শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

আনন্দে বিষাদে টাইটানিকের আঁতুড়ে

শেষ আপডেট:

 

  • দেবব্রত সান‍্যাল

জলপাইগুড়ি আর কলকাতায় বেজায় গরম পড়লেও তিব্বত যাওয়ার উপায় ছিল না। ‘কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট’ অবধি ম‍্যানেজ হলেও তিব্বত ম‍্যানেজ হতে চায় না। তখন আমাদের ছেলে-বৌমা বলল, আমাদের এখানে চলে এসো। এখন গরমকাল হলেও কলকাতার মতো গরম নেই। মে মাসে গায়ে কম্বল দিয়ে শোওয়া, তারপর সেই কথাটা ফেসবুকে পোস্ট করে যারা দেশে বেগুনপোড়া হচ্ছে তাদের উত্তাপ বৃদ্ধি করার মধ্যে একটা শয়তানি-আনন্দ আছে।

লন্ডনে ছেলে-বৌমার বাড়ি আসার পর মিউজিয়াম, বাগান, প্রাসাদ ইত্যাদি দেখার পর ঠিক হল, ওদের যখন সাতদিনের ছুটি আছেই তখন সেই সুযোগে আমরা চারজন উত্তর আয়ারল্যান্ড ঘুরে আসি। ছেলে-বৌমার সঙ্গে সস্ত্রীক আমি।

উত্তর আয়ারল্যান্ডে আমাদের প্রথম গন্তব্য বেলফাস্ট। কিন্তু যাবার পথে বর্নভিলে ক্যাডবেরি ওয়ার্ল্ড দেখে যাওয়ার ইচ্ছে দমন করা গেল না। যখন ছোট ছিলাম তখন সব চকোলেটকেই ক্যাডবেরি বলে জানতাম। তবে এটা জানা ছিল না যে, ক্যাডবেরি চকোলেট ইংল্যান্ডে তৈরি হয়। বর্নভিল ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের কাছের একটা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম, যেখানে বিখ্যাত ক্যাডবেরি চকোলেট কোম্পানির প্রধান কারখানা। আমাদের কলিনডেলের বাসা থেকে বর্নভিল ঘণ্টা দুয়েকের পথ।

বর্নভিল গ্রামটা এমনিতে বেশ সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ। এদেশে পথে-ঘাটে গাড়ির হর্ন বা মানুষের চ্যাঁচামেচি থাকে না। গ্রামটা ক্যাডবেরি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ক্যাডবেরি তাঁর কর্মচারীদের থাকবার জন্য গড়েছিলেন। এখানকার চারপাশটা গাছপালা, পার্ক আর ঐতিহাসিক বাড়ি নিয়ে ভারী সুন্দর।

বর্নভিলে ক্যাডবেরি ওয়ার্ল্ডের জন্য বাচ্চাদের খুব ভিড় হয়। আগে থেকে টিকিট কেটে রাখা দরকার। শুরুতে একটা এগজিবিশন ছিল যেখানে চকোলেট তৈরির ইতিহাস নানাভাবে দেখানো হয়। এখানকার উপস্থাপনা এত সুন্দর যে, দেখতে ও শিখতে ভালো লাগে। সঙ্গে ক‍্যাডবেরি কোম্পানির ইতিহাস আর বিবর্তনের প্রদর্শনী কম চিত্তাকর্ষক নয়। হাতে-কলমে চকোলেট তৈরি করা শেখানো হল, পছন্দমতো চকোলেট চাখতে পেলাম আর কিছু চকোলেট কেনাও হল।

নানা রকম ফ্লেভারের চকোলেট চেখে দেখার মজাই আলাদা। বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন মজার খেলা ছিল, আর ছিল থিম পার্কের মতো মজার রাইড। এসব করতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল, তাই রাতটা স্ট্রানরারে থাকা ঠিক হল।

