সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

রোদের সোনালি রং প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে চিকচিক

শেষ আপডেট:

  • গ্রন্থন সেনগুপ্ত

ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালীন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ক্রিকেটের সূত্রে। কিন্তু কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি যে, সেই দেশে আমার যাওয়ার সুযোগ হবে। সুবিশাল ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট যখন রাত ৮টার সময় সিডনি শহরে ল্যান্ড করছে, তখন প্লেনের কাচে কুয়াশা এবং বাইরে বৃষ্টি। আমার চোখ জলের আর্দ্রতায় ঝাপসা হয়ে এসেছিল। বারবার মনে হচ্ছিল সেই স্কুলের কথা। সাদা-কালো ইউনিফর্ম পরা, বাংলা সাইকেল চালানো ছোটবেলার কথা। অবশেষে এসে পৌঁছোলাম বিয়ার, ক্যাঙারু, ক্রিকেট ও রাগবির দেশ, অস্ট্রেলিয়ায়।

আমি এবং আমার বন্ধু অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে সিডনির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম গত ৬ মার্চ। কলকাতা বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমাদের ফ্লাইট ছিল কলকাতা থেকে সিডনি। মধ্যিখানে কুয়ালা লামপুরে লেওভার। রাত ১১টা ৩০-এ কলকাতা ছেড়ে ভোর সাড়ে ৪টায় কুয়ালা লামপুরে পৌঁছোলাম। চারপাশ থেকে বাংলা ও হিন্দি হরফ উবে গিয়েছে। ইংরেজির সঙ্গে সাইনবোর্ডগুলোয় জায়গা নিয়েছে নতুন এক ভাষা। সকালে খুব খিদে পেয়েছিল। এদিকে, পকেটে যে ভারতীয় টাকা পড়ে রয়েছে তা তো এখন শুধুমাত্র কাগজের টুকরো। কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করে ব্রেকফাস্ট সারলাম। এরপর আর দেরি না করে সোজা সিডনির ফ্লাইটে। রাত সাড়ে ৮টায় সিডনি পৌঁছোলাম। ইমিগ্রেশন পার করে কাস্টমসের গণ্ডি পেরিয়ে অবশেষে পা দিলাম ক্যাঙারুর দেশ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে।

আমরা যার আমন্ত্রণে নাটক করতে সিডনি গিয়েছিলাম সেদিন রাতে তাঁর বাড়িতেই উঠলাম আমরা। জল তেষ্টা পেয়েছিল খুব। জল চাইতেই দেখি রান্নাঘরের সিঙ্ক থেকে কল খুলে গ্লাসে ভরে সেটা আমায় দিয়েছে। ভাবুন, আপনি নতুন কারও বাড়িতে গিয়েছেন, সেখানে যদি কল খুলে আপনাকে জল ভরে এনে দেয় কী যাচ্ছেতাই না আপনার লাগবে। কিন্তু এখানে এটাই স্বাভাবিক। আমি হলিউডের ছবিতে এটা দেখেছিলাম। এবার এটা আমার সঙ্গে হচ্ছে। হলিউডের ডিরেক্টর ডেভিড ফিনচারের খুব ভক্ত। আমার প্রথম দিন থেকেই সিডনি শহরে গিয়ে মনে হচ্ছিল যেন আমি আস্ত একটা ডেভিড ফিনচারের সিনেমার সেটে এসে পড়েছি। ফাঁকা ফাঁকা জায়গা, বাংলো মতন বাড়ি, বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান, ব্যাকইয়ার্ড, বেশ কিছু বাড়িতে বোট বা নৌকো রাখা। সিডনি গিয়ে জানতে পারলাম, অজিদের উইকএন্ডের অন্যতম আকর্ষণ হল হাতে বিয়ার নিয়ে এই বোটিং এবং ফিশিং। পরদিন সকালে উঠে বাইরে এসে দেখছি রোদ পড়েছে সামনের বাগানে। আমি জানি এ আমাদের জলপাইগুড়ির চড়া রোদ নয়। এ বিদেশি রোদ। রোদে দাঁড়াতেই দেখি হাত–পা জ্বলে যাচ্ছে। এত তাপ সেই রোদের। আমাদের কাছে সাদা চামড়ার দেশ মানেই ঠান্ডার জায়গা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে সামারে প্রচণ্ড গরম পড়ে। দিনের বেলায় তাপমাত্রা ৩৫ ছাড়িয়ে গিয়েছে কোনও কোনওদিন। আবার রাত হলেই তাপমাত্রা নেমে আসছে ১৬ কিংবা ১৫-তে। এই গরমের বিষয়টাতেই ওয়েস্টার্ন সিনেমার সঙ্গে ব্যাপারটা মিলল না। আর আমার কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যাওয়া কালো লং কোটটাও একগাদা জায়গা নিয়ে ট্রলির একটা ধারে মন খারাপ করে পড়ে রইল।

