শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

বরাভূমের টানে    

শেষ আপডেট:

  • দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

সেদিন সকালে রূপসি বাংলা এক্সপ্রেস আদ্রা জংশন পেরোবার পরেই আমার সহযাত্রী অধ্যাপক বন্ধু বললেন, ডানদিকের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকুন। জয়চণ্ডী পাহাড় দেখতে পাবেন। বন্ধুটি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা করেছেন পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে। পুরুলিয়া জেলার আনাচকানাচ তাঁর করতলগত। চলন্ত ট্রেনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার কাচের জানলা দিয়ে বাইরের রোদে ঝলসানো রাঢ়ভূমির ঊষর প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকি। ধু-ধু প্রান্তরে থেকে থেকেই চোখে পড়ে বেঁটে বেঁটে খেজুর গাছ। তাতে ঝুলছে প্রচুর থোকা থোকা পেকে ওঠা হলুদ খেজুর। আর দেখা যেতে থাকে ঢ্যাঙা তাল গাছ। তারপরেই ছুটে চলা দৃশ্যপটে ভেসে আসে মাঠ-ঘাটের ওপারে সবুজ-বিহীন পাথুরে দুই চূড়া আর সামনে জোড়া তাল গাছ। দূর থেকে সেই জয়চণ্ডী পাহাড়। আসানসোল-আদ্রা সেকশনে জয়চণ্ডী রেলস্টেশনটির স্থাপত্যও নজর কাড়ে। সেখান থেকে মাত্র দেড় কিমি দূরেই রঘুনাথপুর মহকুমায় এই পাহাড় আর তার চূড়ায় জয়চণ্ডী মাতার মন্দির। রুক্ষতার মধ্যেও জায়গাটির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। জয়চণ্ডী পাহাড়ের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নজর কেড়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই পাহাড় আর প্রান্তরই এবার একেবারে চোখের সামনে।

হীরক রাজার কথা উঠতেই মনে পড়ে এই রাঢ় অঞ্চলে রাজাদের গল্প আর ভূমিজ সম্প্রদায়ের কীর্তিকাহিনীর কথা। পুরুলিয়া বলতে যেসব শহুরে মানুষ আদিবাসী নৃত্য, মহুয়ার নেশা আর চড়িদার মুখোশ এবং ছৌ নাচ ভাবেন তাঁদের জেনে ভালো লাগবে, উত্তরবঙ্গের পাহাড়, নদী আর জঙ্গলের মতোই পুরুলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একেকটি জায়গাকে ঘিরে আকর্ষণীয় উপকথা। সম্রাট আকবরের মনসবদার রাজা মান সিংহের নামের থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল মানভূম। ব্রিটিশ আমলে পুরুলিয়া ছিল মানভূমের অন্তর্গত। আবার পঞ্চম শতকের জৈন ভগবতী সূত্র অনুযায়ী পুরুলিয়ার নাম ছিল বজ্রভূমি- ১৬টি মহাজনপদের অন্যতম। পুরুলিয়া জেলার পাড়া, দেউলঘাটা, পাকবীড়া সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় এখনও রয়েছে ইট ও পাথরের তৈরি জৈন মন্দিরের অসামান্য নিদর্শন। গড় পঞ্চকোটের মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ অবলুপ্ত তেলকুপি সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করছে। পুরুলিয়ার রাস্তা দিয়ে চলতে থাকলে একেকটি জায়গার নামফলক মুহূর্তে সেই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্মৃতি উসকে দেয়। সেদিন বেলপাহাড়ি যাবার পথে চোখে পড়ল মানবাজারের কাছে একটি গ্রামের নাম তামাজুড়ি। এক কালে সেখানে ছিল তামার খনি। সেই তামা যেত তাম্রলিপ্ত বন্দরে। আজ গ্রামটি দেখে বোঝার উপায় নেই কী ছিল তার সম্পদ।

আবার মানবাজারের কাছেই পুরুলিয়া-বাঘমুণ্ডি রোডের ওপরে বরাভূম। চমৎকার রেলস্টেশনও আছে। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জায়গাটির নামকরণের পিছনে রয়েছে অনবদ্য কাহিনী। মানভূমে ছিল দুটি প্রাচীন রাজ্য পঞ্চকোট ও পাতকুম। অতীতে শ্বেত বরাহ ও নাথ বরাহ নামে দুই ক্ষত্রিয় রাজকুমার পাতকুমে এসে রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। দুই ভাই রাজকুমার। তাই তাঁরা কারও কাছে মাথা নত করতেন না। ব্রাহ্মণদেরও প্রণাম করতেন না। রাজার কানে পৌঁছাল ব্রাহ্মণদের ক্ষোভের কথা। তিনি দরবারে রাজকুমারদের ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা বললেন, তাঁদের ঘাড়ের সঙ্গে মাথা এমন দৃঢ়ভাবে আঁটা যে মাথা কিছুতেই নত হয় না। রাজা বললেন বেশ, তোমাদের কথার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। তোমরা দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তোরণদ্বার দিয়ে রাজবাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করবে। তারপরে রাজা করলেন কী, তোরণে একখণ্ড ধারালো করাত এমনভাবে ঝুলিয়ে দিলেন যাতে ওই করাত দেখে দুই ভাই মাথা না নোয়ালে তাঁদের দেহ থেকে মাথা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। প্রথমে বড় ভাই শ্বেত ঘোড়া ছুটিয়ে আসার সময় করাত দেখেও মাথা নীচু করলেন না এবং তাঁর মাথা খণ্ডিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল।