স্ট্রানরার স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে লক রায়ানের তীরে, ডামফ্রিস আর গ্যালোওয়ে অঞ্চলের একটা ছোট শহর। স্ট্রানরার থেকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং লার্নে অবধি ফেরি চলে। স্কটল্যান্ডে লক মানে তালা নয়, হ্রদ।

এখানে অনলাইনে এক-দু’রাতের জন্য পুরো সাজানো ফ্ল্যাট বুক করা যায়। ফ্ল্যাটে জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সঙ্গে চা-কফি-সস-তেল-ময়দাও থাকে। চাইলে নিজের খাওয়া বানিয়ে নেওয়া যায় সেই ফ্ল্যাটে।

ইউকে ভিসাতে শুধু নর্থ কেন পুরো আয়ারল্যান্ডেই ঘোরা যায়, তবে এ যাত্রায় আমরা নর্থেই ঘুরেছি। তার একটা আজব কারণ হল, আমার ছেলে-বৌমা যেহেতু ইউকে-তে ডাক্তারি করে তাই তারা হুটহাট করে আয়ারল‍্যান্ডে ঢুকতে পারবে না। আলাদা ভিসা চাই। গাড়িতে গেলে ফেরি ছাড়া গতি নেই। স্ট্রানরার থেকে বেলফাস্ট বত্রিশ মাইল ফেরিতে যেতে হয়। ফেরি বলতে একটা আস্ত জাহাজ। গাড়িখানা চালিয়ে এনে জাহাজের ডেকে পার্ক করে আমরা ওপরে সাজানো লাউঞ্জে এসে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্রযাত্রার উপরি আনন্দ উপভোগ করলাম। জাহাজে অনেক আয়োজন। ডিউটি ফ্রি দোকানে গেলে পকেট হালকা হওয়ার ভয়, তার চেয়ে মিনি থিয়েটারে মিনি মাগনা মুভি দেখে কিছুটা সময় কাটানো ভালো। রেস্তোরাঁয় বেশ ভিড় এবং দামও গলাকাটা নয়। তাই ওখানে বসে লাঞ্চ সেরে নেওয়া গেল। অসুবিধে হল বাইরে বেরিয়ে কায়দা করে ছবি তুলতে গিয়ে। মোবাইলে দেখে এসেছি লন্ডন আর বেলফাস্টের তাপমাত্রায় কোনও তফাত নেই। কিন্তু ডেকের ওপর কী প্রবল হাওয়া আর শীত যে ছবি তোলা মাথায় উঠল। রিল বানাতে গেলে ‘চন্দ্রবিন্দু’ হতে হবে। তখন দাঁত ঠকঠক করতে করতে জানলাম, জাহাজের ওপর সমীকরণটাই আলাদা এবং এখানে রিয়েল ফিল অন্তত তিন ডিগ্রি কম।

এরপর লাউঞ্জ থেকে বের হইনি। যেতে মোট দু’ঘণ্টা লাগল। জাহাজের খোল থেকে গাড়িতে চেপে উত্তর আয়ারল্যান্ডে নেমে আমাদের প্রকৃত যাত্রা শুরু হল।

আঁতুড়ে টাইটানিক শুনলে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কিছু মনে আসে না। যেন জন্মলগ্ন থেকেই বলি প্রদত্ত। ইউকে-তে দেখার জায়গার তো অভাব নেই। মিউজিয়াম, প্রাসাদ, পাহাড়, হ্রদ এমনকি মিউজিক্যালস। তবু বেলফাস্টে আসা টাইটানিকের টানে।

২০১৬ সালে বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল অ্যাওয়ার্ডসের অনুষ্ঠানে টাইটানিক বেলফাস্টকে বিশ্বের সেরা পর্যটন আকর্ষণের শিরোপা দিয়েছিল। টাইটানিক স্লিপওয়েজ, হারল্যান্ড এবং উল্ফ ড্রয়িং অফিস আর হ্যামিল্টন গ্রেভিং ডকের পাশেই এই বেলফাস্ট টাইটানিক। এখানেই টাইটানিক ডিজাইন, তৈরি আর ৩১ মে ১৯১১ সালে লঞ্চ করা হয়েছিল।

