বাংলার মেডিকেল কলেজগুলিতে নরক গুলজার হয়েছে এতদিন। স্বেচ্ছাচারের চূড়ান্ত নজির একে একে বেরিয়ে আসছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের সর্বশেষ ঘটনাটি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরম অরাজকতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। চিকিৎসক-পড়ুয়ারা কলেজের অধ্যক্ষের মুখের ওপর দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্যের নানা উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তাতে পরীক্ষায় দুর্নীতির সমস্ত প্রমাণ বেআব্রু হয়েছে। একশ্রেণির প্রভাবশালী চিকিৎসক, এমনকি পড়ুয়া চিকিৎসকের কলেজ পরিচালনায় বেআইনি হস্তক্ষেপ সামনে চলে এসেছে।
মেডিকেল কলেজগুলি হয়ে উঠেছে ত্রাসের রাজত্ব। বেআইনি কাজে বাধা দিলে, প্রভাবশালীদের ইচ্ছায় সায় না দিলে চরম হয়রানির বিভিন্ন নজির প্রকাশ্যে চলে এল। এমনকি সিনিয়ার চিকিৎসকরাও যে এই চক্রের স্বেচ্ছাচার থেকে রেহাই পেতেন না, তা উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে তাঁরা নিজেরা তুলে ধরলেন। অধ্যক্ষকে জুনিয়ার ডাক্তাররা ঘেরাও করে রাখাকালীন সিনিয়ার চিকিৎসকরা যেভাবে তাঁদের ওপর হুমকির কথা তুলে ধরলেন, তা এককথায় ভয়াবহ।
‘থ্রেট কালচার’ বা হুমকি-সংস্কৃতি শব্দবন্ধনীটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকদিন ধরে প্রচলিত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের অগাস্টে এক ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুর পর সেই হুমকি সংস্কৃতির রোমহর্ষক বিবরণ জানা গিয়েছিল। যদিও তা সীমাবদ্ধ ছিল ছাত্রাবাসের মধ্যে। কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে গোটা চিকিৎসা কাঠামোর মধ্যে হুমকি-সংস্কৃতির ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়েছে। যার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ মেডিকেল কলেজের সদ্য অপসারিত সুপারিন্টেডেন্ট রাজীব প্রসাদের বিরুদ্ধে খোদ অধ্যক্ষের নালিশ স্বাস্থ্য ভবনে পাত্তা না পাওয়া সেই শিকড়ের পরিচয় বুঝিয়ে দেয়।
মাত্র জনাকয়েক গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। সুশান্ত রায়, সন্দীপ ঘোষ, দেবাশিস সোম, রাজীব প্রসাদ, রণজিৎ মণ্ডলের মতো সিনিয়ার চিকিৎসকের পাশাপাশি ছড়ি ঘোরানোর এই চক্রে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন অভীক দে, বিরূপাক্ষ বিশ্বাস প্রমুখ চিকিৎসক পড়ুয়া। পিছনে বড় মদত না থাকলে ক্ষমতার মধুচক্র এভাবে বিনা বাধায় এতদিন সক্রিয় থাকতে পারত না।
সিনিয়ার চিকিৎসকরা এখন সরব হওয়ায় ওই চক্রে উত্তরবঙ্গ মেডিকেলের খোদ ডিন সন্দীপ সেনগুপ্তের প্রভাব খোলসা হল। প্রমাণ হল, কলেজের অধ্যক্ষ ইন্দ্রজিৎ সাহাও ধোয়া তুলসীপাতা নন।
আরজি কর মেডিকেল কলেজের তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এখন স্পষ্ট হচ্ছে, প্রভাবশালীদের কুকর্মের প্রতিবাদ কিংবা নিছক প্রশ্ন করলে উত্তরবঙ্গ মেডিকেলের মহিলা জুনিয়ার ডাক্তাররা ধর্ষণের হুমকি শুনেছেন। ভয়াবহ ও অরাজক পরিস্থিতি বললেও কম বলা হয়। অধ্যক্ষের কাছে এসবের নালিশ জানিয়ে কোনও প্রতিকার হয়নি। যেমন রাজীব প্রসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে মূক ও বধির থেকেছে স্বাস্থ্য ভবন।
উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান গৌতম দেব এখন মানছেন, জুনিয়ার ডাক্তারদের অভিযোগের সারবত্তা আছে। যদিও রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ও রাজ্যের শাসকদলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে উত্তরবঙ্গ মেডিকেলের এই নৈরাজ্যে তাঁর দায়ও কম নয়। বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে মেডিকেলের নানা কেচ্ছা প্রকাশিত হলেও তাঁকে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। যেমন মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ মেডিকেলের ক্ষমতাচক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেননি সেখানকার রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম রায়।
টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে ডাক্তার তৈরির জঘন্য অপরাধের অভিযোগ এই চক্রের বিরুদ্ধে। অভীক বা বিরূপাক্ষকে কিংবা আরজি করের ডাক্তার অরুণাভকে বদলির সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য প্রশাসনের ফোঁপরা চেহারাটাকে নিছক ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। আগাপাশতলা সমাধানের কোনও উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়।