রাজা তখন দূর থেকে ছোট ভাই নাথকে ঘোড়া থামাতে বললেন। নাথ ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে তোরণ পেরোলেন এবং দাদার অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ হলেন। অন্যদিকে, রাজাও অনুতপ্ত হলেন। দুই রাজকুমারের ক্ষত্রিয়ত্বের প্রমাণ পেয়ে নাথকে নিজের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যে জমি দান করলেন। বরাহ ভাই দুজনের নামানুসারে নতুন রাজ্যের নাম হল বরাভূম। দ্বিতীয় একটি গল্প অনুযায়ী একদা এক ক্ষত্রিয় রাজা সপরিবারে মানভূমের পার্বত্য ও অরণ্য পথে শ্রীক্ষেত্র যাচ্ছিলেন। তীর্থযাত্রায় বাধা পড়বে বলে রানি তাঁর গর্ভাবস্থার কথা গোপন করেছিলেন। কিন্তু পাহাড়ের কোলে অরণ্যের মধ্যে রানির যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। রানি সেই সদ্যোজাত সন্তানদের রাতের অন্ধকারে সেখানে রেখেই পরদিন ভোরে রাজার সঙ্গে পুরীর পথে এগিয়ে যান। ওদিকে অপূর্ব সুন্দর দুটি শিশুকে দেখতে পেয়ে এক বন্য-বরাহী স্তন্য দিয়ে তাদের রক্ষা করে। কয়েকদিন বাদে আদিবাসীরা যমজ শিশুকে অরণ্য থেকে উদ্ধার করে নিজেদের কাছে রেখে পালন করে। বরাহ দুগ্ধে রক্ষা পাওয়ায় তাদের নাম হয় শ্বেত বরাহ ও নাথ বরাহ। ক্ষত্রিয় রাজার পরিত্যক্ত ও অনার্য পরিবারে প্রতিপালিত দুই শিশু হয়ে ওঠে অসম সাহসী বীর। মাথা নত করার শিক্ষা তারা পায়নি। তাদের রাজ্য পরিচিতি পায় বরাভূম নামে। ব্রিটিশদের কাছে আদিবাসী সম্প্রদায় বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করেনি।

প্রাচীন সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নদীর উপকূলবর্তী সমতলভূমি আর্য ঋষিদের বেদগানে মুখরিত হওয়ার আগেই সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি অনার্যদের প্রেমগানে পূর্ণ হয়েছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে বর্ণিত নিষাদরাই আধুনিক কালের মুন্ডা আদিবাসী। কাঁসাই ও সুবর্ণরেখা নদীর মধ্যবর্তী উপত্যকায় ভুমিজ জাতির বাসস্থান। পুরুলিয়া বেড়াতে গিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ই হোক কিংবা কুইলাপালের অরণ্য অথবা বান্দোয়ান, বেলপাহাড়ি, বুড়ামশোল, ঝিলিমিলি, ঢাঙিকুসুম, ময়ূর ঝর্ণা, কেতকী ঝর্ণা, খান্ডারনি লেক বা ঘাগড়া জলপ্রপাত- যেখানেই আমরা যাই না কেন, আদিবাসী মানুষের শৌর্য, আত্মমর্যাদা এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা আমরা যেন কখনও বিস্মৃত না হই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

বিয়ের ট্রাঙ্ক

 পাপিয়া মিত্র   জামরুল গাছের পাতাগুলো ঝকঝক করছে। প্রায় ষাট...

ধানের উৎসবে আষাঢ় নামে টুংলাবংয়ে

শুভঙ্কর চক্রবর্তী কিছুদিন আগের কথা, পডকাস্টে সমরেশ মজুমদারের ‘অর্জুন...

মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তা ঠেকাতে নীলনকশা

 অন্বেষা বসু রায়চৌধুরী ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে,...

ন হন্যতে

 শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ সমুদ্রে কিংবা নদীতে অথবা পাহাড়ে মাখামাখি সূর্যোদয়...