মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

ঐতিহ্যবাহী তিস্তাবুড়ির গান চিরদিনের 

শেষ আপডেট:

মলয় চক্রবর্তী

উত্তরবঙ্গের মানুষের নানা সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েছে তিস্তা নদী। আর এই তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে সৃষ্টি হয়েছে এক অন্য ধারার গান। যা তিস্তাবুড়ির গান বা মেচেনি গান বা ভেদেইখেলি গান নামে পরিচিতিলাভ করেছে। দেবী তিস্তার মিথকথার ওপর ভিত্তি করে দেবীকে তুষ্ট করার জন্য রাজবংশী সমাজ আরাধনা করে এই দেবীর। তাঁদের বিশ্বাস তিস্তাবুড়ি ঝড়ঝঞ্ঝার দেবী। তাই ঝড়ের হাত থেকে মানুষজন, জীবজন্তু, খেতখামার রক্ষা করার জন্য দেবী তিস্তার উপাসনা। তিস্তাবুড়ির একাধিক নাম রয়েছে। কোথাও তিনি পুজো পান তিস্তাবুড়ি নামে, কোথাও বা মেচেনি, কোথাও ভেদেইখেলি আবার কোথাও বা ঘাটোপুজো রূপে।

চৈত্র-বৈশাখ মাসে তরাই ডুয়ার্সের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের রাজবংশী সমাজের মহিলারা দেবীর প্রতীক হিসেবে একটি ছাতাকে ফুল, বেলপাতা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ান এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। গ্রামে গ্রামে এই পরিক্রমার সময় দেবী তিস্তাবুড়ির উদ্দেশ্যে গাওয়া হয় নানা পর্যায়ক্রমিক গান। রাজবংশী সমাজের মহিলারা একত্রিত হয়ে তিস্তাবুড়ি পুজোর জন্য দল গঠন করেন। সেখানে একজন দলনেত্রী নির্বাচিত হন, যাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় এই পুজো। দলনেত্রীকে বলা হয় ‘মাড়েয়ানী’। সারা মাস ধরে খেলে বেড়ানোর পর মাসের শেষে সংক্রান্তিতে হয় পুজো। ফটামারা, বন্দনা, নামানী, জাগানি, বিল্যাস, দেহর, ভুরাভাসানি ইত্যাদি নানা পর্ব বিভাজনে গাওয়া হয় এই তিস্তাবুড়ির গান।

তিস্তাবুড়ির গানগুলোতে রাজবংশী নারীদের অধ্যাত্মচেতনার সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা বিষয়বস্তু উঠে এসেছে। এই গানগুলোতে আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি সমাজের নানা দিক যা নারীর ব্যক্তিগত অনুভূতি, রীতিনীতি, লোকাচারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু হল তিস্তাবুড়ির গানে অধ্যাত্মবাদকে অতিক্রম করে সামাজিক দিকের বহিঃপ্রকাশ।

তিস্তাবুড়ি পুজোর জন্মখণ্ডে গাওয়া গানগুলোতে আমরা দেখতে পাই সামাজিক লোকাচারের প্রভাব। যেখানে একজন মানবশিশুর জন্মলগ্নে যে নিয়ম আচারগুলো পালন করা হয় রাজবংশী সমাজে, সেই আচারগুলোই উঠে এসেছে গানে–‘নাড়ি কাটিতে ছাওয়া কান্দাইস না/ কালা হাইরানী/ কিনিয়া দিম তোক নাল পাটানী।’

তিস্তাবুড়ির গানের সঙ্গে একদিকে যেমন সম্পৃক্ত হয়েছে রাজবংশী সমাজের রীতিনীতি, অপরদিকে উঠে এসেছে ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে শুরু করে খাদ্যতালিকার মৌলিকত্বও। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী মানুষের জীবনযাপন মূলত সহজ সরল। আর সেই সারল্যের প্রভাব পড়েছে তাদের খাওয়া খাদ্যেও। রাজবংশী সমাজে ব্যবহৃত অকৃত্রিম খাদ্যবস্তুগুলোর উল্লেখ পাওয়া যায় তিস্তাবুড়ি ঠাকুরের নানা পর্যায়ক্রমিক গানে।

তিস্তাবুড়ির গানগুলো যে সময়ে মুখে মুখে গীত হয়েছে সেখানে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন পেশার পরিচয়ও ফুটে উঠেছে। আর এই পেশাগুলোর সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবনচিত্র পরিস্ফুট হয়েছে এই গানে।

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল হাতিয়ার ছিল কৃষিকাজ। আর কৃষিকাজের নানা বিবরণ আমরা পাই তিস্তাবুড়ির গানে। নানা কৃষিজ ফসলের উল্লেখ যেমন এখানে পাওয়া গিয়েছে, সেইসঙ্গে প্রকৃতি কতটা প্রভাব ফেলেছে এই ফসল ফলানোর সময় সেটাও পরিস্ফুট হয়েছে।

(লেখক শিক্ষক। কোচবিহারের ঘোকসাডাঙ্গার বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পনেরোর নামতায় বুধরামদের দুঃস্বপ্ন

  সুকান্ত নাহা বুনোট ন্যাড়া হয়ে যাওয়া জমিটা এখন প্রায়...

মিল-অমিলের যুদ্ধে যাদবপুর-জেএনইউ

  জয়ন্ত ঘোষাল জেএনইউ এবং যাদবপুর যেন দু’ভাই। যদিও দুজনের...

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...