জাতীয়

বিশ্ব কল্যাণের বাণীতে জি-২০-র সুর বাঁধলেন ‘ভারতে’র প্রধানমন্ত্রী

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: ‘হেবম লোকসা: হিতমুখ: তি, অথ: ইয়ম নাতিসু হেবম’। অর্থাৎ মানব কল্যাণ এবং সুখসমৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা হোক একমাত্র লক্ষ্য। শনিবার নয়াদিল্লির ভারত মণ্ডপম সেন্টারে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সার্বিক সুর প্রাকৃত ভাষায় এই শ্লোকের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ভাবে বেঁধে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর মতে, ‘করোনা পরিস্থিতিতে যে বিশ্বাসের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল সমগ্র বিশ্বে, যুদ্ধ (রুশ-ইউক্রেন) সেই ক্ষতকে আরও গভীর করেছে। আমরা যদি সকলে একসঙ্গে করোনাকে পরাস্ত করতে পারি, তাহলে এই সঙ্কটও নিশ্চিতভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব। এটা সবাই একসঙ্গে মিলে চলার সময়। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ মহামন্ত্রই আমাদের ক্রমে পরিচালিত করবে মানব কল্যাণ ও বিশ্বের হিতসাধনে।’ উদ্বোধনী ভাষণে মোদি এও বলেন, ‘আজ যখন আমরা এই সম্মেলনে বিশ্বের হিতের জন্য চর্চায় বসেছি, দিল্লিতে আড়াই হাজার বছর পুরোনো একটি স্তম্ভে লেখা রয়েছে মানবজাতির কল্যাণের কথা।’ এই সম্মেলনে সেই বার্তা আরও বেশি বাস্তবায়িত করার আবেদন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে অকালবর্ষণকে ‘শুভ’ মনে করা হয়। মেঘলা আকাশ, দু-এক পশলা বৃষ্টি ও বাতানুকূল পরিবেশে শনিবার নয়াদিল্লির প্রগতি ময়দানে সুদৃশ্য ভারত মণ্ডপম সেন্টারে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের শুভারম্ভ হল। জি-২০ সামিটের প্রারম্ভিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে সকাল সকাল, পাঁচতারা হোটেল ছেড়ে প্রগতি ময়দানে ভারত মণ্ডপমের সামনে ভিড় জমালেন রাষ্ট্রনায়কেরা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব অতিথি-অভ্যাগতদের সাদর আমন্ত্রণ জানালেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। শুধু তাই নয়, খুবই আন্তরিকভাবে কখনও শারীরিক কুশলতা, কখনও বা প্রশংসা, হালকা মেজাজে রসিকতা করতেও দেখা যায় মোদিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রধান স্বাগত দ্বারে লাগানো সুবিশাল কোনার্কের সূর্যমন্দিরের কাল চক্রের রেপ্লিকার মর্মার্থ বোঝাতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সভায় আগত ঋষি সুনক, শেখ হাসিনা, সের্গেই লাভরভ, ম্যাঁক্রোর মতন রাষ্ট্রনেতাদের কখনও হাতজোড় করে প্রণাম, কখনও করমর্দন আবার ‘বিয়ার হাগে’ও মোদি ছড়িয়েছেন আন্তরিকতা।

