- বিমল দেবনাথ
এখন কারও হয়তো আর মনে নেই কেরলের সেই গর্ভবতী হাতিটার কথা, যাকে আনারসের সঙ্গে বোমা খাইয়ে দিয়েছিল মানুষ। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা গিয়েছে সে। হয়তো সবাই ভুলে গিয়েছে ঝাড়গ্রামের সেই হাতিটাকে, যার পিঠে জ্বলন্ত লোহার শলাকা গেঁথে দিয়েছিল কেউ। তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা গিয়েছে সেও।
আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি পোড়া, জখম, পোকা লাগা কুকুর, গোরু ইত্যাদি পশুদের রাস্তায় দেখতে। পশুদের কথা মনে হলে এখনও মনে পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “মহেশ” গল্প। বুভুক্ষু, তৃষ্ণার্ত মানুষ কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার জীবন্ত চিত্র। সময় বদলালেও চিত্র বদলায়নি একটুকুও। স্বামীজির বাণী শোষণের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে সবার বিবেক ছুঁতে পারেনি এখনও। জীবে প্রেম এখনও দেখা যায় না সর্বত্র। মানুষ এখনও রাস্তায় ছেড়ে দেয় অসুস্থ, বয়স্ক, দামি প্রজাতির অসহায় পালিত কুকুর। ঘুরে বেড়ায় দুধেল গাই, ধর্মের ষাঁড়।
রাস্তায় এইসব পশু কেন আসে মানুষ ভাবে না। হইচই শুরু হয় গুঁতো খেয়ে হাসপাতালে গেলে। আসলে লড়াইটা স্পেসের, রাস্তার। দমবন্ধ হওয়া ছোট-বড় শহরে পালিত পশুর সঙ্গে থাকে বন্যপ্রাণীও- যেমন সাপ, নেউল, ভাম ইত্যাদি। কখনও বনের হাতি, চিতাবাঘ, গাউর। বাঁচার জন্য লড়াইয়ে মানুষও পশু হয়ে ওঠে। যদিও এই লড়াই কাম্য নয় মোটেও। বাঁচার জন্য একটুকু ‘স্পেস’ পেলে বেঁচে যেত প্রাণীগুলো। এবারের পশু কল্যাণ পক্ষের প্রাক্কালে কথাগুলো মনে আসছে বারবার।
দেখলাম তোড়জোড় করে রাজপথের ফুটপাথ দখলমুক্ত করা হল। পরের দিন সেই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মনে হল সমুদ্রতটের মতো মুক্ত বাতাস প্রাণ ছুঁয়ে গেল। ভাবলাম ভোটটা তাহলে জলে যায়নি। কিন্তু আজ ট্রাফিক পয়েন্টে যেতেই মনের ফুরফুরে ভাব ফুস হয়ে গেল। পুলিশের সামনেই আবার চার-পাঁচজন আনাজপাতি, দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে বসে পড়েছে। আবার দখলদারি শুরু। প্রথম অবস্থায় এই ছোট ছোট দখলদারি বন্ধ করে না দিলে অচল পাহাড়ের মতো বড় হয়ে উঠবে আবার। জড়িয়ে যাবে মানবতা ও জীবন জীবিকার প্রশ্ন। এভাবেই পশুর চারণভূমি, নদীর প্লাবনভূমি, ব্রিজের তলা ও নানা সরকারি জমি দখল হয়, সেখানে ঘরবাড়ি, স্কুল, রিসর্ট, পার্টি অফিস, ক্লাব ইত্যাদি গড়ে ওঠে। রাস্তায় হাতি, ষাঁড়, দুধেল গোরু ইত্যাদি চলে আসে। দমবন্ধ হয়ে আসা শহরের রাস্তা আর কত কী টানবে? ফলত মানুষ গুঁতো খায়, গোরুদেরও হাত-পা ভাঙে, পোকা লাগে, পচন ধরে গন্ধ ছড়ায়। মারা যায় অসহায় নিরীহ পশু। কখন মানুষও।
যে কোনও নবাগত মানুষ চারাগাছের মতো। রোপণের সময় চারা সঠিক জায়গায় সঠিক মাটিতে পোঁতা হলে গাছটা সমস্যার না হয়ে উপকারী হয়। নতুন মানুষের বসতি সঠিক জায়গায় বসালে শহর বাড়ত আয়তনে বা উচ্চতায়। নতুন বসতির মধ্যেও থাকে কায়েমি স্বার্থ এবং ভোট অঙ্ক। যাক সেকথা, ফিরে আসি পশুদের কথায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে পশু গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মে, কর্মে গোরুও। যন্ত্রের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয়তা কমলেও গুরুত্ব কমেনি একটুকুও। সনাতনীরা গোরুকে মাতা-পিতা ভাবেন। ঐশ্বরিক গো-দেবী কামধেনু দেবতাদের দুধ পান করান। দেবাদিদেব শিবের বাহন নন্দী কিন্তু ষাঁড়।
জন্মের পরে শিশুর প্রথম পেয় মায়ের দুধ হলেও যাপনে সুষম খাদ্য হল গাইয়ের দুধ। সনাতনীদের সঙ্গে অনেকেই গাইগোরুকে মাতা ভাবেন। অনেকে আবার ষাঁড়কে বলদ না করে নানা পুণ্য প্রাপ্তির জন্য ছেড়ে দেয়। সে বড় হয়ে ধর্মের ষাঁড় হয়ে ওঠে। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। রোড জ্যাম হয়, গুঁতো খাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। শুধু ষাঁড় কেন সব দেবতার বাহনরা কোনও পশু বা পাখি। কিন্তু মানুষের চলার রাস্তায় সেইসব বাহন যেমন ষাঁড়, দুধেল গাই, সাপ, হাতি ইত্যাদি আসবে কেন?
