র গড় পশ্চিম মহারাষ্ট্র তো বটেই অজিতের বেছে নেওয়া প্রার্থীরা অন্যান্য অঞ্চল থেকেও জয়ী হয়েছেন। মূলত বিদায়ি বিধায়কদের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন অজিত। তাঁরা বেশিরভাগ জায়গাতেই স্থানীয় সমীকরণ ঠিক রেখে নিজেদের জোরে জিতেছেন। অন্যদিকে, পাওয়ার এমন প্রার্থীর উপর ভরসা রেখেছিলেন, যাঁরা নিজেদের অর্থবল ও পেশিবলে জিততে পারেন। কিন্তু লাভ হয়নি।
ছয়ের দশক থেকে কংগ্রেসি রাজনীতি করা পাওয়ারের মতো কূট রাজনীতিক ভারতবর্ষ খুব কম দেখেছে। সোনিয়া গািন্ধকে কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে দেখতে চান না বলে ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস ভেঙে এনসিপি তৈরি করেছিলেন পাওয়ার। বারবার পিছিয়ে গিয়েও আবার এগিয়েছেন রাজনীতিতে। পাওয়ার হারার পাত্র নন। একবার ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বাসনা জাগায় তিনি কলকাতায় এসে বোর্ডের বার্ষিক সভায় তৎকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। প্রথমবার হেরে গেলেও হাল ছাড়েননি তিনি। পরের বারের নির্বাচনে ডালমিয়া গোষ্ঠীকে হারিয়েই তিনি বোর্ডের সভাপতি হন। পরবর্তীতে আইসিসি’র। এমনই জেদ নিয়ে রাজনীতি করেন তিনি।
কিন্তু উদ্ধবের যদিও বা ঘুরে দাঁড়ানোর বয়স রয়েছে, প্রশ্ন উঠছে আশি পেরোনো অসুস্থ শারদ পাওয়ারের পক্ষে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব কি না। উদ্ধবের সামনে বৃহন্মুম্বই কর্পোরেশনের নির্বাচন রয়েছে। দেশের ধনীতম পুরসভার ক্ষমতা দখল করেই শিবসেনার নির্বাচনি রাজনীতির পরিপক্বতার শুরু। সেই নির্বাচন দিয়েই উদ্ধব ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না তা দেখতে হবে। কিন্তু পাওয়ার আবার মেয়ে সুপ্রিয়াকে নিয়ে মূল এনসিপি’র কর্তৃত্ব নিজের হাতে আনতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। নাকি নিজের এনসিপি-কে অজিতের গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার সমঝোতা করবেন তাও দেখতে হবে। যদিও নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, আসন সংখ্যার বিচারে যাই হোক না কেন, শারদের এনসিপি’র পক্ষে ১১ শতাংশ ও অজিতের এনসিপি’র পক্ষে ৯ শতাংশ ভোটারদের সমর্থন রয়েছে।
রাজনীতিতে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। শারদ পাওয়ারের মতো মারাঠা নেতা এবং বালাসাহেব ঠাকরের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে একনাথ শিন্ডেই কি মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে উঠে আসবেন নাকি ডিজিটাল ভারতের পরিবর্তিত রাজনীতি আরও নতুন চমক নিয়ে আসবে? আরব সাগরের ঢেউ কাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কাকেই বা তীরে ভিড়িয়ে দিয়ে যায়, তা দেখতে হবে।
(লেখক পুনের বাসিন্দা। এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)