এদিন ‘চিফ হোস্টে’র ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাগিদে সকাল ৯টার মধ্যে ভারত মণ্ডপমে এসে পৌঁছোন মোদি। সকাল ১০-৩০টায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম পর্বের বৈঠক ‘ওয়ান আর্থ’ বা ‘এক বিশ্বে’র বৈঠক শুরু হয়৷ মূলত জি-২০’র মূল নির্যাস-‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এবং এক ভবিষ্যতে’র ক্রমে ভাগ করা হয়েছে অধিবেশন। সেই সূত্রে একে একে সম্মলন স্থলে উপস্থিত হয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন, উপস্থিত হয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস আধানম প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে সূচনাপর্বে মরক্কোয় ভয়াবহ ভূকম্পে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে নীরবতা পালন করেন সকলে। এরপর উদ্বোধনী ভাষণে সমবেত অতিথি অভ্যাগতদের আন্তরিক স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীর এই সময় গোটা বিশ্বকে এক সদর্থক ও হিতকারী দিশা দেখাচ্ছে যা মানবিক ও মানবকল্যাণের সহায়ক। এই সেই সময় যা, গোটা বিশ্বের সন্মুখে পুরনো অমীমাংসিত কর্তব্য পূরণে আহ্বান জানাচ্ছে। নব্য ‘হিউম্যান সেন্ট্রিক অ্যাপ্রোচে’র মাধ্যমে এই দায়িত্বপালনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই প্রকল্পে বিশ্ব অর্থনীতি, সামাজিক পরিকাঠামোয় স্থিতিশীলতা, খাদ্য-সংকট, জ্বালানি উৎপাদনে ঘাটতি দূর করবার পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ, সাইবার নিরাপত্তা বেষ্টনী মজবুতি, ‘হেলথ্, এনার্জি, বর্ডার সিকিউরিটি’কে আরও জোরদার করার বার্তা দেন প্রধানমন্ত্রী।

মোদি উল্লেখ করেছেন, ভারতে ৬০টিরও বেশি শহরে ২০০-র বেশি বৈঠক হয়েছে জি-২০ নিয়ে। জানিয়েছেন, ভারতের প্রস্তাব ছিল ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’কে যাতে জি-২০-র সদস্যপদ দেওয়া যায়। সবার সমর্থন নিয়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টকে সদস্য আসন গ্রহণ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রধান এসে মোদিকে আলিঙ্গন করেন। প্রবল করতালি সহযোগে সকলে তাঁকে স্বাগত জানান। এর পর শুরু হয় জি-২০’র প্রথম পর্বের আলোচনা, পরে মধ্যাহ্নভোজের পর দ্বিতীয় পর্ব (ওয়ান ফ্যামিলি) নিয়েও আলোচনা হয় এদিন। দুটি অধিবেশনেই নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। রবিবার সকালে হবে তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ ‘ওয়ান ফিউচার’ বা এক ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চর্চা। তার আগে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধির স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা অর্পণ করবেন রাষ্ট্রনায়করা।

অবশ্য এত কিছুর পরেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি প্রধানমন্ত্রী মোদির। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে শনিবার জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী মঞ্চের পোডিয়ামে দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে ‘ভারত’ লেখা ছিল। মোদি যখন ভাষণ দিচ্ছেন তাঁরা সামনে বসানো ‘নেশন প্লেটে’ জ্বলজ্বল করছে ‘ভারত’ এর নাম। ঘটনাচক্রে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে আগত সমস্ত বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর পাঠানো নৈশভোজের যে আমন্ত্রণপত্র ঘিরে বিতর্কের সূচনা, শনিবার আবারও তা উঠে এল জি-২০র মঞ্চে। ওই আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি কাউকে কোনও চিঠি লিখলে তাতে চিরাচরিত ভাবে লেখা থাকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ শব্দটা। এই পরিচয়লিপির বদল ঘিরে বিতর্কের আবহে গত মঙ্গলবার নরেন্দ্র মোদীর ইন্দোনেশিয়া সফরের সূচিতে মোদির পদ লেখা হয় ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’। বিরোধী সূত্রে এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ্যে আসেনি।

বস্তুত, মোদির ভাষণে এদিন নাম না করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আশঙ্কাপ্রকাশ নতুন করে জল্পনা উস্কে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এর উপস্থিতিতে মোদির এই মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহলের একাংশ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী দুনিয়ার ধারাবাহিক চাপ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেনি ভারত। এমনকি, মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিন্ন করেনি। সেই নীতিতে অটল থাকার বার্তা দিয়েই মোদী বলেন, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ মন্ত্রেই আস্থাহীনতার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদের।’ কিন্তু এই ‘আস্থাহীনতা’র উল্লেখই জি-২০’র মঞ্চে মস্কোকে অস্বস্তিতে ফেলতে বাধ্য বলে মনে করছেন প্রথম সারির কূটনীতিকরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দিনের শেষে প্রকাশিত ‘দিল্লি ডিক্লারেশন’ বা নয়াদিল্লির ঘোষণাপত্রে অন্তত চারটি জায়গায় ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ রয়েছে, যেখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে মোদীর তরফে উল্লেখ করা হয়, ‘এই শতক যুদ্ধের শতক নয়।’

