শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

স্বপ্নের ঘাসফুল ও স্বপ্নের অপমৃত্যু

শেষ আপডেট:

 

  • পরিমল দে

প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে নীরদ সি চৌধুরী ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ এবং ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ নামে দুটি বই লিখেছিলেন। আজ কোনও বাঙালি লেখক ‘স্বপ্নের ঘাসফুল ও আত্মঘাতী তৃণমূল’ শিরোনামে বই লিখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এবং তাঁর দল নিরবচ্ছিন্নভাবে এমন বইয়ের বিষয়বস্তুর চালচিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। স্বাধীনতার পর এ রকম আত্মঘাতী সরকার ও দল পশ্চিমবাংলায় কখনও দেখা যায়নি।

অথচ বাংলাকে মমতা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বাংলাও একসময় মমতাকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন দেখেছিল। বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’র ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রমাণ করেছিলেন, ‘মানুষই ডিনামাইট। মানুষই চার্জার। মানুষই বড় পাহাড় গুঁড়িয়ে দেয়’। ২০১১ সালের ২১ মে শুধু রাজনৈতিক দল বা ঘাসফুলের পতাকা নয়, এক মানব-সমুদ্র মমতাকে রাজভবন থেকে রাইটার্স পৌঁছে দিয়েছিল। স্লোগান নয়, সেই মানব সমুদ্রের কণ্ঠে ছিল রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান। মমতা চলেছেন, সঙ্গে চলেছিল সমগ্র বাংলা।

মমতার কথায় বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে হরিহর-সর্বজয়া-অপু-দুর্গার কথা। কালীঘাটের টালির চালের কুটিরের সিঁড়িতে বসে আছেন মা গায়ত্রী দেবী। পাশে একটি পা ঈষৎ বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রক পরা এক কিশোরী। কুটিরের দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। হাঁ করে বেরিয়ে আছে নোনাধরা প্রাচীন ইট। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের এক প্রবহমান চিত্ররূপ মুহূর্তের মধ্যে আমাদের বিহ্বল করেছিল তখন।

স্নেহশীলা গায়ত্রী দেবী হয়তো কল্পনা করেননি মমতা একদিন গায়ে সাদা শাড়ি আর পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ করবেন। কলেজ জীবন থেকে কত অপমান-নির্যাতন, কত মার তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু অটল অবিচল প্রাণময় শক্তিকে কোনওকিছুই দমাতে পারেনি। বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিপর্যয়কে সামলাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন মমতা। বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনকে গণদেবতার আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন। মিছিলের সেই মমতা আজও অপ্রতিরোধ্য। একবার সিদ্ধার্থশংকর রায় বলেছিলেন, ‘বিধানচন্দ্র রায়কে মনে রেখে বলছি, স্বাধীনতার পর বাংলায় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে মমতার মতো জনপ্রিয়তা কেউ পাননি। আমিও নই’।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি শান্তিনিকেতনে সমাবর্তনে এসে নৈশাহারে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছিলেন। একজন ছাত্রী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, ‘বর্তমান সময়ে কে আমাদের আদর্শ হতে পারেন?’ রাজীব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘কেন মমতা? ওর মতো সৎ সাহসী পরিশ্রমী মেয়েই তো তোমাদের আদর্শ হওয়া উচিত’। রাজীব ও তাঁর মা সোনিয়া, দুজনেই জানতেন মমতা কংগ্রেসের সম্পদ!

সোমেন-মমতা দ্বন্দ্বে সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং অজিত পাঁজার অনুরোধে ১৯৯৭-এ সোনিয়া রাজ্য কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব মেটাতে হস্তক্ষেপ করেন। সোনিয়ার মনে পড়েছিল, রাজীব তাঁকে একবার বলেছিলেন, ‘হোয়েন মমতা ইজ ফাইটিং দেয়ার মাস্ট বি এ জেনুইন কজ’। মমতাকে কংগ্রেসে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সোনিয়া। শেষবার ১৯৯৭-এর ১৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে রাতপোশাক পরা অবস্থাতেই সোনিয়া তাঁর বেডরুমে মমতাকে ডেকে নিয়েছিলেন।

সোনিয়ার স্নেহভরা দুটি হাত তখন মমতার কাঁধে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এ এক বিরল দৃশ্য! তবু শেষরক্ষা হয়নি। অগ্নিকন্যার আগুন নেভেনি। ১৯৯৮-এর ৯ অগাস্ট কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সোনিয়া গান্ধি, সীতারাম কেশরী সহ সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব উপস্থিত। উপস্থিত মমতাবিরোধী সোমেন মিত্র। ওই ইন্ডোরের বাইরে তখন বিশাল সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নতুন দলের নাম ঘোষণা করলেন- ‘তৃণমূল কংগ্রেস’। প্রতীক ঘাসফুল।