টাইটানিক বেলফাস্ট এমন একটি মিউজিয়াম যেখানে টাইটানিকের আঁতুড়ে দাঁড়িয়ে টাইটানিকের গল্প শোনা যায়। পাতায় পাতায় বেলফাস্টে ১৯০০ সালের শুরুর দিকে এর কল্পনা থেকে শুরু করে এর নির্মাণ, লঞ্চ এবং যাত্রা শুরুর দিনের সবকিছু লেখা আছে। আমরা সেই গল্পের আবেশে এগিয়ে চললাম।

টাইটানিক এক্সপেরিয়েন্সে মোট ন’টা ইন্টারপ্রেটিভ আর ইন্টারঅ্যাক্টিভ গ্যালারি রয়েছে, যেখানে টাইটানিকের দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ আর গল্পগুলোর সঙ্গে পরিচয় হলাম। সেই সঙ্গে এই শহর এবং মানুষদের গল্প শোনা গেল, যাঁরা এই জাহাজটা  তৈরি করেছিলেন।

মিউজিয়ামের ভিতরে ঢোকার পর ঘড়ির কাঁটা যেন পেছনে ফিরে গেল। কীভাবে টাইটানিক তৈরি হয়েছিল ধাপে ধাপে চোখের সামনে ফুটে উঠল। সামনে হারল্যান্ড এবং উল্ফ গেট। গেট পেরিয়ে শিপইয়ার্ডের দিকে রওনা হয়ে ডার্ক রাইডে উঠলাম।

ডার্ক রাইড, আমার কাছে টাইটানিক বেলফাস্ট মিউজিয়ামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা।

এ এক ইন্ডোর রাইড, যেখানে আমরা একটা ঝুলন্ত কেবিনে বসে বেলফাস্টের শিপইয়ার্ডের অভিজ্ঞতা পেলাম। ভয়ের কিছু নেই, কেবিনগুলো রোলার-কোস্টারের মতো ধীরে চলে। অবাক হয়ে দেখলাম কীভাবে হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফ শিপইয়ার্ডে টাইটানিক তৈরি হচ্ছিল। আলো, শব্দ, ভিডিও প্রোজেকশন, অ্যানিমেশন আর বাস্তবসম্মত সেট মিলে সেই সময়ের শ্রমিকদের কাজের পরিবেশকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। আমরা তখন গরম ধাতু, ইঞ্জিনের শব্দ আর ভারী যন্ত্রপাতির শব্দের জগতে ঢুকে গিয়েছি। স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি তাদের কথাবার্তা। রাইড হয়তো প্রায় চার মিনিটের মতো হবে, কিন্তু অভিজ্ঞতা সামান‍্য নয়। ওপর থেকে আমরা টাইটানিক এবং অলিম্পিক যে স্লিপওয়েজে ছিল তার একটা প্যানোরামিক ভিউ দেখে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।

টাইটানিক এবং তার সহোদরা জাহাজ অলিম্পিক দুটিই এই হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফ শিপইয়ার্ডে দুটো বিরাট স্লিপওয়েজে তৈরি হয়েছিল। স্লিপওয়েজ হল জাহাজ তৈরির জন্য ঢালু কংক্রিটের এক বিশাল মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে তৈরি জাহাজ প্রথমবারের মতো জলে ভাসানো হয়।

টাইটানিক ও অলিম্পিকের স্লিপওয়েজ দুটো বিশেষ করে পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছিল। একটাতে অলিম্পিক, অন্যটাতে টাইটানিক। সেই সময়ে এই স্লিপওয়েজই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্লিপওয়েজ, যেখানে সেই বিশাল সমুদ্রজাহাজ দুটো তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। স্লিপওয়েজের চারপাশে বিশাল গ্যান্ট্রি ক্রেন বসানো হয়েছিল, যার নকশা বানিয়েছিলেন স্যর উইলিয়াম আরল্ড। এই ক্রেন দিয়ে জাহাজের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত সব যন্ত্রাংশ তোলার কাজ করা হত। টাইটানিককে এখান থেকেই জলে নামানো হয়েছিল।