শনিবার রাতে ভারত মণ্ডপম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ডাকা নৈশভোজের আসর। জি-২০ সম্মেলনে আগত রাষ্ট্রনায়করা ছাড়াও একাধিক মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা উপ রাজ্যপাল এই নৈশভোজে অংশ নেবেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পঞ্জাব মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিনের মতো একাধিক মুখ্যমন্ত্রীরা ইতিমধ্যে দিল্লি এসে পৌঁছেছেন, উপস্থিত হয়েছেন জি-২০’র আসরে। তবে কর্নাটক, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কেরল তথা ওডিশার মতো ৭ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা অংশগ্রহণ করছেন না এই বিশেষ নৈশভোজে, জানা গিয়েছে কেন্দ্রীয় সূত্রে। নৈশভোজ শুরু হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত হবে ‘ভারত বাদ্য দর্শনম’ শীর্ষক বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান, যাতে অংশ নেবেন পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত ৭৮ জন কৃতি যন্ত্র সংগীতশিল্পী। ‘রাবনহত্তা’, ‘রুদ্রবীণা’, ‘সরস্বতী বীণা’র মতো প্রায়-লুপ্ত সব বাদ্যযন্ত্রের বিরল সমাহার বসবে ভারত মণ্ডপমে। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে এই নৈশভোজের আসরে মুখোমুখি হতে পারেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের আগে মমতা-হাসিনা কথোপকথন নতুন কি দিকনির্দেশ করে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কূটনৈতিক সম্পর্কে।

Web Desk

Uttarbanga Sambad is leading online news publisher in West Bengal. Every single article post checked after verify and fact checking by our own staff.

Recent Posts

IPL | ধোনির চেন্নাইকে হারিয়ে আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে শেষ চারে বেঙ্গালুরু

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে প্লে অফে উঠল বেঙ্গালুরু। বেঙ্গালুরু বনাম চেন্নাইয়ের…

9 hours ago

Siliguri | তিস্তায় জলস্তর বেড়ে আটক ২, উদ্ধারে শুরু তৎপরতা

শিলিগুড়ি: পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির জেরে তিস্তার জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তি ঘটলো রংপোতে। নদীতে আটকে…

9 hours ago

Patiram | ঘুমের মধ্যেই বেহুঁশ করে চুরি, যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেলো চোরের দল

পতিরাম: এ যেন ফিল্মি কায়দায় চুরি। পরিবারকে গ্যাস স্প্রে করে অচৈতন্য করে বাড়ির সর্বস্ব চুরি…

10 hours ago

Bomb Recovered | বিস্ফোরণের পর ফের উদ্ধার জারভর্তি বোমা, নিষ্ক্রিয় করল বম্ব স্কোয়াড

কালিয়াচক: কালিয়াচকের রাজনগর মডেল গ্রামে বোমা বিস্ফোরণের পর আরও এক জার বোমা উদ্ধার (Bomb recovered)…

11 hours ago

Minority Scholarship Scam | স্কলারশিপের টাকা আত্মসাৎ! অভিযুক্ত ২ জনকে হেপাজতে চায় সিআইডি

বিশ্বজিৎ সরকার, করণদিঘি: মাইনোরিটি স্কলারশিপের (Minority Scholarship Scam) কোটি কোটি টাকা তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত মহম্মদ…

11 hours ago

Raiganj | গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ, বহালতবিয়তে ঘুরছে দুই অভিযুক্ত

রাহুল দেব, রায়গঞ্জ: আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও খুনের চেষ্টার ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার(Arrest) করেনি পুলিশ। এলাকায় বহালতবিয়তে…

11 hours ago

This website uses cookies.