উত্তর সম্পাদকীয়

জেন জেড প্রজন্মের ভোট ভাবনা অন্য

  • অর্ক দেব

ঝুলন সাজানো হচ্ছে দেশজুড়ে। রুদ্ধশ্বাস খেলা শুরু হল বলে। স্রেফ বাঁশি বাজার অপেক্ষা। ১৪০ কোটি ভোটার, কারও নজরে মেয়েদের ভোট, কেউ তাকিয়ে আছে নিম্নবর্গের দিকে। তবে দলমত নির্বিশেষে নেতাদের ‘কমন ইন্টারেস্ট’ একটাই। তা হল তরুণদের ভোট। তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতেই প্রচার কৌশল সাজাচ্ছে সবাই। কেন সকলের পাখির চোখ তারুণ্য, উত্তর লুকিয়ে আছে পরিসংখ্যানে।

এই মুহূর্তে দেশের মোট ভোটারের ৬৫ শতাংশ বয়স ৩৫-এর নীচে। অর্ধেক ভোটারের বয়স ২৫-এর কম। ফলে রাজনৈতিক নেতারা বুঝে গিয়েছেন, তরুণের মন পেলে বৈতরণি পার হওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। এই কারণেই কংগ্রেসের ন্যায়পত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুবদের জন্য ন্যায়। ভোটের আগে বারবার কমবয়সিদের সঙ্গে কথা বলেছেন রাহুল গান্ধি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সংবাদসংস্থা এএনআই-এর পডকাস্টে এসে তরুণদের জন্য প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। ঠিক যেমন প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে। কিন্তু তাতে কি চিঁড়ে ভিজবে? নতুন ভোটারের প্রথম পছন্দ কে হবে, তারা কোন বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে ভোট দেবেন? বছর চারেক আগেই কোটি কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচার করলেও তরুণ প্রজন্মের ৬৫ শতাংশ বেছে নেয় জো বাইডেনকে। তারুণ্য কি এবার এমন ম্যাজিক দেখাবে আসন্নপ্রায় লোকসভা নির্বাচনেও?

মনে রাখতে হবে, এই অষ্টাদশ-অষ্টাদশীরা জেন জেড প্রজন্ম। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যক্ষভাবে ইন্টারনেটের ছত্রছায়ায় বড় হয়েছে। কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই হাতের মুঠোয় পেয়েছে স্মার্টফোন। ফলে তাদের জীবন তথ্যমুখর। অপেক্ষাকৃত বড়রা যেভাবে ধারণা আর বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ভোট দেয়, এই প্রজন্মের গড়ন তেমন নয়। তারা তথ্য সংগ্রহের নিজস্ব প্রকরণ তৈরি করেছে, পাশাপাশি নির্মোহ তথ্য বিশ্লেষণে আগ্রহী। রাজনীতি নিয়েও তারা যথেষ্ট ভাবিত।

২০২৩ সালের বাম্বেল এবং সেনসাস-ওয়াইড যৌথভাবে ২৮ হাজার তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলে। তাতে দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ মনে করে, ভোট ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ খুব আকর্ষণীয়। ৪৪ শতাংশ মনে করে, খোলামনে রাজনৈতিক বিষয়গুলি বোঝা জরুরি। ৪৬ শতাংশ মনে করে, জীবনে রাজনৈতিক যোগাযোগ জরুরি। ১৫ শতাংশ বলেছিল, যে ভোট দেবে না সে আমার মন পাবে না। তরুণরা ভোট দিচ্ছে নিশ্চিত, কিন্তু কাকে ভোট দেবে?

২০১৪ সালে বিজেপি দেশের তরুণ প্রজন্মের ভোটের ৩৪ শতাংশ ভোট পায়। ২০১৯-এ তরুণ ব্রিগেডের ভোট আরও ৭ শতাংশ বাড়ে। তাহলে কি তৃতীয়বারে চারশো পার সুনিশ্চিত করবে জেন জেড-ই? উত্তরে কাঁটার মতো বিঁধছে সিডিএস-এর পরিসংখ্যান। ২০২১ সালের এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশের তরুণ-তরুণীর ৪৫ শতাংশ মনে করে, কর্মসংস্থানের অভাব দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী দুই দফায় কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই চাহিদা আর জোগানের বৈষম্য, ভাবের ঘরে চুরি বিজেপির বিপদ ডেকে আনতে পারে বহু জায়গায়। মহিলা বা মুসলিম ভোটের মতোই মাথাব্যথা হতে পারে তরুণের স্বপ্ন। গত নির্বাচনে তরুণদের মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট দিয়েছিল কংগ্রেসকে। চাকরি সংক্রান্ত স্বপ্নভঙ্গের কারণেই এই ভোটপ্রাপ্তির পরিমাণ বাড়তে পারে বিরোধী কংগ্রেস বা আম আদমি পার্টির। আর এই বাংলায়?

আশঙ্কা থাকছে, গোটা দেশেই যখন তরুণদের একটা বড় অংশ চাকরির প্রশ্নে শাসকের শক্তিশালী বিকল্প খুঁজবে, রাজ্যে হবে এর উলটো। কারণ তৃণমূল চাকরির সুরাহা-সুবন্দোবস্ত করবে, এ কথা গিলতে অতি তৃণমূলভক্তেরও বেশ কষ্ট হবে। মোদির দু’দফা শাসনকালে যে কাজ নিয়ে বিরক্ত, সে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় দফায় বিশ্বাস করবেই বা কেন? শোনা কথা নয়, তরুণরা বিশ্বাস করে চোখের দেখায়। আর বাস্তবে তারা দেখছে, রাজ্যে কোনও ভারী শিল্প আসে না। বছর বছর জনতার টাকায় একটা বাণিজ্য সম্মেলন হয়। কিন্তু তার ফলাফল কী, কতজন চাকরি পাবেন, কোন শিল্প আসবে, তার অনুসারী শিল্প কী কী  হবে, কেউ জানতে পারে না। চাকরিপ্রার্থীরা বাধ্যত রাস্তায় ধর্না দেয়। নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি চলে। নিয়োগ জরুরি এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা সে ট্রাফিক হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়, ছেলেমেয়েরা বাধ্যত দেখে ‘সিভিক নিয়োগ’। তৃণমূল ভাতা দেয়, চাকরি দেয় না, এই বোধ তরুণমনের গভীরে প্রোথিত। আর কোনও তরুণই ভাতায় সন্তুষ্ট হয়ে বাঁচার কথা ভাবতে পারে না। তারা বিকল্প খুঁজবে চাকরির প্রশ্নে।

তরুণের ভোট পিছলে যেতে পারে, এই অনুমান থেকেই কি প্রশান্ত কিশোর বাংলায় তৃণমূলের চেয়ে বিজেপিকে এগিয়ে রাখছেন? সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো বিষয়গুলি প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার একাংশ রেখেঢেকে পেশ করলেও, এই প্রজন্মের বড় অংশের কাছে কিছুই চাপা থাকেনি। কারণ এদের বেশিরভাগই ইনস্টা-এক্স (সাবেক টুইটার)-এ অভ্যস্ত। তুলনায় ফেসবুকে তাদের কম যাতায়াত। আর এই দুর্নীতি বিষয়ক তথ্যে এক্স হ্যান্ডেলগুলিতে, ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রে তোলপাড় চলেছে লাগাতার। কাজেই একজন প্রকৃতার্থে নিরপেক্ষ চোখ-কান খোলা তরুণ চাকরি-দুর্নীতির প্রশ্নে তৃণমূল-বিজেপিকে এক আসনে বসালে তাকে অযৌক্তিক বলা যাবে কি?