শুধু রাস্তা নয়, বাজারেও আপনি নিশ্চিন্ত নন। কখন গুঁতো মারবে জানতে পারবেন না। আনাজ নিয়ে বাড়ি নয় হাসপাতালে পৌঁছে যাবেন। এক দোকানি অক্ষর অযোগ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলছিল – …বাচ্চা, দুধ খাবে অন্য কেউ আনাজ খাবে আমার। সত্যি তো। এখানেও প্রশাসনের প্রহসন। গাইটাকে আটকে রাখলেই তো সাপ সুড়সুড় করে গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু আটকে রাখবে কোথায়? শহর কেন, গ্রামেও এখন খোঁয়াড় দেখা দুষ্কর। গোড়ায় গলদ যে।
জমি জরিপের পুরোনো ম্যাপ দেখলে দেখা যায় যে প্রায় প্রত্যেক মৌজায় মোটা দাগে দুই ধরনের জমি চিহ্নিত করা ছিল। রায়তি ও সরকারি। সরকারি জমির মধ্যে আছে বন, রেল, রাস্তা, চারণভূমি, খোঁয়াড়, নদী, শ্মশান, কবর, পয়স্তি ইত্যাদি। মানুষ ডাল, রুটির মতো এগুলো প্রায় সব খেয়ে ফেলেছে। মানুষের কি সরকারি জমি হজম করার শক্তি আছে? উত্তর না। হজম শক্তি পায় প্রভাবশালীর কাছে। প্রভাবশালীর দৌলতেই যে চারাগাছ সুমিষ্ট ফলদায়ী বৃক্ষ হয়ে ওঠার কথা ছিল সে হয়ে ওঠে বিষবৃক্ষ। শহর আয়তনে বা উচ্চতায় বড় না হয়ে, বড় হয়ে ওঠে ঘাড়ের ওপরে। রাস্তাহীন, ছাদহীন হাতি, ষাঁড়, গাই ইত্যাদি চলে আসে সাধারণ মানুষের রাস্তায়। সব মানুষ পশুর কথা ভাবে না। যেভাবে পালিত পশুকে রাস্তায় ছেড়ে দেয় তাতে মনে হয় না দেশে প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমাল অ্যাক্ট ১৯৬০ বলে একটা আইন আছে। এমন অবস্থা চললে হয়তো দেবতারা একদিন আবাস ছেড়ে রাজপথে মিছিলে নামবেন তাঁদের বাহনের জন্য।
প্রতি বছর দেশে ১৪ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত পশু কল্যাণ পক্ষ পালন করা হয়। এবারও হবে। উদ্দেশ্য পশুদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করা এবং তাদের কল্যাণের জন্য জনমত গঠন করা। পশুদের কল্যাণে, কল্যাণ হবে রাজ্যের অর্ধেকের বেশি মানুষের। অর্ধেকের বেশি মানুষ যে এখনও নির্ভরশীল কৃষি ও পশুপালনে।
ভারতীয় উপমহাদেশে পশুদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে সম্রাট অশোকের আমল থেকে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে পশুদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। বনের পশু প্রাণবায়ু ধরে রাখতে কাজ করে। পালিত পশু এখনও অনেক মানুষের পকেটের টাকার মতো। পশুকে সঠিক বাসস্থান ও চারণভূমির জোগান দেওয়া মানুষের দায়িত্ব। পশুদের ওপরে অত্যাচারে কোনও মহত্ত্ব নেই। তবুও নিপীড়ন ঘটে। পশু নির্যাতন বন্ধ হতে পারে মানুষ তার মনের ভিতরের পশুকে বলি দিতে সক্ষম হলে এবং পশুর চারণভূমি, খোঁয়াড় ও রাস্তাগুলো ফিরিয়ে দিলে।
একটা পর্যবেক্ষণে মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন- “the greatness of a nation and its moral progress can be judged by the way its animal are treated”। কিন্তু যেভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির বিতর্কের মধ্যে মদ বিক্রির রেকর্ড হচ্ছে, ভয় হয় মেধা না হারিয়ে যায় মাতালের কাছে। তাহলে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না। তাই সাধু সাবধান! এবারের পশু কল্যাণ পক্ষে বোল উঠুক- পশু কল্যাণে মনের পশুকে মার। এতে কল্যাণ হবে পশু, মানুষ দু’পক্ষের।
(লেখক প্রাক্তন বনকর্তা। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)