অরুণ ঝা, চোপড়া: ‘অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’
রবি ঠাকুরের লেখা এই পংক্তি ট্যাব কেলেঙ্কারির (Tab Scam) হটস্পট চোপড়ায় (Chopra) বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সপ্তাহখানেক একেবারে মেঠো পথ চষে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, চোপড়ার সাইবার প্রতারকদের এই কীর্তিকলাপ মোটামুটি জানা ছিল স্থানীয় সব নেতারই। কিন্তু সময় থাকতে কেউই ঘাঁটানোর সাহস দেখাননি। ফলে দুর্নীতিচক্রে তৃণমূলের প্রচ্ছন্ন মদতের অভিযোগ কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তৃণমূলের এক নেতা মাঝিয়ালি অঞ্চলের একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে গেলেও তো সমস্যা। আমি কী উপায়ে কী কাজ করছি, আপনি বলার কে?- এই প্রশ্নের তো উত্তর নেই। ফলে অনেক কিছু জেনেও না জানার ভান করে থাকতে হচ্ছে।’
চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমান অবশ্য দাবি করছেন, ‘দলের কেউ এসবে যুক্ত নয়। পুলিশ প্রশাসন স্বতন্ত্রভাবে ধরপাকড় করছে। যারা দোষী তাদের সাজা পেতেই হবে।’
ট্যাব দুর্নীতি কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত চোপড়া ও ইসলামপুর মিলিয়ে মোট ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে, যার মধ্যে ১২ জনই চোপড়ার।ইসলামপুর থানার সামনে থেকে নতুন করে ধরা পড়েছে জুলফিকার আলি। জুলফিকার ইসলামপুর থানার অমলঝাড়ির বাসিন্দা। বুধবার জুলফিকার এবং চোপড়া থেকে ধৃত উমর ফারুককে আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক তাদের দুইদিনের ট্রানজিট রিমান্ড দিয়েছেন।
উমরকে ঝাড়গ্রাম ও জুলফিকারকে হাওড়া কমিশনারেটের সাইবার শাখা গ্রেপ্তার করেছে। কেলেঙ্কারির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মনসুরের এজেন্ট হিসেবে জুলফিকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করত বলে জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী।
সাইবার প্রতারণার আঁতুড় চোপড়া নিয়ে শাসক শিবিরের উদাসীনতা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মুখে। মাঝিয়ালি অঞ্চলের প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর দোকানে বসে কথা হচ্ছিল। গ্রাহকদের আনাগোনা সেই সময় কম। ওই ব্যবসায়ী নিজেও তৃণমূলের কট্টর সমর্থক। তাঁর প্রশ্ন, ‘স্কলারশিপ, আধার জালিয়াতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট চুরির মতো ঘটনার পরও দলীয় নেতারা সতর্ক হননি কেন? পুলিশ প্রশাসনকে না জানিয়েও তো ছেলেগুলিকে শাসন করা যেত। তাই না?’
ট্যাব কাণ্ডে ধৃত প্রাথমিক শিক্ষক দিবাকর দাস তৃণমূলের প্রাক্তন প্রধানের ছেলে। ফলে শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে তার ওঠাবসাও ছিল চোখে পড়ার মতো। ট্যাব কাণ্ডের এপিসেন্টার চোপড়ার ঘিরনিগাঁও অঞ্চল। চোপড়া পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ফজলুল হকের এলাকা। ফজলুলকে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফ জবাব, ‘আমি কোনও মন্তব্য করব না।’
এই ঘিরনিগাঁও অঞ্চলেই তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনারা সব জেনেও নীরব থেকে গেলেন কেন? তাঁর যুক্তি, ‘সকলেই সবকিছু জানে, অস্বীকার করব না। কিন্তু বলতে গেলেই ঝামেলা। তাই আমরা এসব এড়িয়ে চলি।’
চোপড়ায় ঘাসফুল শিবিরের শিক্ষা সেলের সঙ্গে মাখোমাখো সম্পর্ক থাকা একাধিক ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে এলাকায় চর্চা চলছে। কয়েক বছর আগে তামিলনাডুর পুলিশ সাইবার প্রতারণায় একটি হাইস্কুলের অশিক্ষক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল। বর্তমানে শিক্ষা সেলের উপর সেই ব্যক্তির প্রভাব চোখে পড়ার মতো। এরই মাঝে চোপড়ার একটি হাইস্কুলের টিচার ইনচার্জ (টিআইসি) গত ১৮ নভেম্বর থেকে ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ায় ফাঁপরে পড়তে হয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাদের। স্কুল সূত্রেই জানা গিয়েছে, নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশনের সংশোধনের কাজ অনলাইনে থমকে ছিল। কারণ ওই টিআইসির কাছেই ওটিপি ও পাসওয়ার্ড যাওয়ার কথা। ওই শিক্ষক এই দুর্নীতিচক্রে জড়িত থাকতে পারেন বলেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে। আচমকা তিনি কোথায় গেলেন তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে জেলা শিক্ষা দপ্তর।
অনেকেই বলেছেন, স্থানীয় নেতৃত্ব কড়া অবস্থান নিলে টাকার লোভে অ্যাকাউন্ট ভাড়া দিয়ে গরিব মানুষকে গ্রেপ্তার হতে হত না। তৃণমূলের চোপড়া ব্লক সভাপতি প্রীতিরঞ্জন ঘোষের কথায়, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। যাঁরা জানতেন, তাঁদের উচিত ছিল দলমতনির্বিশেষে ব্যবস্থা নেওয়া। তাতে অনেক মানুষকে প্রতারকদের খপ্পর থেকে রেহাই দেওয়া যেত।’
এখানেই তৃণমূলকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না বিজেপি। দলের উত্তর দিনাজপুর জেলার সহ সভাপতি সুরজিৎ সেন বলছেন, ‘ট্যাব কেলেঙ্কারিতে চোপড়ায় শাসকদলের ভূমিকা অবশ্যই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। শুধু ট্যাব নয়, সরকারি একাধিক প্রকল্পের টাকা সাইবার প্রতারকরা হাতিয়েছে। তাই এটা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দাবি করছি।’ (শেষ)