সিপিএম পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেই লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে একঝাঁক তরুণকে। দলের বৃদ্ধতন্ত্র অবসানের লক্ষ্যে প্লেনামে নীতি গৃহীত হয়েছিল অনেক আগেই। সেসব কার্যকর হওয়ার আগেই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তরুণদের মাঠে নামিয়েছে। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই, সাংগঠনিক শক্তি কম জেনেও সৃজন ভট্টাচার্য, দীপ্সিতা ধর, প্রতিকূর রহমান-রা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। অনেকের লড়াই রীতিমতো হেভিওয়েটদের সঙ্গে। অভিমন্যুর পরিণতি হতে পারে জেনেও তরুণদল রোদ মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা নেটদুনিয়ার পরিভাষায় সড়োগড়ো। কথায়-গানে চারপাশ মাতিয়ে রাখতে পারে। নিজের প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের সংকটগুলি যথেষ্ট বোঝে। সরলভাষায় মানুষকে বোঝাতে পারে। কেউ দাবি করতে পারবে না, তাদের চলাচল বন্ডের টাকায়, এটাই তাদের শক্তি। ফলে, আগের থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় দেখাচ্ছে বামপন্থীদের। খেলার আগে মাঠ ছাড়ছে না তারা। বিজেপি যে আসনগুলি জিতেছিল তার অনেক ক’টিতেই ভোট শতাংশ বাড়বে নিশ্চিত তারা।

তবে আশা যেমন আছে, তেমন আছে আশঙ্কাও। বামেরা এখন শূন্যে দাঁড়িয়ে। খাতা খুললে দলের আত্মবিশ্বাস বাড়বে একথা যেমন ঠিক, তেমনই সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসের বিচারে তা এতই ক্ষীণ যে এখনই তারা পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার শক্তি অর্জন করবে এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নির্বাচনি অভিজ্ঞতাও তাদের কম। লোকসভা ভোট দিল্লিদখলের লড়াই। এই লড়াইকে স্থানীয় কাজিয়ায় পরিণত করে কতটা লাভ হবে সে প্রশ্নও নিশ্চয়ই কারও কারও মনে ঘুরবে।

বিজেপির ক্ষেত্রে অবশ্য সুপারম্যান থিয়োরি প্রযোজ্য। তরুণের বলভরসা মোদি। তাঁর বৃষস্কন্ধই সবটা বুঝে নেবে। ফলে প্রার্থীর মুখ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারুণ্যই যে অগ্রাধিকার পাবে বলা যায় না। ভোটের ময়দানে চরকিপাক খাচ্ছেন অভিনেতা হিরণ, সৌমিত্র খাঁ’রা। তবে তারুণ্যের ঝাঁঝই তাঁদের ভরসা, এ কথা বলা কঠিন।

নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই রাহুল গান্ধি দেশের যুবসমাজকে বারবার বার্তা দিয়েছেন। তবে বাংলায় তাঁর যাত্রা উত্তরেই আটকে ছিল। ইতিমধ্যে ভোটপর্বে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শা’রা যখন ফের বাংলায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু রাহুলের দেখা নেই। কাজেই বাঙালি তরুণরা তাঁকে দেখে, তাঁকে পেতে ভোট দেবেই, এ কথা হলফ করে বলা যায় না। শেষমেশ দুটো পথ খোলা থাকে, ভোট না দেওয়া অথবা নোটায় ভোট দেওয়া। জনতাকে প্রথম পথে যেতে নিরুৎসাহিতই করা উচিত। প্রয়োজন হলে কেউ না বলার অধিকার প্রয়োগ করে দেখুক না।

 (লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Weather Report | তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে অস্বস্তি, সোমেই হাওয়া বদল বঙ্গে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের তীব্র গরমে পুড়ছে রাজ্যবাসী। শনি ও রবিবার উত্তর ও দক্ষিণ…

56 mins ago

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী…

11 hours ago

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান…

12 hours ago

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…

13 hours ago

Mamata Banerjee | সিপিএমের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন শুভেন্দু-শিশির! নাম না করেই বিস্ফোরক ইঙ্গিত মমতার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে…

13 hours ago

Malda news | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া…

14 hours ago

This website uses cookies.