এরপর মমতার দীর্ঘ যাত্রা রাজনীতিতে। কখনও কংগ্রেসের হাত ধরে, কখনও বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে। নিজের গুরুত্ব এতটাই তৈরি করেছিলেন যে, বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মমতার টালির চালের বাড়িতে তাঁর মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন। মমতা বাংলার সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সুবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচিত হয়। ‘ব্রিটানিকা’ তাঁর পরিচয় পর্বে ‘দিদি’ (বিগ সিস্টার) শব্দটি উল্লেখ করেছে। ‘দ্য টাইমস ম্যাগাজিন’ ২০১২ সালে বিশ্বের একশোজন প্রভাবশালীর মধ্যে বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে মমতার নাম উল্লেখ করেছিল। ‘ব্লুম বার্গ মার্কেট ম্যাগাজিন’ ২০১২-তে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশ্বের পঞ্চাশজন প্রভাবশালীর মধ্যে একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

২০১১-তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাধারণ মানুষের জন্য জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল সামাজিক প্রকল্প বাস্তবায়িত করেছেন বলে দাবি করেন। তাঁর স্বপ্নের কন্যাশ্রী ২০১৭-তে ইউনাইটেড নেশনস-এর ‘হাইয়েস্ট পাবলিক সার্ভিস ফর গার্লস’ সম্মানে ভূষিত হয়। ২০১৪-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘স্কচ অর্ডার অফ মেরিট ফর গুড গভরন্যান্স’ পায়। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসাথী-রূপশ্রী-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সমগ্র দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুয়ারে সরকার’ এক অভিনব প্রকল্প। ‘দুয়ারে সরকার’ ভারত সরকারের ‘প্ল্যাটিনাম অ্যাওয়ার্ডে’ সম্মানিত হয়েছে।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পর ইন্দিরা গান্ধিকে দেবী দুর্গা সম্বোধন করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তার চল্লিশ বছর পর ২০১১-তে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পত্রিকার প্রচ্ছদে মমতাকে দুর্গারূপে চিত্রিত করা হয়েছিল। প্রচ্ছদে লেখা ছিল, দুর্গতিনাশিনী দশভুজা দেবী দুর্গা।

২০১১-র মিছিলের সেই মমতা, মানুষের মমতা, ২০২৫-এ এসে কি সত্যিই আর মানুষের আছেন? নাকি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন? বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের অপশাসন, সন্ত্রাস, হিংসা, হত্যা ঐতিহাসিক রিগিং এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ২০১১-তে মানুষ মমতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মমতা বাংলা, বাঙালিকে ব্যথিত আশাহত এবং মর্মাহত ও প্রতারিত করেছেন। রাজ্যের শিক্ষা দুর্নীতি, বিশ্বব্যাপী আন্দোলিত অভয়া কাণ্ড এবং সাম্প্রতিক সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে গণধর্ষণ ইত্যাদি সেইসব আশাভঙ্গের জ্বলন্ত উদাহরণ।

বাংলার নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে মমতার শাসনে, যা জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলেরও অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এই মুহূর্তে ভারত উগ্র হিন্দুত্ব, গো-সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজন এবং ধর্মীয় রাজনীতিতে ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত। নাথুরাম গডসে এখন দেশপ্রেমিক। সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদের ফাঁদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পা মেলালেন। সরকারি অর্থ ব্যয়ে দিঘায় জগন্নাথধাম মন্দির নির্মাণ ও সরকারি অর্থে বাড়ি বাড়ি প্রসাদ বিতরণ করিয়েছেন, যা কোনএ সভ্য, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হতে পারে না।

এরপর কি আর ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যমণি হতে পারবেন মমতা? অথচ তিনিই ছিলেন ওই জোটের অন্যতম মুখ এবং এককালের স্ট্রিট ফাইটার। যিনি সততার রাজনীতির কথা বলতেন, তাঁর শাসনে অসততার হাজার উদাহরণ। স্বপ্নভঙ্গের নেত্রী এখন তিনি। যদিও স্বচ্ছ প্রশাসন যাঁর আমলে আশা করা আর যায় না। যাঁর সরকার বাংলায় নৈরাজ্যের স্রষ্টা। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।’ যে স্বপ্ন ছড়িয়ে ঘাসফুল ফুটেছিল বাংলায়, সেই স্বপ্ন আত্মহত্যা করেছে।

(লেখক গান্ধিবাদের গবেষক, প্রাবন্ধিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

প্রখর অন্তর্দৃষ্টিতেই নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত

দেবদত্তা বিশ্বাস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝড়ের গতিতে বয়ে চলা...

উন্নয়নের নামে মাঠ ধ্বংসের চক্রান্ত

সুমন গোস্বামী আলিপুরদুয়ার শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্যারেড গ্রাউন্ড এখন সংবাদ শিরোনামে।...

ছাপার অক্ষরের প্রতি ভালোবাসাটা ফিরছে

  সৌমিক চক্রবর্তী শুরুটা প্রযুক্তিকে দিয়েই করা যাক। একে অস্বীকার...

পরিকাঠামোয় প্রশ্ন সত্ত্বেও ঢালাও অনুমোদন

  দেবদূত ঘোষঠাকুর বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর...