শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

জয়ন্তীঃ শৈশবের চেনা সেই গ্রাম আজ অচেনা

শেষ আপডেট:

  • অঞ্জন রায়

     ১৯ বছর পর আবার আমার শৈশবের লীলাভূমি জয়ন্তীতে গেলাম মুখ‍্যত পুত্রকে তার বাবার জন্মস্থান দেখাতে। গবেষণা এবং লেখার কাজ নিয়ে সে এখন জার্মানির বার্লিন শহরে বসবাস করছে। আর ছিল আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের আমন্ত্রণ।

     জানতাম আমাদের শৈশবের জয়ন্তী আজ হারিয়ে গেছে। সমসাময়িক অনেকেই জয়ন্তী ছেড়ে চলে গেছেন। বাঘ থাকবে, তাই মানুষদের অন‍্যত্র যাওয়া, সরকারি ফরমান। জয়ন্তী এখন বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের আওতায়।

     বক্সা রোড পার হয়ে বালা নদী। কজওয়ে তৈরি হয়েছে। আমাদের ছেলেবেলায় বর্ষায় জল বেড়ে গেলে আমরা বালা নদীর পাড়ে অপেক্ষা করতাম যে, কখন জল নেমে যাবে আর আমরা নদী পার হব।

     আগেরবার আমি উঠেছিলাম আমাদের পুরোনো বাড়িতে, যেটি এখন কলকাতা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের হলিডে হোম। ওরা নাম দিয়েছে ‘অবকাশ’। এবার সেটি পাওয়া যায়নি। তবুও সেখানেই প্রথমে গেলাম।

এই বাড়িতে আমার বড় হয়ে ওঠা। সঙ্গী বোন সীমার জন্ম হয়েছিল এই বাড়িতেই। অনেক স্মৃতি। রান্নাঘর, খাবার ঘর, পুজোর ঘর, মায়ের নিরামিষ রান্নার ঘরগুলোর কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। যদিও সামনের সিঁড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, তবুও হলিডে হোম হয়েছে বলে মূল বাড়িটি ক্ষত নিয়েও আজও দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভালো লাগল।  মূল বাড়ির পিছনে ভগ্নদশা ‘নতুন ঘর’।

কেয়ারটেকার থাকেন। তার পিছনে ছিল বাবার সযত্নে লালিত বিস্তৃত সবজি বাগান, যার চারদিকে ছিল কাঁঠাল গাছের সারি। উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি বাগানটি আগাছায় ভরা। সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে একদল স্পটেড হরিণ। একটু দূরের নবনির্মিত ফরেস্ট বাংলোয় আর যাইনি। পাশের কোম্পানির বাংলোটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, আর তার পিছনদিকে ছিল আমাদের ফুটবল খেলার মাঠ। সেটি দেখলাম জঙ্গলে ঢাকা।

     রেলস্টেশন চত্বরে এলাম। সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। উপড়ে ফেলা হয়েছে রেললাইন। আগে ছিল শুধু বাবুলাল মহাজনের মিষ্টির দোকান আর রামধারীর পান বিড়ির দোকান। সেখানে এখন ডজনখানেক দোকান। মহাজনের ছেলে সহপাঠী চেন্টুয়ার মেয়ে মনোহারি দোকান দিয়েছে। ওর ছেলে আকাশ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। রামধারীজির দোকান চালাচ্ছিল ওঁর ছেলের বৌ। স্কুলের মাঠে গিয়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছিলাম। সেই খোলামেলা পরিবেশ আর নেই, চারদিকে ঘর তুলে তুলে একেবারে দম বন্ধ হবার জোগাড়। কাছেই কাজলের স্বপ্নে পাওয়া কালো পাথরের মন্দির, যত্নের ছোঁয়া সর্বত্র। নদীর ব্রিজটি আর নেই। নদীর বেড-এ সেঁধিয়ে গেছে। অথচ এই ব্রিজের তলায় বসে আমি মাছ ধরতাম, ব্রিজের নীচ দিয়ে ট্রাক চলাচল করত। পলি পড়ে পড়ে নদীর উচ্চতা এখন লোকালয় থেকেও বেড়ে গেছে।

পিডব্লিউডির নতুন বাংলোয় উঠেছিলাম। রাতের দিকে স্থানীয় কাজল মুখার্জি, শংকর মুখার্জি, জগদীশ ওরাওঁ, শ‍্যামল ব‍্যানার্জি, নাইডু বাড়ির একটি ছেলে দেখা করতে এসেছিল জয়ন্তীর সমস‍্যা নিয়ে কথা বলতে। সরকার টোপ দিয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে জয়ন্তী ছেড়ে চলে যেতে।

১৯৭৮-’৭৯-র বাঘ শুমারিতে এই অঞ্চলে ২৭টি বাঘ ছিল, সেই সংখ্যা এখন নাকি ১টি। ডলোমাইট, কাঠ, পাথরের লাইসেন্স অনেক বছর আগে বাতিল হয়েছিল। এখন অনেকগুলো বেসরকারি হোমস্টে হয়েছে। পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে আর আছে মহাকালের গুহামন্দিরগুলো। লোকে এখন জয়ন্তীতে বেড়াতে আসে। শংকর, শ‍্যামল, জগদীশ, নাইডুরা এখনও সরকারি মুচলেকায় সই করেনি। টানাপোড়েন চলছে।

দেখা যাক, কারা জেতে?

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

বিবর্ণ ক্যানভাস ও নীল প্রজাপতি

শাশ্বত বোস প্রকাণ্ড একটা সাদা ক্যানভাসের গায়ে ফ্ল্যাট ব্রাশটা...

রাজনীতির গর্ভগৃহে এক সংস্কৃতিঋষি

পার্থপ্রতিম মিত্র কী করে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়া যায়?...

এক অনন্ত বর্তমানের চলচ্চিত্রকার

শুভময় সরকার বছর কয়েক আগের এক অপরাহ্ণ। শীতের...

সংগীত ও আবহের বিমূর্ত উচ্চারণ

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায় সিনেমার জন্মলগ্ন থেকেই নানা বাঁক নিয়েছে...