আরজি কর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদ আন্দোলন তৃণমূল সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আবার বিরোধী দলগুলির রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকে প্রকাশ্যে এনেছে। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন ও রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন বিক্ষোভ ও মিছিলের অধিকাংশের প্রকাশ্য চরিত্র অরাজনৈতিক। ১৪ অগাস্টের রাত দখল কর্মসূচিতে লাখো মানুষের উপস্থিতি সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও প্রশাসনের ওপর মানুষের ক্ষোভ, হতাশার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। চেষ্টা সত্ত্বেও ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্রের কারণে বিক্ষোভে বিরোধী দলগুলি জায়গা নিতে পারেনি।
বিক্ষোভের প্রকৃতিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মানুষ বিকল্প খুঁজছেন। রাজনৈতিক ব্যানার ও স্লোগান ছাড়া বিক্ষোভগুলিতে স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি মানুষের অসন্তোষ প্রকাশ্যে এনেছে। তৃণমূল সরকার শুরুর দিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে মানুষের আরও আস্থা হারিয়েছে। পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে সিপিএম, বিজেপি মাঠে নামলেও দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আগ বাড়িয়ে বিক্ষোভস্থলে গিয়ে সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলকে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান শুনতে হয়েছিল। এসব কারণে হতাশ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষরা। শুভেন্দু তো ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তোলা জুনিয়ার ডাক্তারদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নেশাড়ু’ পড়ুয়া বলে দেগে দিয়েছেন। পাশে বসে তাঁকে নীরব সমর্থন জুগিয়েছেন রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, মেঘালয়-ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়রা।
যাদবপুরের পড়ুয়া মাত্রই বামপন্থী- এই অতিসরলীকরণ যে কারও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশিত করে। জুনিয়ার ডাক্তাররা এরকম মনোভাবের কড়া জবাব দিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি, বহিরাগতদের স্লোগান নিয়ে হইচই করে শুভেন্দু আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়ার ডক্টরস ফ্রন্টের স্পষ্ট মনোভাব, রাজ্যের ক্ষমতা দখলের দলীয় লক্ষ্যে কিছু রাজনৈতিক দল গোড়া থেকে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে সক্রিয়।
হাথরস-কাঠুয়া-উন্নাওতে যাঁরা ধর্ষকদের মালা পরিয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতা দখলের চক্করে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না বলে জুনিয়ার ডাক্তারদের নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁরা ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন। যেমন, মহালয়ার দিন নির্যাতিতার জন্য জুনিয়ার ডাক্তাররা তর্পণ করবেন বলে সামাজিক মাধ্যমে খবরটি ভুয়ো। জুনিয়ার ডাক্তারদের এরকম কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে চলা এই আন্দোলনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিজেপির ভূমিকা নগণ্য। কার্যত তাদের প্রথম প্রতিবাদ ছাত্রসমাজের নাম করে ডাকা নবান্ন অভিযান। সেখানেও চাপে পড়ে আন্দোলনকারীরা ‘বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক নেই’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘ পরিবার বিজেপির তারকা-নেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে হাজির করে উত্তর কলকাতায় পৃথকভাবে বিবেক জাগরণ যাত্রা করেও সাফল্য পায়নি।
সিপিএম পতাকা, ব্যানার সরিয়ে বাজার গরম করা স্লোগান হাজির করেছে বেশ কিছু। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলা সদর ও গঞ্জ এলাকায় সহ বিভিন্ন মিছিলের নেপথ্যে ছিল সিপিএম ও অন্য বামদলগুলি। সিপিএমের গণসংগঠন এবিটিএ, আইপিটিএ, ডিডব্লিউএ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘও সক্রিয় ছিল। ছোট বাম দলগুলি নানাভাবে চেষ্টা করেছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। পাশাপাশি প্রচুর মানুষ, যাঁরা সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় নন, তাঁরাও আন্দোলনের রাজনীতিকরণের চেষ্টাকে ব্যর্থ করেছেন।
২০১১-তে বামফ্রন্ট সরকারের পতনে মানুষই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন তাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ওই গণবিক্ষোভে সুশীল সমাজের আহ্বানে লাখো লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। এবারও সেলেব্রিটিরা সহমর্মিতা প্রকাশে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। এই বিক্ষোভে কিছু বদল আসছে। হয়তো আরও আসবে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের প্রত্যাশা করার মতো উপাদান আছে।