১৯১১ সালে শুরুর দিনের নানান ছোট-বড় স্মৃতিচিহ্ন এমন মুনশিয়ানায় সাজানো হয়েছে যে গায়ে কাঁটা দেয়। এরপর নানান ছোট ছোট প্রদর্শনী, মডেল, ইন্টারঅ্যাক্টিভ ডেটাবেস এবং কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারির মাধ্যমে জাহাজের নানান পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যেমন অভিজাত মহল্লা এবং কেবিন, ডাইনিং এরিয়া আছে তেমন ইঞ্জিন রুম, কাজের জায়গায়ও আছে। কোনও এক জাদুমন্ত্রে আমরা সেখানে ঢুকে পড়লাম। মহাসাগরের শব্দ শুনতে পাওয়ার সঙ্গে ইঞ্জিনের কম্পনও অনুভব করতে পারলাম।

পরের অংশটা বড় বেদনাদায়ক। এই বিশাল জাহাজের প্রথম যাত্রায় দেড় হাজার পুরুষ, নারী এবং শিশুর মৃত্যুকে শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়ালাম। এখানে সেই সময়ের তদন্ত ও সংবাদ রিপোর্টগুলি সব রাখা আছে। পুরো অভিজ্ঞতা শেষ হয় বর্তমানে এসে, যেখানে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার আর জলের নীচে যে খোঁজ চলেছে তার কাহিনী খুব বিস্তারিত ভাবে রয়েছে।

সারা শহর নানাভাবে টাইটানিককে মনে রেখেছে। মনে রেখেছে ১০ এপ্রিল ১৯১২ সালে তার প্রথম ও শেষ যাত্রার কাহিনী।

বেলফাস্ট সিটি হলের ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে টাইটানিক মেমোরিয়াল গার্ডেন, যেখানে টাইটানিকের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া ১,৫১২ জন মানুষের স্মৃতি অমলিন। দুই স্তরে তৈরি এই বাগানের উপরের অংশে ন’মিটার লম্বা পাথরের ফলক, যেখানে ব্রোঞ্জের পনেরোটি প্ল্যাকে মৃতদের নাম অক্ষরক্রমে খোদাই করা। হয়তো ইতিহাসে প্রথম একসঙ্গে সবার নাম, যাত্রী, নাবিক, কর্মচারী, সংগীতশিল্পী। যা আজ ‘বেলফাস্ট লিস্ট’ নামে পরিচিত।

বাগানের চারপাশে সাদা, রুেপালি, নীল ও সবুজ মেশানো গাছপালা, যেন সেই জল আর বরফের রঙে নেমে আসা এক নীরব শান্তি। বসন্তে ম্যাগনোলিয়া, তারার মতো ফুল, সাদা গোলাপ বা স্মৃতির প্রতীক রোজমেরি এই বাগানের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

হেমন্তের আলোছায়ায় তৈরি হল রঙিন ছবি

সন্দীপন নন্দী এই সেই অবিস্মরণীয় হেমন্ত, যার মধ্যদুপুর রৌদ্রতেজে ম্রিয়মাণ,...

স্মৃতিহারা জীবন ও রাজনীতির ভুল

রূপায়ণ ভট্টাচার্য একটা হাত দিয়ে প্রবীণা ভদ্রমহিলার হাঁটু ধরে রয়েছেন...

‘বন্দে মাতরম’–এর আজ ১৫০ বছর পূর্তি

স্বপনকুমার মণ্ডল সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ‘মন কি বাত’...

আদর্শ, মুখ ও বাম রাজনীতির নতুন পাঠ

কুশল হেমব্রম নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক জয়...