- রাজীব চট্টোপাধ্যায়
থিম্পুর রাস্তায় হাঁটলে যে কোনও জেনারেল স্টোরে চোখে পড়বে থরে থরে সাজানো ভারতীয় জিনিসের সম্ভার! তার সঙ্গে ইদানীং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা নানা মুদিখানার জিনিসপত্র! রাস্তাঘাট ছিমছাম। সাজানো গোছানো। যে কোনও ইউরোপিয়ান দেশের মতো! দেখছিলাম, নেই ট্রাফিকের চোখরাঙানি! পথে পুলিশের প্রায় দেখাই মেলে না! শৃঙ্খলাবদ্ধ ভুটানি ড্রাইভাররা পথচারীকে জায়গা করে দেন…হর্ন বস্তুটি সম্পূর্ণ বর্জিত!
ষাট শতাংশ পর্যটক ভারত থেকে, অনেকটাই বাংলা ও দক্ষিণ ভারত থেকে। তা সত্ত্বেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে ডালভাত বা ইডলি-ধোসার দোকান গজিয়ে ওঠেনি… যেমনটা হয়ে থাকে আর কি! বরং এইসবের সন্ধানে বেরিয়ে আলাপ হতে বাধ্য ইমা দাৎসির সঙ্গে। যা ভুটানের সবচেয়ে জনপ্রিয় (এবং জাতীয়) খাবার! সবুজ লংকা ও চিজ আর চিকেন দিয়ে বানানো হয় এই স্টু! আর পুরো ভুটান পর্কপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য! খাদ্যের বাণিজ্যকরণের টোপ সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছে এখানকার বণিক সমাজ! কোনও ছুঁতমার্গ ছাড়াই!
বুক ঠুকে বলে ফেলা যায়, দেশটা দরিদ্র হলেও দারিদ্র্য নিয়ে রাজনীতি নেই। ২০০৭ সালে রাজকীয় আদেশবলে রাজনৈতিক দল নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। দেশটি এখন গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে, সে অফিস, হোটেল, রেস্তোরাঁ যাই হোক না কেন, দেওয়ালে সর্বত্র বিরাজমান বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। বছর তেতাল্লিশের রাজাকে নিয়ে সুখেই ঘর-সংসার করেন তাঁরা! গল্পের রাজার মতো, ভুটানের রাজাও ছদ্দবেশে ঘুরে বেড়ান, বাজারে বাজারে, পাহাড়ে পাহাড়ে!
পারো িবমানবন্দর দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন বিমান অবতরণগুলির মধ্যে একটি। আঠারো হাজার ফুট উঁচু দুটি শিখরের মধ্যে একটি ছোট রানওয়েতে অবতরণের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং ইস্পাতের স্নায়ু, দুইই চাই সমপরিমাণে! পারো শহরটি একরাশ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। অতিরিক্ত পর্যটক টানার লোভে প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। তাই টাইগার্স নেস্ট, যা পারোর অন্যতম দর্শনীয় স্থান, তা দেখতে একমাত্র উপায় পাহাড়ি পথ ধরে তিন ঘণ্টার হন্টন! সারা দেশে অজস্র ভিউপয়েন্ট… আর হবে নাই বা কেন! এ এক এমন দেশ যে ক্যামেরায় তোলা ছবি ছ’গোলে হারে প্রকৃতির আসল ছবির কাছে! ক্যামেরার ফিল্টার হয়ে থাকে ম্রিয়মাণ।
ধীরে ধীরে অল্পবিস্তর পাশ্চাত্যের প্রভাব যদিও বা কোথাও চোখে পড়ে, আরও বেশি চোখে পড়ে ভুটানের জাতীয় পোশাক পরা লোকজন! ঘো আর কিরা। সমস্ত সরকারি অফিসে এটি বাধ্যতামূলক পোশাক। তবে নিয়মের রক্তচুক্ষ নয়, অধিকাংশ এই পোশাক পরেন জাত্যভিমান থেকে।
দূষণমুক্ত, চারিদিকে সবুজ গাছপালা, দেশের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ হওয়ায় দেশজুড়ে শান্তির বাতাবরণ- এর বাইরেও কি কোনও আতঙ্কের চোরাস্রোত ভুটানিদের মনে দানা বাঁধছে? অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের অভাব এবং বেসরকারি খাতের সীমিত কার্যকলাপ দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ভুটানে শুনলাম, তরুণ প্রজন্ম চাইছে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। অগত্যা অধিকাংশ পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া। অতি সম্প্রতি ভুটানের রাজা পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে নিজেই পৌঁছে যান অস্ট্রেলিয়া। রাজ দর্শনে সিডনি এবং ক্যানবেরা দু’জায়গায় উপচে পড়ে স্থানীয় ভুটানিদের ভিড়!
