মাম্পী চৌধুরী, শিলিগুড়ি: কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি-/বোঝাই-করা কলসি হাঁড়ি… কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগের সেই ‘হাট’ কবিতাটা মনে পড়ে? যেটা মুখস্থ না করার জন্য একটা সময় মাস্টার মশাইয়ের কাছে কত কানমলা খেতে হয়েছিল। তবে এবার রবি ঠাকুরের সেই বংশীবদন হাজির হয়েছে শহর শিলিগুড়িতে (Siliguri)। রাজস্থান থেকে গাড়িবোঝাই করে টেরাকোটার হাঁড়ি, তাওয়া, প্লেট, কড়াই সবই নিয়ে এসেছেন সুরেশ বাগাড়িয়া। দাম খুব একটা বেশি না হওয়ায় গৃহিণীদের কাছে বেশ পছন্দের হয়ে উঠেছে রান্নাঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সামগ্রীগুলি।
সুরেশ জানালেন, তাঁর কাছে টেরাকোটার যে তাওয়া রয়েছে সেগুলির দাম ৫০ টাকা থেকে শুরু হচ্ছে। এছাড়াও হাঁড়ি, কড়াই, কাপ সহ আরও বিভিন্ন জিনিস রয়েছে তাঁর গাড়িতে। সুরেশের কথায়, ‘তিন-চার হাজার পিস বাসন নিয়ে এসেছিলাম। দু’তিনদিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে। যেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি সেখানেই সবাই কিনছেন।’
সভ্যতার প্রথম পর্যায়ে মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকতে শিখল তার পর থেকেই তাঁরা রান্নাবান্নার প্রয়োজনবোধ করেছিল। সেই শুরু, ধীরে ধীরে মানুষ যত আধুনিক হয়েছে ততই তার রুচি, পছন্দে বদল এসেছে। তবে শুরুর দিকে মানুষ যে মাটির বাসনপত্র ব্যবহার করত বর্তমান সময়ে সেই মাটির বাসনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে একটা প্রজন্ম। বিবাহের আগে আইবুড়ো ভাত হোক কিংবা বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যটির প্রথম ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠান কিংবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দামি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ বা ডিনার। সবেতেই এখন ট্রেন্ড মাটির থালা, বাটি, গ্লাস। তার সঙ্গেই এখন নতুন সংযোজন টেরাকোটার এই নতুন বাসন।
মানুষের প্রাকৃতিক জিনিসে ঝোঁক বাড়ার দিকটিকে বেশ ভালোভাবেই নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পুষ্টিবিদ সুপ্রিয়া দাসের বক্তব্য, মাটি বা অ্যালকালাইন প্রকৃতির হওয়ায় মাটির বাসনে রান্না করলে বা খাবার খেলে শরীর সুস্থ থাকে। তাছাড়া মাটির বাসনে রান্না করা খাবার খুব সহজেই হজম হয়ে যায়। খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম এবং সালফার ইত্যাদি মিশে যাওয়ার কারণে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপযোগী হয়ে ওঠে।
পরিসংখ্যান বলছে বর্তমান সময়ে সম্পূর্ণভাবে না হলেও, আংশিকভাবে মানুষ মাটির বাসনের দিকে ঝুঁকেছে। শহর শিলিগুড়ির বাজারও ধীরে ধীরে দখল করতে শুরু করেছে ট্রেন্ডি মাটির বাসন। তবে সাধারণ মাটির বাসনের থেকে এই রাজস্থানি টেরাকোটার বাসনের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই বলছেন, রাজস্থানি মাটির বাসনে অনেকটাই আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে। এটা দেখতে বেশ চকচকে। এমনকি এগুলি বেশ শক্তপোক্তও। সহজেই ভেঙে যায় না।
এদিন গাড়ি দাঁড়াতেই বাসন কিনতে এসে হাজির হন হাসিনা বিবি, মঞ্জু দাস, মুক্তা খাতুনরা। সকলেই জানালেন, ছোটবেলায় ঠাকুমা, দিদাদের মাটির হাঁড়ি, কড়াই ব্যবহার করতে দেখেছিলেন। তবে তাঁদের আফসোস এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না। হাসিনা বললেন, ‘আজ হাতের কাছে পেলাম, তাই আর কিনতে দেরি করিনি।’ একই ধরনের কথা জানিয়েছেন মঞ্জু, মুক্তারা।
এই বিষয়ে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত জানালেন, নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সকলেই ননস্টিক পাত্রে রান্না করলেও, স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য মাটির পাত্রের জুড়ি মেলা ভার।