ওখানে আমরা সকালে কাজ থাকলে কাজে বের হতাম অথবা ঘুরতাম। আর রাতে রিহার্সাল করতাম প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে। একদিন রাতে রিহার্সাল শেষে আমাদের একজন ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে। সেদিন ছিল আমাদের প্রথমবার সিডনি শহরে যাওয়া। আমার ছিলাম কান্ট্রি সাইডে, মূল শহর থেকে বেশ দূরে। এদিন রাতে আমরা প্রথম পৌঁছোলাম সিডনি শহরে। চারদিকে উঁচু উঁচু বিল্ডিং উঠে গিয়েছে। শনিবারের রাত, রাস্তায় ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। গান গাইছে, গল্প করছে, বিয়ার খাচ্ছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না।  কেউ এসে বলছে না যে তুমি এরকম পোশাক কেন পরেছ আথবা অমুকের পাশে কেন বসেছ? আসলে মরাল পুলিশিংয়ের কোনও জায়গাই নেই এখানে। আমাদের গাড়ি এসে থামল একটা পার্কের কাছে। হাতে একটা আইসক্রিমের বাটি ছিল। সেটা একটা ডাস্টবিন দেখে ফেলতে গিয়ে যখন মুখ তুলেছি, সোজা দেখতে পাচ্ছি প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর জল, তার ওপরে সিডনি হারবার ব্রিজ আর পাশে সিডনি অপেরা হাউস! এ দৃশ্য আসলে ছবি তোলার নয়, লিখে ব্যক্ত করার নয়, শুধুমাত্র প্রাণভরে দেখার। তারপর সময় করে আরও বেশ কয়েকবার গিয়েছি সিডনি অপেরার সামনে। নাটক দেখেছি দুটো। নাটকের ছাত্র হিসেবে অপেরা হাউসে বসে নাটক দেখছি, ভাবতেও অদ্ভুত লাগছিল। সব স্বপ্ন কি এভাবেই সত্যি হয়?

সিডনি অপেরার সামনেই ফেরিঘাট। সুন্দর সমস্ত ফেরিগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিকিটের একটাই ব্যবস্থা। ওপাল কার্ড। অনেকটা আমাদের মেট্রো কার্ডের মতন। আমাদের গন্তব্য সিডনির বিখ্যাত ম্যানলি বিচ। সিডনি আসলে যতটাই বিখ্যাত এর অপেরা হাউসের জন্য, ঠিক ততটাই বিখ্যাত এর ছবির মতন সুন্দর বিচের জন্য। আমরা যখন ফেরি করে ম্যানলি পৌঁছোলাম তখন রোদের সোনালি রং প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পড়ে চিকচিক করছে। ফেরি থেকে নেমেই সোজা বিচে গিয়ে জলে ঝাঁপালাম। শরীরে যখন বরফের মতন ঠান্ডা কনকনে প্রশান্ত মহাসাগরের জল এসে লাগছে তখন মনে হচ্ছে এ স্বপ্ন না বাস্তব! পৃথিবীর মানচিত্রের অন্যদিকটা জুড়ে যেই বিশাল জলভাগ, তারই জলে আমরা দুজনে গা ভাসিয়েছি। আমি যদি ডুব সাঁতার জানতাম তাহলে হয়তো এই আনন্দের ঢেউয়ে ডুবে যেতাম।

এভাবে সময়ের নিয়মে একটা একটা করে দিন কাটতে লাগল। অবশেষে শেষদিন দেখা মিলল ক্যাঙারুর। লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে এদিক থেকে ওদিক। এদিকে আমাদের নাটকের অনুষ্ঠানও লোকের মন কাড়ল। ২৫ মার্চ আমাদের ফেরার দিন। আমরা ছিলাম কিছু বাঙালি পরিবারের পরম আতিথেয়তায়। যখন আমরা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে দুঃখ করছি যে ট্রিপটা চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল, তখন দেখি ওদের চোখও ছলছল। ওরা জানে আমরা দেশে ফিরছি, বাড়ি ফিরছি। ওরা ঘরে ফেরে বছরে একবার কিংবা দু’বছরে একবার। সেই বাংলা সাইকেল, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান, ঘষে যাওয়া পাড়ার রোয়াক ওদের কাছে এলে সিডনি অপেরার থেকেও অনেক অনেক প্রিয়। আমার কাছে সিডনি ভ্রমণ আসলে কখনোই ভোলার নয়। ফ্রেম করে রাখার মতন। কিন্তু দিনের শেষে আমাদের বন্ধু লাগে, বাড়ির ডাল–ভাত লাগে, পাড়ার আড্ডা লাগে, ঝুল পড়া নিজের ঘরটা লাগে। আসলে বিদেশ হয়তো সামাদর করতে জানে, কিন্তু মায়ের বুকভরা আদর শুধুমাত্র এবং একমাত্র এই দেশের মাটিতেই সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

সরকারি চাকরি মানেই শান্তির জীবন নয়

মানসী কবিরাজ অ্যালবামের পাতা ওলটালেই দেখা যাবে  আমাদের প্রায় ...

কবিতা

১ অ-কৃতজ্ঞ সোমা দে সভ্যতার ভেতরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্বরতা শরীর থেকে...

সোনার সংসার, যুদ্ধের সংসার

অরিন্দম ঘোষ বাংলায় ‘সোনার-সংসার’ বলে একটা শব্দবন্ধ আছে। এই...

গুজরাট যখন বাংলাকে মনে করায়

দেবদূত ঘোষঠাকুর  সম্প্রতি গুজরাটের পশ্চিম উপকূল ধরে ঘুরে একটা...