দেখে ভালো লাগল, ধর্ম নিয়ে চাপানউতোর নেই… নেই রাজনৈতিক হানাহানি। চারপাশে বড় দাদা প্রতিবেশী দেশ থাকা সত্ত্বেও ভুটান ধরে রেখেছে তার নিজেস্ব অস্মিতা। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে নির্লিপ্ত এই দেশটা কিন্তু নিজেকে নিয়ে দারুণ খুশি। দেশটার বিত্ত নেই… সুখ আছে… আর আছে নৈসর্গিক সৌন্দর্য! বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রত্যেকটি ভুটানবাসীর অধিকার। উন্নততর চিকিৎসার প্রয়োজন পড়লে কলকাতা অথবা ব্যাংকক… পুরোটাই সরকারি সাহায্যার্থে! আর হ্যাঁ… সমস্ত পেট্রোল ও ডিজেলজাত পণ্য সরবরাহ হয় ভারত থেকে। কিন্তু জয়গাঁর মানুষ পেট্রোল কেনেন ফুন্টসোলিং থেকে! কারণ অনুমানযোগ্য!
বাঙালিদের অনেকেরই প্রশ্ন, ভুটান যাওয়ার জন্য কি খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে? চেনাশোনা অনেকের মুখে এই প্রশ্ন শুনেছি। নতুন করে ভুটান খোলার পর কি যাতায়াত সমস্যা বেড়েছে? তাঁদের উত্তরে বলি, এখনও ভুটান প্রত্যেকটি পর্যটকের থেকে সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি বাবদ প্রতিদিন একশো ডলার ধার্য করে (যা কয়েক দশক ধরে ছিল পঁয়ষট্টি ডলার, পরে বেড়ে হয় দুশো ডলার!)। ভারতীয়দের জন্য অবশ্য অঙ্কটা অনেকটাই কম… ব্যক্তিপ্রতি দিনপিছু বারোশো টাকা (২০২০ সালের আগে ভারতীয়দের কোনও টাকা লাগত না)! তবে ভারতীয়দের জন্য কোনও ভিসার প্রয়োজন আজও নেই। কেবল প্রয়োজন ‘এন্ট্রি পারমিট’ যা অভিবাসন দপ্তর দিয়ে থাকে। প্রয়োজন পাসপোর্ট অথবা ভোটার পরিচয়পত্র। পাসপোর্টের প্রয়োজন পড়বে এরপরেও… থিম্পু অথবা পারোতে হোটেল চেক-ইন এর সময়।
আগে ভারতীয় পর্যটক নিজের গাড়ি নিয়ে ভুটানের আনাচকানাচে ঘুরতে পারতেন। নিখরচায়! এখনও পারেন, তবে গাড়ির জন্য দিন পিছু সাড়ে চার হাজার টাকা ভুটান সরকারকে দিতে হয়। এই জিরো কার্বন দেশে এই টাকাটি ব্যবহৃত হয় পর্যটকদের দ্বারা উৎপাদিত কার্বনকে দুরমুশ করতে! প্রসঙ্গত বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ হওয়ার তকমা পেয়েছে ভুটান এবং কোনও দামামা ছাড়াই!
বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ ভুটান! তলিয়ে দেখলে আশ্চর্য হওয়ার বদলে ভুটানের দূরদর্শিতার তারিফ করতে হয়! সত্তরের দশকে যখন গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক সূচক হিসেবে জিডিপিকে আঁকড়ে ধরছে, তখন ভুটান অগ্রাধিকার দিয়ে বসেছে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসকে! দুই বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চিন যখন করোনা ধস্ত, তখন ভুটানে করোনাজনিত মৃত্যু ছিল শুধু একুশটি! ছবির মতো সুন্দর এই দেশের (নাকি ছবির চেয়েও সুন্দর?) না আছে তেমন ভারী শিল্প, না কোনও উত্তরাধিকারের কৌলীন্য! আছে কেবল পাহাড়, ঘন জঙ্গল, নদীর কলতান ও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত সাধারণ মানুষের অনাবিল হাসি! যাঁরা ভয়ংকরভাবে ধরে রেখেছেন নিজেদের জাতিসত্তা! হাজার প্রলোভনেও যা অটুট!
চারদিকের পালটে যাওয়া সময় দেখে অভ্যস্ত চোখ আর মনের কাছে ভুটান এক অদ্ভুত অনুভূতি। বিশ্ব সুখ সূচক বলে দেয়, অল্পের মধ্যে কীভাবে ভালো থাকা যায়, ভুটান আমাদের প্রতিনিয়িত শিখিয়ে চলেছে। নিঃশব্দে।